ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কান্নার জলে আর কত আগুন নেভানো

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ৩০ মার্চ ২০১৯

 কান্নার জলে আর কত আগুন  নেভানো

মোরসালিন মিজান ॥ কান্নার জলে আর কত আগুন নেভানো? বেদনা করে কত আর বেঁচে থাকা? সত্যি সহ্য হয় না। বারবারই আগুন। প্রথমে ধোঁয়া। ধোঁয়া থেকে ছোট আগুন। তার পর বড়। আরও বড়। সবই চোখের সামনে। তবুও যেন দেখছেন না কেউ। কোন কর্তৃপক্ষ নেই। আইন নেই। থাকলেও প্রয়োগ নেই। বিপদগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধার করার সরকারী সংস্থা দফতর অধিদফতর আছে। সক্ষমতা নেই। আর তাই বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে চিৎকার করছে আক্রান্ত মানুষ। বাঁচতে পারছে না। মানুষ হয়ে আরেক মানুষের করুণ মৃত্যু দেখতে হচ্ছে। এভাবে জীবিতদের বুকেও জমা হচ্ছে সহস্র ক্ষত। ক্ষত নিয়ে, ব্যর্থতা নিয়ে কত আর বেঁচে থাকা? এই তো কিছুদিন আগে, ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটল। ঘটনাই বলতে হবে একে। নিয়মিত যা ঘটে তা ঘটনা বৈ দুর্ঘটনা নয়। চোখের সামনে পুড়ে ছাই হলো কয়েকটি ভবন। ভেতরে কেউ হয়ত টিভি দেখছিলেন, গল্প করছিলেন, রাতের খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কেউ ঘুমোতে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন হয়তো। অথচ চির ঘুমের দেশে পাড়ি জমাতে হলো তাদের। পুড়ে মৃত্যু হলো অন্তত ৭৮ জনের। দিনের বেলায় ভস্মীভূত এলাকার ছবি দেখে গা কেঁপে উঠল সাধারণ মানুষের। কার বা কাদের ব্যর্থতায় এমন মৃত্যু? এসব ব্যর্থতা যারই হোক, আমরা কি মনে মনেও সে দায় গ্রহণ করেছি? কিছু কি শিখছি? উত্তর: না। কেউ শেখাতেও আসেনি। বাধ্য করেনি। ফলে এত মৃত্যুও মৃত্যু ঠেকাতে পারছে না। আগুন লাগার কারণগুলো একইভাবে বিদ্যমান থাকায় চকবাজার পোড়ার অল্প দিনের ব্যবধানে গত বৃহস্পতিবার আগুনে পুড়ল বনানীর এফআর টাওয়ার। চোখের সামনে দাউ দাউ আগুন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে জ্বলল। বহুতল ভবন থেকে অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। না, মরার জন্য নয়। বরং বাসায় অপেক্ষা করে থাকা মায়ের কাছে পৌঁছার জন্য। মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে প্রিয়তমা স্ত্রীর ছবি, তার কাছে ফিরতে চান, সে জন্য ঝাঁপ দিলেন। সকালে ‘আসছি’ বলে শিশু সন্তানের কপালে চুমু খেয়েছিলেন বাবা, সেই বাবা তার কথা রাখার জন্য ইন্টানেটের তার বেয়ে নেমে আসার চেষ্টা করলেন। পারলেন না! আবারও মৃত্যু। এবার অন্তত ২৫ জনের প্রাণ গেল। মৃত্যুর দু’দিন আগেও বেসরকারী একটি কোম্পানির হিসাবরক্ষক ইকতিয়ার হোসেন মিঠু মোবাইল ফোনে মায়ের খোঁজ খবর নিয়েছেন। জানতে চেয়েছেন, মা ওষুধ খেয়েছেন কিনা। সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, তোমার হাইপ্রেসার। সময় মতো ওষুধ খাবে। একইরকম আগ্রহ নিয়ে বাবার শরীরের অবস্থা জানতে চেয়েছেন। কিন্তু এখন কে ওষুধ খাওয়ার জন্য তাগাদা দেবে? বিলাপ করতে করতে জানতে চাইছেন মা রেখা খাতুন। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা রুমকি হয়তো তার অনাগত সন্তানকে পৃথিবীতে আনার জন্যই বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। বাঁচতে পারেননি তিনি। তার সন্তানও জন্মের আগেই মৃত্যুকে করেছে আলিঙ্গন। একই আগুনে, আহা কী বেদনা, পুড়ে মরেছে তার স্বামী মাকসুদ! নব দম্পতির সব স্বপ্ন সাধ পুড়ে গেছে আগুনের লেলিহান শিখায়। এভাবে ২৫ জনের পরিবারেই নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা। কারা এর জন্য দায়ী? নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর পরামর্শ নিয়ে ভবনের ধরন অনুযায়ী বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণ কাজ করতে হয়। এফআর টাওয়ারের বেলায় সেটি করা হয়েছিল কি? এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে নিশ্চিত যে, কিছুই তার করা হয়নি। এ দায় কি নেবে রাজউক? নিচ্ছে? ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা নিয়েও ঘোরতর প্রশ্ন উঠেছে। অপেক্ষাকৃত নতুন শহরে, যথেষ্ট প্রশস্ত রাস্তার ধারে ভবনটির অবস্থান। খুব কাছে জলভর্তি লেক। এর পরও সারাদিন ধরে আগুন জ্বললো। ভবনটির ভেতর ও বহিরাঙ্গন সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য তারা সংগ্রহ করেছিলেন কি? আগুনের অবস্থান জানতে তারা কি উদ্যোগ নিয়েছিলেন? আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে এই বাহিনীর প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনা কি ছিল? পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সামর্থ্য তাদের ছিল কি? দেখে অন্তত তেমনটি মনে হয়নি। নিজেদের উদ্যোগে অনেকে বের হয়ে আসছিলেন ভবন থেকে। কিছু মানুষ এটা ওটা ধরে নেমে আসার চেষ্টা করলেন। ফায়ার সার্ভিস তাদের ক’জনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে পেরেছে? হ্যাঁ, সাধারণ কর্মীরা জীবন বাজি রেখে চেষ্টা করেছেন। আগুন নেভাতে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন ফায়ার ফাইটার উদ্দীপন ভক্ত। বিষাক্ত ধোঁয়ায় কাবু হয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়েছেন তিনি। তার বুকেও হয়তো বেদনার সুর বাজছে। প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও কত মানুষকে তিনি বাঁচাতে পারলেন না! কিন্তু ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ কি এভাবে ভাবছে? মনে হয় না। এবারও চোখের জলেই চেষ্টা হয়েছে আগুন নেভানোর। ভবনের নিচে হাজার হাজার মানুষ। যে যেভাবে পেরেছেন উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করেছেন। কান্না ভেজা চোখে সৃষ্টিকর্তার সহায়তা চেয়েছেন স্বজনেরা। টেলিভিশন সেটের সামনে ছিল গোটা দেশ। সর্বক্ষণ খোঁজ খবর নিয়েছেন। কিন্তু আগুন এভাবে জ্বলে না। নেভেও না। বাঁচতে চাওয়া বহু মানুষ তাই বাঁচতে পারেনি। দুঃসহ যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মরেছে। এই দৃশ্য দেখে বেদনায় ডুবছে মানবিক মানুষ। আর যেন নেয়া যাচ্ছে না। প্রিয়জনের অপমৃত্যু দেখার বেদনা নিয়ে, অক্ষমতা নিয়েই কি বাঁচতে হবে? কবে আর জীবন ফিরে পাবে স্বাভাবিক ছন্দ? এবং আর কত প্রশ্ন করলে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে? আমরা জানি না। কেউ কি জানেন?
×