ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চেয়ারেই ছিল পঙ্গু মঞ্জুরের পোড়া দেহ

প্রকাশিত: ১০:৪১, ৩০ মার্চ ২০১৯

 চেয়ারেই ছিল পঙ্গু মঞ্জুরের পোড়া   দেহ

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ আগুনে কারও শরীর পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। বহুতল ওই ভবনের ফ্লোরে ও সিঁড়িতে সারি সারি পোড়া দেহ পড়েছিল। চেনার উপায় ছিল না। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, চেয়ারের ওপর বসা ছিল পঙ্গু মঞ্জুর হাসানের (৫০) পোড়া লাশ। এসব লাশ উদ্ধার করতে গিয়ে উদ্ধারকর্মীরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। অনেকে কান্না ধরে রাখতে পারেননি। রীতিমত সর্বনাশা আগুনে পুড়ে যাওয়ার মানুষের সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, ওই ভবন থেকে ১৯ পোড়া লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারে ২১ তলায় কাশেম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডে প্রধান কার্যালয় থেকে চেয়ারের বসা অবস্থায় পঙ্গু মঞ্জুর হাসানের (৫০) পোড়া লাশ উদ্ধার করে উদ্ধার কর্মীরা। তিনি কাশেম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। তার বাবার নাম মৃত মুনছুর রহমান। গ্রামের বাড়ি নওগাঁ সদর উপজেলার বোয়ালিয়া পূর্বপাড়া গ্রাম। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে এফআর টাওয়ারে জীবনের শেষ সময়ে ছোট ভাই মেহফুজ জুবায়ের পলাশের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেন পঙ্গু মঞ্জুর হাসান। বার বার বাঁচার আকুতি জানিয়েছিলেন। আর বলছিলেন, এ সময় আমিতো বের হতে পারছি না। পঙ্গু মানুষ। আমি মনে হয় আর বাঁচব না। সবাই অফিস থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি কোন উপায় না পেয়ে অফিসের চেয়ারে বসে আছি। সবাই আমার জন্য দোয়া করিস। তোরা ভাল থাকিস। এভাবে ছোট ভাই মেহফুজের সঙ্গে জীবনের শেষ কথাগুলো বলেন পঙ্গু মঞ্জুর হাসান। নিহতের ছোট ভাই শিমুল বলেন, চাকরিরত অবস্থায় ২০০০ সালে অফিসের সামনের রাস্তায় সড়ক দুর্ঘটনায় ভাই মঞ্জুর পঙ্গু হয়ে যান। এরপর থেকে ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারতেন না। এক প্রকার পঙ্গু জীবনযাপন করতেন। কিন্তু তারপরও কোম্পানি ভাইকে চাকরি থেকে বাদ দেয়নি। অফিসে যখন আগুন লাগে সবাই বাঁচার জন্য ছোটাছুটি করছিল। কিন্তু ভাই পঙ্গু হওয়ায় কিছু করার উপায় ছিল না। অফিসে বসেই ফোনে আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তার শেষ কথা ছিল আমি তো বের হতে পারছি না। এখানে হয়তো আমার শেষ সময় যাবে। এক সময় তার ফোনের সংযোগ কেটে যায়। এরপর ফোনে রিং হলেও রিসিভ হয়নি। ঘটনার দিন রাতে উদ্ধার কর্মীরা তার মরদেহ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে সেখানে তাকে শনাক্ত করা হয়। নিহতের চাচাত ভাই সাবেক সেনা সদস্য ফজলুর রহমান জানান, যখন ঢাকায় থাকতাম নিয়মিত তার সঙ্গে দেখা করতাম। তার অফিসে যেতাম। তাকে ধরে ওঠাবসা করাতে হতো। যখন আগুন লাগার সংবাদ পেলাম তখনই ধারণা করেছি হয়তো সে আর বের হতে পারবে না। নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মঞ্জুর হাসান ছাত্রজীবন থেকে ঢাকায় থাকতেন। ছাত্রজীবন শেষে চাকরি শুরু করেন। এরপর সংসার। পরিবার নিয়ে ঢাকার ইব্রাহিমপুরে বসবাস করতেন। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। শুক্রবার সকালে তার লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে ঈদ-উল ফিতরের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল মাকসুদ (৩১) ও রুমকি বেগম (২৮) দম্পতির। কিন্তু পুড়ে তাদের সেই স্বপ্ন ছারখার হয়ে গেল। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানীতে এফআর টাওয়ারে লাগা আগুনে তারা মারা যান। রুমকি সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। এই দম্পতি একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করতেন। রুমকি ওই ভবনের ১০ তলায় আর মাকুসদ ১১ তলায় কর্মরত ছিল। বৃহস্পতিবার রাতে ১০ তলা থেকে অন্তঃসত্ত্বা রুমকির লাশ উদ্ধার করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, জীবন বাঁচাতে ১১ তলা থেকে লাফ দিতে গিয়ে ঘটনাস্থলে মাকসুদের মৃত্যু হয়। আর রুমকি কালো ধোঁয়া ও গ্যাসে শ্বাসরোধ হয়ে মারা যায়। মাকসুদের বাড়ি পুরান ঢাকার গে-ারিয়া এলাকায়। তার বাবা মিজানুর রহমান। রুমকি বেগমের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলায়। তিনি কৈমারী ইউনিয়নের আশরাফ আলীর মেয়ে। রুমকি তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। রুমকির মেজো ভাই ও বিন্যাকুড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রওশন আলী রনি। তিনি জানান, ১৭ মার্চ মোবাইল ফোনে ছোট বোন রুমকির সঙ্গে তার কথা হয়। সে বলেছিল, ঈদ-উল ফিতরের ছুটিতে বেড়াতে আসবে। এখন ও লাশ হয়ে বাড়ি ফিরবে। এই বলে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। রুমকির খালু শফিকুল ইসলাম জানান, সাড়ে তিন বছর আগে তার ভাতিজির বিয়ে হয়। গত চারদিন আগে মেয়ে জামাই মাকসুদ এলাকায় বেড়াতে আসে। আর চারদিন পর তার মৃত্যুর খবর শুনতে হলো। অন্যদিকে বিয়ের মাত্র ৮ মাসের মাথায় এফ আর টাওয়ারে আগুনে তানজিলা মৌলি মিথির সুখের সংসার তছনছ হয়ে গেল। বৃহস্পতিবার রাতে ওই টাওয়ারের ১০ম তলা থেকে তার পোড়া লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে কুর্মিটোলা হাসাপাতাল থেকে মিথির লাশ চাচা সরদার মোঃ সালাউদ্দিনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মোঃ সালাউদ্দিন জানান, আগুনে মেয়েটার স্বপ্নের সংসার পুড়ে গেল। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার মিথি ওই টাওয়ারের ১০ম তলায় কর্মস্থলে ছিল। দুপুরে আগুন লাগলে সেখানে সে আটকা পড়ে। এরপর মোবাইল ফোনে জানালেও বের করা সম্ভব হয়নি। সন্ধ্যার দিকে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া অবস্থায় ওকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। এরপর কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। পরিচয়পত্র দেখে শনাক্ত করার পর মরদেহ আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সালাউদ্দিন জানান, কয়েক মাসে আগে বিয়ে হয়েছে ওর। স্বপ্নের সংসার রেখে পুড়ে মারা গেল মেয়েটা। আদমদীঘির সান্তাহার পৌরসভার বশিপুর গ্রামের এ্যাডভোকেট মাসুদুর রহমান মাসুদের মেয়ে মিথি এফআর টাওয়ারে একটি ট্যুরিজম কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ৮ মাস আগে রাজধানীর ইয়েচ ইয়ার লাইনে চাকরিরত কুমিল্লার রায়হানুল ইসলামের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এই দম্পতি মিরপুরে ভাড়া বাসায় থাকতেন। শুক্রবার সকালে তার লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। বাদ জুমা সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। অপরদিকে ভাগ্নির এসএমএস দেখে ফ্লোরিডা খানম পলির পোড়া লাশ শনাক্ত করেন তার স্বজনরা। নিহতের ভাগ্নি ডাঃ ফাহিমা শামিম খুসবু জানান, খালা ফ্লোরিডা খানম পলির ওই ভবনের ১১ তলায় স্ক্যানওয়েল লজিস্ট্রিক লিমিটেডের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সন্তান ফয়সাল ও স্বামী নিয়ে রাজধানীর মিরপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছিলেন তিনি। নিহতের ভাগ্নি খুসবু জানান, অফিস ভবনে আগুন লাগার পর বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টা পর্যন্ত তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন। ফ্লোরিডা খানম পলি সর্বশেষ কর্মস্থল ১১ তলা থেকে ১২ তলায় যেতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে খুসবু একটি এসএমএস খালার মোবাইল নাম্বরে দিয়ে রাখেন। ঘটনারদিন রাতে ১২তলা থেকে পলির পোড়া লাশ উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে তার লাশ সিএমএইচ হাসপাতালে নেয়া হয়। খুসবু জানান, পরে খালা পলির লাশের পাশে মোবাইলের সেখানকার ডাক্তার সেই এসএমএস দেখে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে সেখানে গিয়ে খালা পলির লাশ শনাক্ত করেন। পরে তার খালু লাশ শনাক্ত করে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। স্বামী রেজাউল করিম রাজুর পোড়া লাশ দেখে তার স্ত্রী রাবেয়া খাতুন বার বার মুর্ছা যাচ্ছিলেন। শুক্রবার কুর্মিটোলা হাসপাতাল থেকে তার লাশ বুঝে নেন তার স্বজনরা। নিহতের সহকর্মীরা জানান, ভবনটির ৮ তলার আসিফ ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন রাজু। তারা জানান, ফরওয়র্ডিং ফ্রেইট কোম্পানির জগতে এক পরিচিত ও দক্ষ নাম ছিল রেজাউল করিম। আসিফ ইন্টারন্যাশনালের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এই ফ্রেইটের এজিএম সৈয়দ আব্দুল আউয়াল নান্না বলেন, ফরওয়ার্ডিং ফ্রেইট জগতে সুপরিচিত নাম ছিলেন রাজু স্যার। প্লেন বা জাহাজ খাতের (পণ্য পরিবহন) সবাই তাকে চিনতেন। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে পালন করতেন। আমাদের যেসব গ্রাহক বিদেশে পণ্য রফতানি করেন তাদের শিপমেন্ট যেন কোনভাবে মিস না হয়। তা নিয়ে নিশ্চিতে কাজ করতেন স্যার। তিনি কাজ করতেন দেশের জন্য। আউয়াল নান্না জানান, একই প্রতিষ্ঠানের আরও দুই কর্মকর্তাকে হারিয়েছেন তারা। এ্যাকাউন্টস অফিসার সালাহ উদ্দিন এবং পরিবহন কর্মকর্তা আহমেদ জাফর। অফিসে তখন প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন কর্মকর্তা কর্মচারী। অতিথি ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগুন লাগার পর আমরা কোনভাবে ছাদে এসে পাশের আহমেদ টাওয়ার দিয়ে বের হয়েছি। খুব ধোঁয়া ছিল। কে বের হতে পারল সেটিও দেখতে পাচ্ছিলাম না। কোনভাবে হাতড়ে হাতড়ে ৮ তলা থেকে ২৩ তলায় যাই। এর আগে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই স্বামীর ছবি নিয়ে ঘটনাস্থলে তাকে খুঁজছিলেন স্ত্রী রাবেয়া খাতুন। যাকে পাচ্ছিলেন তার কাছেই স্বামীর সন্ধান করছিলেন তিনি। তানজির সিদ্দিক আবীর এফ আর টাওয়ারের ১৪ তলায় মিকা সিকিউরিটিস লি. কোম্পানিতে কর্মরত ছিল। বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় বনানীর এফআর টাওয়ারের ১৬ তলা থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করেছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। পরে তার লাশ সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়। আগুন লাগার পর দুপুর ১টার দিকে চাচি শামিমা বেগম কাছে মোবাইল আবীর জানান, ধোঁয়ার জন্য কিছুই দেখছি না বস, আমাকে বাঁচান। এ সময় শামীমা আবীরকে বলেছিল, তুমি নিচে আসতে পারবে না, উপরে চলে যাও। সে ফোন ধরেই বলছিল ধোঁয়ার জন্য কিছুই দেখছি না। বস বলে আর কোন কথা বলেনি সে। এভাবে কথাগুলো বলছিলেন তার চাচি শামিমা বেগম। নিহত আবীর লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম পৌর শহরের আবু বকর সিদ্দিক বাচ্ছু মিয়ার ছেলে। তার মা তামান্না একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে ছোট।
×