এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ ইয়াবার স্বর্গরাজ্য খ্যাত টেকনাফের দুর্নাম ঘুচাচ্ছে আইনশৃঙ্খলারক্ষা বাহিনীর সদস্য ও স্থানীয়রা। প্রশাসনের লোকজন যেমন মাদক কারবারিদের ধরছে, তেমনি স্থানীয়রাও এখন ইয়াবা কারবারিদের ঘৃণা করতে শিখেছে। ইয়াবা কারবারির মনে ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ইয়াবা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বর্তমানে একটি নতুন আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কারণে ইয়াবা কারবার স¤পূর্ণ রূপে বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, কক্সবাজার জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে র্যাব, বিজিবি, পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও কোস্টগার্ড সদস্যরা দিনরাত নিরলস তৎপরতা চালানোর কারণে চোরাচালানিদের মনে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করার সফলতা অর্জন করেছে। সচেতন মহল বলেন, একটি ইয়াবার চালান উদ্ধারের চাইতে ওই চোরাচালানির মনে ভীতি সঞ্চার ও প্রশাসনকে তোয়াক্কা করার মানসিকতা সৃষ্টি করাই হচ্ছে উত্তম কাজ। যে আতঙ্ক টেকনাফের সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে বর্তমানে বয়ে চলেছে। স্থানীয়রা বলেন, গত বছর থেকে পৃথক পৃথক সময়ে মাদক রোধে অভিযানে আইনশৃঙ্খলারক্ষা বাহিনীর সঙ্গে অথবা ভাগবাটোয়ারায় বনিবনা না হয়ে নিজেদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছে ইয়াবা কারবারিরা। তারা নিশ্চয় সীমান্ত এলাকার কারও না কারও সন্তান। কারও স্বামী, কারও ভাই অথবা অনেকের স্বজন। মাদকের জন্য তারা নিহত হচ্ছে নিজের দেশে। অথচ ওই মাদকের চালানের টাকার বান্ডিলগুলো চলে যাচ্ছে মিয়ানমারে। টেকনাফে সীমান্তের ইয়াবা কারবারিরা চালান আনতে না যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের ডেকে নিয়ে চালান পৌঁছাচ্ছে মিয়ানমারের মাদক কারবারিরা। শুক্রবার ভোরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সদস্যদের হাতে ইয়াবার চালানসহ আটক হয়েছে ২৩ রোহিঙ্গা। এদের সন্দেহ না করার জন্য নৌকায় শিশুদেরও সঙ্গে রাখা হয়েছিল। রোহিঙ্গারা পেটে ভরে ইয়াবার চালান আনছিল মিয়ানমার থেকে। শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত অন্তত ৩০ হাজার ইয়াবা জব্দ করতে সক্ষম হয়েছে অভিযান পরিচালনাকারী দল। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক সুমেন ম-ল শুক্রবার বিকেলে বলেন, রোহিঙ্গারা পেটে ভরে ইয়াবার চালান নিয়ে আসছিল ওপার থেকে। শুক্রবার সকালে টেকনাফের হ্নীলা চৌধুরীপাড়া এলাকা থেকে ২৩ রোহিঙ্গাকে আটক করে নিয়ে আসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সদস্যরা। টয়লেটে নিয়ে ক্রমান্বয়ে তাদের পেট থেকে ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদও করা হচ্ছে তাদের। এদের মধ্যে যারা জড়িত নয়, তাদের ছেড়ে দিয়ে ইয়াবা সম্পৃক্তায় যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কক্সবাজারের এ কর্মকর্তা।
সূত্র মতে, ইয়াবার কারণে দেশের যুব সমাজ ধ্বংস হচ্ছে দেখে সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। টেকনাফের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি অভিযান অব্যাহত রেখেছে প্রশাসন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের তৎপরতায় ঠিকে থাকতে না পেরে বহু গডফাদার বাড়িঘর ফেলে গা ঢাকা দিয়েছে। অনেকে আবার পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। বর্তমানে টেকনাফ এলাকায় ইয়াবার বিরুদ্ধে গণসচেনতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। এক সময় ইয়াবা কারবারিদের কালো টাকার বাহাদুরিতে গরম ছিল টেকনাফ সীমান্ত শহর। ইয়াবা গডফাদার যে হাটে-বাজারে বা দোকানপাটে বসত, আসন ছেড়ে দিতে বাধ্য হতেন স্থানীয়রা। এমন এক সময় অতিবাহিত হয়েছে, যখন ইয়াবা গডফাদারদের বিরুদ্ধে টুশব্দও করা যেত না। সেখানে এখন ‘মাদককে না বলুন’ মাদক থেকে দূরে থাকুন’ স্লোগানে মাদকবিরোধী র্যালি ও সমাবেশ করে চলেছে টেকনাফের জনগণ। শুক্রবার বেলা ১১টায় টেকনাফ সদর পলানপাড়া স্কুলের হলরুমে ইয়াবা বিরোধী সমাবেশ ও র্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে। মেম্বার আজিম উল্লাহ আজিমের আয়োজনে নুরুল আবছারের পরিচালনায় টেকনাফ সাংবাদিক ইউনিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম সাইফী, নুরুল হোসাইন, ছাত্রলীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন, মোহাম্মদ সেলিম, বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোঃ আমিন, অর্জুন দাশ, শ্রমিক নেতা জাহেদ হোসেন, শাহাব মিয়া, নুরুল ইসলাম, আবদুল হাই প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। বক্তারা বলেন, মাদক সমাজকে ধ্বংস করছে। মাদকের টাকা হারাম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে কোন মাদক ব্যবসায়ী পার পাবে না। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে, মাদক নির্মূল শুধু প্রশাসনের একা দায়িত্ব নয়, সকলের দায়িত্ব। উখিয়া টেকনাফে আত্রিত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে গিয়ে প্রতিদিন ইয়াবার চালান নিয়ে আসছে। ইয়াবার চালান নিয়ে আসার সময় বুধবার ভোরে টেকনাফের নাফ নদীতে বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুই রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। ওসময় উদ্ধার করা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার ইয়াবা ও বন্দুক। দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা চেনাজানা জায়গা হিসেবে রাখাইন রাজ্যে গিয়ে ইয়াবার চালান আনছে দেশে। পরে বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে চলেছে। বৃহস্পতিবার ভোরে চাঁদপুর শহরের কাঁচাকলোনি এলাকা থেকে এক হাজার ইয়াবাসহ দুই রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ। টেকনাফে শুক্রবার ভোরে ইয়াবার চালানসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সদস্যদের হাতে আটক হয়েছে ২৩ রোহিঙ্গা।
সচেতন মহল বলেন, প্রশাসনের তৎপরতায় ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে মাদক কারবারিরা যদি ইয়াবার চালান আনা বন্ধ করতে পারে, তাহলে রোহিঙ্গারা কেন মিয়ানমারে যাবে-আসবে? যে সব সেনা-পুলিশের অত্যাচারে রোহিঙ্গারা রাখাইনে ঠিকতে পারেনি, ওইসব সেনা-বিজিপির সহযোগিতা নিয়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইনে গিয়ে ইয়াবার চালান নিয়ে এসে আশ্রয় নেয়া অঞ্চলটিকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে।
তাই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চল থেকে দূরে ভাসানচরে স্থানান্তর করার দাবি জানিয়েছেন। আশ্রয় স্থলগুলো মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় রোহিঙ্গাদের কারণে নানা সমস্যায় ভুগছে স্থানীয়রা। ভবিষ্যতেও নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই কালবিলম্ব না করে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর প্রক্রিয়া দ্রুত বাস্তবায়ন করা হোক।