ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অগ্নিকান্ডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জানমালের ক্ষতি

প্রকাশিত: ১১:০৮, ২৯ মার্চ ২০১৯

 অগ্নিকান্ডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জানমালের ক্ষতি

নিখিল মানখিন ॥ রাজধানী ঢাকায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার ভয়াবহতা বিশেষ করে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন মার্কেট, অফিস, হাসপাতাল থেকে শুরু করে সব ধরনের ভবনে প্রায়ই ঘটছে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘন ঘন অগ্নিকান্ডের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে রাজধানীবাসী। বড় ধরনের অগ্নিকান্ড ঘটলে জরুরীভিত্তিতে আগুন নেভানো বা নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যবস্থাও বেশ দুর্বল। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে সারাদেশের চেয়ে রাজধানী ঢাকাতেই বেশি অগ্নিকান্ড ঘটে বা ঘটছে। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের সব বিভাগ থেকে ঢাকায় অগ্নিকান্ড ঘটনার সংখ্যা ও ক্ষয়-ক্ষতি বেশি। ২০১৮ সালে সারাদেশে ৮ হাজার ৪৬১ আবাসিক ভবনে আগুনের ঘটনা ঘটে। সেগুলোর ২০৮৮ ঢাকায়, চট্টগ্রামে ২৮৫ ও রাজশাহীতে ১১৬। দেশের গার্মেন্টগুলোতে ১৭৩ আগুনের ঘটনা ঘটেছে এর মধ্যে ১১৫ ঢাকায়। শিল্প কারখানায় ১১৩১ আগুনের ঘটনার মধ্যে ৫২৬ ঢাকায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার জনবসতি বেশি। অল্প জায়গায় বেশি মানুষ বসবাস করে। অনেক অপরিকল্পিত ও অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগ রয়েছে। নতুন নতুন ইলেকট্রিক গ্যারেজ, ল্যাপটপ, মোবাইল চার্জারসহ অন্য দাহ্য পদার্থের প্রাপ্যতা বেশি। তাই ঢাকায় অগ্নিকা-সহ অন্যান্য দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি। গত বছরের সব অগ্নিদুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে বিদ্যুতের শর্টসার্কিট থেকে। এর পরই বেশি আগুন লেগেছে চুলা থেকে। শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগেছে প্রায় ৩৭ শতাংশ ক্ষেত্রে। আর চুলা থেকে আগুন লেগেছে ২৩.৪ শতাংশ। চলতি বছরে ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলা থেকেই চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত ঘটেছিল। আগুন ভয়াবহ হয়ে ওঠার জন্য ওই ভবনটির দ্বিতীয় তলায় থাকা দাহ্য প্রসাধনী ও অন্য সামগ্রীর বিপুল মজুদ সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) তদন্ত প্রতিবেদনে এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , গাড়ির বা রেস্তরাঁর গ্যাস সিলিন্ডার নয়, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার বৈদ্যুতিক সুইচ অন করার সময় স্ফূলিঙ্গ থেকে বা অনবধানবশত জ্বালানো আগুন থেকে এই অগ্নিকান্ড ঘটে। আইইবির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মনজুর মোর্শেদ বলেন, আমরা শতভাগ নিশ্চিত এটা কেমিক্যাল থেকে সৃষ্টি হয়েছে, অন্য কিছু নয়। অন্য কিছু হলে নিচে থেকে আগুন আসত। নিচে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ বা সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়নি। সবকিছুই ঠিক ছিল। গত ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে যে পাঁচটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থা ওয়াহেদ ম্যানশনের। ওই অগ্নিকান্ডে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭১ জনে, আহত হয়েছেন অর্ধ শতাধিক। ২০১৮ সালে রিপোর্ট অনুযায়ী গত ৫ বছরে শিল্পে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ২৩২টি। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার কোটি টাকার মতো। তবে ক্ষয়ক্ষতির যে পরিমাণ দেয়া হয়েছে বাস্তবে তার পরিমাণ অনেক বেশি হবে বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা। অগ্নিকান্ডের স্থানে ওয়াসার পানির প্রাপ্যতা নেই। দেশের বিদ্যমান ফায়ার স্টেশনেও রয়েছে জনবল ও যন্ত্রপাতির সঙ্কট। ফলে বিলম্বে পৌঁছাতে হয় অগ্নিকান্ডের শিকার শিল্পকারখানায়, আবাসিক এলাকার বিভিন্ন ভবনে এবং বিভিন্ন শপিংমলে। ফলে অগ্নিদুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি তেমন কমাতে পারছে না ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। ২০১২ সালে ২৪ নবেম্বর তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ১১১ নিহত হন। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীর নবাব কাটারায় রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহত হন নারী ও শিশুসহ ১২৪ জন নিহত হন। ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ বসুন্ধরা সিটির আগুন। ওই আগুনে প্রাণহানির তেমন কোন ঘটনা না ঘটলেও পুরো ঢাকা শহরকে এ ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল তীব্রভাবে। ২০১২ সালে গরীব এ্যান্ড গরীব গার্মেন্টসে লাগা আগুনে নিহত হন ২১ জন। এছাড়া হামীম গ্রুপের অগ্নিকান্ডে ২৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালের ২৮ জুন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে স্মার্ট এক্সপোর্ট গার্মেন্টস লিমিটেডে আগুনে পুড়ে ৭ নারী পোশাক শ্রমিক নিহত হন। ২০০৫ সালের এপ্রিলে স্পেকট্রামে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ৬৪ শ্রমিক নিহত হন। আহত হন প্রায় ৮০ জন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অগ্নিকা- কখন ঘটবে সে বিষয়টি অনুমান করার উপায় নেই। তবে সচেতন হলে দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও তার ইত্যাদি ব্যবহারের সময় পণ্যমান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। বাড়িঘর ও কলকারখানায় অগ্নিনির্বাপকের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কোথাও আগুন লাগলে সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসকে জানালেও প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব। ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির কারণে বড় অগ্নিকান্ড সবার দৃষ্টি কাড়লেও প্রকৃতপক্ষে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও আগুনের ঘটনা ঘটছে। বৈদ্যুতিক ত্রুটির পাশাপাশি সিগারেটের আগুন, গ্যাসের চুলা, গ্যাস সিলিন্ডার, রাসায়নিক দ্রব্য, বিস্ফোরণ, আগুন নিয়ে খেলা ও অসতর্কতাসহ নানা কারণে ঘটছে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। অগ্নিকান্ডে বিপুল সংখ্যক মানুষের হতাহতের ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি ভস্মীভূত হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক সেফটি এ্যান্ড সিকিউরিটি এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোতাহার হোসেন বলেন, অগ্নিকান্ডের ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। আগে বেশির ভাগ আগুনই শর্টসার্কিটের মাধ্যমে শুরু হতো। এরপর তা পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু এখন বিস্ফোরণের মাধ্যমে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। বাসাবাড়ি, অফিস, যানবাহন সব জায়গায় আমরা গ্যাসভর্তি সিলিন্ডার নিয়ে চলাফেরা করছি। এর ফলে খুব অল্প সময়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। আগের তুলনায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হচ্ছে। আমাদের অনেক ভবনে ধোঁয়া শনাক্তকরণ যন্ত্র নেই। পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রও নেই। অনেক ভবনে মেয়াদ উত্তীর্ণ অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ঝুলতে দেখা যায়। অনেক সময় এই যন্ত্রগুলো অব্যবহৃত থেকে যায়। আমরা মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার আগে যন্ত্রটি দিয়ে ড্রিল করে দেখতে পারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম নুরুল আমিন বলেন, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় শিল্প-কারখানা থাকলে সেখানে কেমিক্যাল থাকাই স্বাভাবিক। আর এসবে কিছু ফ্লেভার আইটেম থাকে যা আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে সহায়তা করে। আর গ্যাস সিলিন্ডারের লিক থেকে অহরহই ঘটে দুর্ঘটনা। উন্নত দেশে তাৎক্ষণিকভাবে আগুন প্রতিরোধের সব যন্ত্রপাতি পর্যাপ্ত থাকলেও আমাদের দেশে তা নেই। আগুন লাগার পর মনে হয় এটা দরকার, যা তখন পাওয়া যায় না। আর আগুন লাগার পর প্রাথমিক ব্যবস্থাগুলোও আমাদের জানা নেই।
×