ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

’৬৯-এর একটি স্মৃতি ॥ গোলটেবিল বৈঠক থেকে ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ১১:৪২, ২৯ মার্চ ২০১৯

’৬৯-এর একটি স্মৃতি ॥ গোলটেবিল বৈঠক থেকে ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধু

ছাত্র জনতার তীব্র আন্দোলন পাকিস্তানের উভয় অংশেই দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত থাকায় শক্তিশালী একনায়ক আইয়ুব খান বুঝতে পারলেন প্রেসিডেন্ট পদে তার পক্ষে আর থাকা সম্ভব নয়। ক্ষমতা তাকে ছাড়তেই হবে। পুরো আন্দোলনের মর্মকথা ছিল আইয়ুব খানের পদত্যাগ ও দেশে সত্যিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন। ’৬৯-এর আন্দোলন’ নামে পরিচিত এই আন্দোলন অবশ্য প্রথমে শুরু হয় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে ১৯৬৮-এর দ্বিতীয়ার্ধে। আমাদের অংশে, পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন সময়ে সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল ঠিকই। কিন্তু এই আন্দোলন সুস্পষ্ট চেহারায় রূপ নেয় ১৯৬৯ এর প্রথম দিকে। তখন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানে এই আন্দোলন যুগপদভাবে চলতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানে এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল আইয়ুবের পদত্যাগ ও একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দাবিতে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। এই আন্দোলনের পক্ষের দাবি নামায় ছিল ছাত্র সমাজের প্রণয়নকৃত ১১ দফা। এই এগারো দফায় আইয়ুবের পদত্যাগ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন, শোষণ-নির্যাতন বন্ধ এবং সর্বোপরি আগরতলা ‘ষড়যন্ত্র’ মামলা বাতিল ও শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল। ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে ভূষিত করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে তাকে মুক্ত নাগরিক হিসেবে জেলখানা থেকে মুক্তি দেয়ার পর। ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে রেসকোর্সে এক বিরাট ছাত্র জনসভায় তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়ার কথা ঘোষণা করেন তৎকালীন ‘ডাকসু’র সহসভাপতি এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক তোফায়েল আহমেদ। পূর্বে বিভিন্ন সময়ে তাকে ‘বঙ্গশার্দূল’ বলে অভিহিত করা হতো। ঢাকা শহরেও কোন জনসভায় তার উপস্থিতির কথা থাকলে শহরব্যাপী মাইকিংয়ে তাকে বঙ্গশার্দূল বলে অভিহিত করা হতো। সাধারণভাবে তিনি ছিলেন মুজিব ভাই। আইয়ুব খান কোন ফর্মুলায় এবং কার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায় এই চিন্তা থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের একটি বৈঠক ডাকেন। পরে অবশ্য জানা যায় আইয়ুবের এই উদ্যোগকে পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু সাময়িক প্রধান কার্যালয় (জিএইচকিউ) সমর্থন করেনি। আমন্ত্রিত হয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বৈঠকে যোগদানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। তবে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ‘ন্যাপ’ ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি বৈঠকে যোগদান থেকে বিরত ছিলেন। আইয়ুব কর্তৃক আহূত এই বৈঠকটিই রাওয়ালপিন্ডি গোলটেবিল বৈঠক নামে পরিচিত হয়। গোলটেবিল বৈঠকের ঘোষণা চলমান আন্দোলনকে পাকিস্তানের পূর্ব অংশে স্তিমিত করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু তখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত প্রধান আসামি। তার মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন চলছে। গোলটেবিল বৈঠকে তার অংশগ্রহণ ছাড়া বৈঠকটি আদৌ সফল হবে কিনা এই প্রশ্নটি রাজনৈতিক সচেতন জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সবার মুখেই ছিল। তিনি যে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বৈঠকে যোগদান করবেন না এটা নিশ্চিত ছিল। একজন মুক্ত নাগরিক হিসেবে বৈঠকে যোগদানের প্রধান বাধা ছিল তার বিরুদ্ধে রুজুকৃত মামলা। এই মামলার কার্যক্রম তখন ঢাকার সামরিক ছাউনিতে চলছিল। প্রবল গণআন্দোলনের কাছে আইয়ুব খানকে শেষপর্যন্ত মাথানত করতে হয়। তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা উঠিয়ে নিতে বাধ্য হন। বঙ্গবন্ধু এবং মামলার অন্যান্য অভিযুক্ত আসামিদের সবাই মুক্তিলাভ করেন। অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক মামলা চলাকালীন অবস্থায় ক্যান্টনমেন্ট সেনাবাহিনীর এক পাহারাদারের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। তার এ অস্বাভাবিক মৃত্যু চলমান আন্দোলনকে অধিকতর তীব্র করেছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তিলাভের পর বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) বিপুল সংবর্ধনা দেয়া হয় ছাত্র জনতার পক্ষ থেকে। গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে রাওয়ালপিন্ডিতে যাওয়ার আগে তার বক্তব্য ছিল বৈঠকে যোগ দেব, সেখানে ৬ দফা সংবলিত ১১ দফা দাবি তুলে ধরে তা আদায়ের চেষ্টা করব। দাবি মানা না হলে বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসব, আবার আন্দোলনে যাব। বঙ্গবন্ধুর গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের সিদ্ধান্ত দু-একটি রাজনৈতিক দল/গ্রুপ বিরোধিতা করেছিল। প্রয়োজনীয় সব প্রকার প্রস্তুতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু অন্যান্য সহকারী, উপদেষ্টা নিয়ে (সম্ভবত ২০ জন) রাওয়ালপিন্ডির উদ্দেশে রওনা হন পিআইএর বিমানে। তারিখটি ছিল সম্ভবত ২৪ ফেব্রুয়ারি। ২৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয় এবং আইয়ুব খান তার বক্তব্য রাখেন। এই বৈঠকটিকে বলা হয়েছিল প্রাথমিক বৈঠক। এই বৈঠক একদিনের জন্য হয়ে মুলতবী হয়ে যায়। আসল বৈঠক শুরু হয় মার্চ মাসের ১০ তারিখে। এই বৈঠকে যোগদানের জন্য বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে রওনা হন সম্ভবত মার্চ মাসের ৬ তারিখে (সময় সঠিক মনে নেই)। ছাত্রলীগের নেতৃত্বের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে তেজগাঁও বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু ও তার টিমকে ‘সি অফ’ করার জন্য যেতে হয়েছিল। ঢাকা শহর ছাত্রলীগ ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের প্রায় সবাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। চলবে... লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×