ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

‘ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে বাঁচব কিনা জানি না’

প্রকাশিত: ১১:০৪, ২৯ মার্চ ২০১৯

 ‘ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে বাঁচব কিনা জানি না’

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। ওপরে উঠতে পারছি না। আমরা ১৫ জন আটকে পড়েছি। বাঁচব কিনা জানি না, দোয়া কর। এই বলে মোবাইলে কান্নাকাটি করছিলেন ওই ভবনে আটকে পড়া আবদুস সালাম নামে এক ব্যক্তি। বিকেল পৌনে ৩টায় বাবুল নামে এক স্বজনকে এভাবে আকুতি জানাচ্ছিলেন তিনি। বাবুল বললেন, একটু আগে পর্যন্ত মোবাইল ফোনে কথা বলছিলাম। কিন্তু এখন আর নেটওয়ার্ক পাচ্ছি না। জানি না ওরা বাঁচবে কিনা। এভাবে মৃত্যুর খুব কাছাকাছি অবস্থান করছেন ভবনে আটকে পড়া বহু নারী, পুরুষ ও শিশু। কেউ ফেসবুক লাইফে স্বজনদের জানাচ্ছে তাদের অবস্থান। কেউ কেউ ধোঁয়ায় দম বন্ধ হওয়ার আগে বাঁচার জন্য বহুতল ভবন থেকে লাফ দেন। রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের ১৭ নম্বর রোডের ২২ তলাবিশিষ্ট এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের সময় ওই ভবনের ১২তলা ভবনে আটকে পড়া আইটি ইঞ্জিনিয়ার ফাহাদ ইবনে কবির তার মা’কে মোবাইলে জানান, ভেতরে ধোঁয়ায় তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তিনি দম নিতে পারছেন না। ছেলের সঙ্গে কথা বলার পরপরই মা ফরিদা ইয়াসমিন ছুটে আসেন এফ আর টাওয়ারের নিচে। তখন বিকেল ৩টা। ফরিদা ইয়াসমিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, এক ঘণ্টা আগে ছেলে ফাহাদের সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়েছিল। এখন মোবাইল ফোন বন্ধ। বার বার বাঁচার আকুতি করছিল আমার বাছাধন ফরহাদ। এফ আর টাওয়ারের সামনে ফরিদা ইয়াসমিন বার বার বিলাপ করছিলেন, আমার ছেলেকে বাঁচান। ছেলের সঙ্গে এক ঘণ্টা আগেও আমার কথা হয়েছে। এখন তার মুঠোফোন বন্ধ পাচ্ছি। জানি না ছেলের ভাগ্যে কি ঘটেছে। তিনি জানান, তার ছেলে ১২ তলায় ডাট গ্রুপে কাজ করতেন। তিনি সেখানকার আইটি ইঞ্জিনিয়ার। ছেলের সঙ্গে বনানীতে থাকেন। তাদের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার ভবানীপুরে। দুই ভাইয়ের মধ্যে ফাহাদ ছোট। ষাটোর্ধ কমলা বেগম বার বার বিলাপ করছিল, আমার ছেলে বাইচা আছে না কি মইরা গেছে কিচ্ছু জানি না। আমার ছেলেকে জীবিত উদ্ধার করে দাও। এক ঘণ্টা ধরে ছেলে রুবেলের মোবাইল ফোন বন্ধ। ‘য্যামনে পারেন আমার ছেলেকে জীবিত ফেরত দ্যান।’ এভাবে ছেলেকে ফিরে পেতে আহাজারি করছিলেন কমলা বেগম। আগুন লাগা এফআর টাওয়ারের ১৪ তলায় একটি অফিসে পিয়নের কাজ করেন ছেলে রুবেল। আগুন লাগার পর ছেলে আত্মীয়দের সঙ্গে ফোনে কথা বলে বাঁচার আকুতি জানিয়েছিলেন। এক ঘণ্টা ধরে ছেলে রুবেলের মোবাইল বন্ধ। টিভিতে আগুন লাগার সংবাদ দেখে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন রুবেলের মা ও তার চাচা মোঃ আব্দুল্লাহ। ভবনটির নিচ থেকে রুবেলের খোঁজ করছিলেন তারা। আব্দুল্লাহ বলেন, সকাল ৯টায় নাস্তা করে নতুন বাজারের বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশে বেরিয়ে যায় ভাতিজা রুবেল। এরপর দুপুরে তারা ভবনটিতে আগুন লাগার খবর পান। এরপরই রুবেলের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন তারা। রুবেল ফোনে বাঁচার আকুতি জানিয়েছিল। কিন্তু ঘণ্টাখানেক হলো তার ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তারা জানেন না রুবেল বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে। এদিকে দুপুরে ভাইয়ের খোঁজে এফ আর টাওয়ার নিচে ছুটে আসেন লিপি। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, ভাই আনজিল ওই ভবনের ১৫ তলায় মাইকা সিকিউরিটিজ হাউসে কাজ করতেন। আগুন লাগার পর বেলা ১টার দিকে ভাই আনজিলের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছে। এরপর থেকে আনজিলের ব্যবহৃত ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এখনও ভাইকে খুঁজে পাচ্ছি না। আপনারা ফায়ার সার্ভিসকে বলুন, আমার ভাই আনজিলকে উদ্ধার করে দিতে। অন্যদিকে বিকেলে বনানীর এফ আর টাওয়ার থেকে হাসনাইন আহমেদ রিপন নামে এক যুবককে উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এর আগে দুপুরে এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার পরে ১৪ তলা ভবনের ভেতর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সবাইকে বিদায় জানিয়ে দুইটি পোস্ট দেন রিপন। ফেসবুকে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ঘরের মধ্যে সেলফিসহ দেয়া এক পোস্টে রিপন প্রিয়জনদের ‘বিদায়’ জানিয়ে লেখেন, ‘মা, মিনা, মিলন, আপু, ফাহিম ভাই সবাই আমারে মাফ করে দিস। আগুন ঋজ ঞড়বিৎ ষরভঃ ১৩’ এর আগে অপর এক পোস্টে আরেকটি সেলফি পোস্ট করে রিপন লেখেন, আগুন আগুন, এটা শেষ পোস্ট হতে পারে। প্লিজ ফরগিভ মি (ঋজ ঞড়বিৎ খরভঃ ১৩)। পরে বিকেলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ক্রেনের সাহায্যে ভেতরে থাকা অনেককে উদ্ধার করে বিল্ডিং থেকে। তাদের একজনের মধ্যেই রিপন ছিল জানিয়েছে রিপনের বন্ধুরা। রিপনের ফেসবুক বন্ধুরাও সেই পোস্টেই রিপনের উদ্ধার হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। রিপনের পরিচিত মমিনুল ইসলাম বলেন, তিনি (রিপন) সুস্থ আছেন। বর্তমানে ইউনাইটেড হাসপাতালে তার প্রাথমিক চিকিৎসা চলছে। বিকেল ৪টার দিকে বনানীর এফ আর টাওয়ার থেকে ২৭ জনকে ক্রেনের মাধ্যমে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার করেন। তাদের মধ্যে এক নারী জানান, ভেতরে অনেক মানুষ রয়েছে। তিনি জানান, ভেতরে ধোঁয়ায় অনেকের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমারও একই পরিণতি হয়েছিল। একই সময় ফায়ার সার্ভিসের ক্রেনে করে নেমে আসেন আরিফ। এরপরই স্ত্রী স্বপ্নাকে মোবাইলে কল করেন। ‘স্বপ্না আমি বাইচ্যা আছি।’ ক্রেন দিয়া নাইমা আসছি। তুমি এদিকে আসো। ফুটপাতে বসে মোবাইল ফোনে এসব কথা বলছিলেন আরিফ। তিনি ১৩ তলায় ডার্ড গ্রুপের ম্যানেজার অডিট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আরিফ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে জানান, ভাই আল্লাহ রহমতে বেঁচে ফিরে এসেছি। তিনি বলেন, আগুন লাগার সময় আমাদের অফিসে ৭-৮ জন ছিলাম। আমরা পাঁচবার সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ধোঁয়া আর আগুনের তাপের কারণে নামা যাচ্ছিল না। চারদিকে অন্ধকার ছিল। আমরা আবার দৌড়ে অফিসের ভেতরে ঢুকে যাই। আরিফ জানান, বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। অফিসের গামছা আর তোয়ালে ভিজিয়ে মুখের ওপর ধরে রেখেছি সবাই। আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়ত বাঁচতাম না। একপর্যায়ে অফিসের সামনের গ্লাস ভেঙ্গে হাতে ইশারা করতে থাকলে ফায়ার সার্ভিসের ক্রেন জানালার কাছে যায়। তারপর ক্রেন দিয়ে প্রথমে আমি আর ইকবাল নেমে আসি। অন্যরা পরে নামতে পেরেছে কিনা তা বলতে পারছি না। এর কিছুক্ষণ পর বনানীর স্টার কাবারের পাশে ফুটপাতে ছুটে আসেন আরিফের স্ত্রী স্বপ্না। দু’জন একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছিল। এই দম্পতির কান্নায় সেখানকার শত শত মানুষের চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। পরে পরিবার ও সহকর্মীরা পরে তাকে নিয়ে চলে যান। বাশার নামে আরেক ব্যক্তি জানান, তার অফিস ছিল ১৯ তলায়। তিনি ছাদে গিয়ে পাশের ভবনে চলে যান। পরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসেন। উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে রাজধানীর বনানীর ১৭ নম্বর রোডের এফ আর টাওয়ারের ৯ তলা থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কন্ট্রোল রুমের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এনায়েত হোসেন।
×