ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জোবায়ের রাজু

দুজনে

প্রকাশিত: ০৯:৫৫, ২৯ মার্চ ২০১৯

 দুজনে

আলট্রাসনোগ্রাফিতে জানা গেছে মৌমিতা ছেলে সন্তানের মা হবে। তার গর্ভধারণের বয়স সাত মাস। অনাগত সন্তানটি আসার আরও তিন মাস বাকি। মৌমিতা মনে মনে কন্যা সন্তান কামনা করেছে। কিন্তু আল্লাহ তার মনের ইচ্ছা পূরণ করছেন না দেখে অবশ্য খারাপ লাগছে না। সে মনে মনে মেয়ের নামও ঠিক করেছে। মীম। এই নামটির প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা। আরবী একটি নামের হরফের কারণে না, কি কারণে ঠিক বুঝতে পারছে না। আপন গর্ভে বেড়ে উঠা অনাগত কল্পনার মেয়ে মীমের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কথা বলে মৌমিতা। মেয়ের তুলতুলে গালে কল্পনায় চুমোও খায়। ছেলে সন্তার চাই বা মেয়ে সন্তান চাই- এই নিয়ে ফারদিনের কোন আশা নিরাশা নেই। আল্লাহ তার স্ত্রী মৌমিতার গর্ভে যে সন্তানই দেবে, সে খুশি হবে। মৌমিতা যখন প্রথম তাকে শুভ সংবাদটি দেয়, খুশিতে সারা রাত পাগলের মতো আচরণ করেছে। কিসের এক অতৃপ্ত আনন্দে সে মৌমিতাকে বার বার প্রশ্ন করেছে ‘সত্যি কি আমি বাবা হব?’ স্বামীর এমন পাগলামী দেখে মৌমিতা মিটি মিটি হাসলেও কেন জানি লজ্জায় রক্তি হয়ে উঠেছে। তিন বছর আগে মৌমিতা আর ফারদিনের বিয়ে হয়েছে। বিয়েটা পারিবারিকভাবে। মৌমিতা বিত্তবান বাবার পালিতা মেয়ে। আজাদ রহমানের স্ত্রী রোকসানা বেগম সড়ক দুর্ঘটনায় তলপেটে প্রচন্ড ভাবে ব্যথা পাবার পর ডাক্তারি চিকিৎসায় সুফল পেলেও ডাক্তার একটি খারাপ সংবাদ জানায়, রোকসানা বেগম আর মা হতে পারবেন না। তার সে ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। এই ঘটনায় প্রথম প্রথম আজাদ রহমানের খারাপ লাগলেও পরে সেটাকে ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছেন তিনি। পরে তার বন্ধু সেলিম খন্দকারের কাছ থেকে একটি কন্যা দত্তক নেন আজাদ রহমান। সেই কন্যাই হচ্ছে মৌমিতা। আজাদ রহমান বাবার মমতায় বড় করে তোলেন মৌমিতাকে। বিয়ের বয়স হবার পর যখন মৌমিতার জন্য জোয়ারের মতো চারদিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে, তখনই আজাদ রহমান সিদ্ধান্ত নেন মেয়েকে তিনি সুপাত্রে পাত্রস্থ করবেন। শুধু কেবল ছেলে পছন্দ হয়নি বলে অনেক ভাল ভাল ঘরের প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। পাশের পাড়ার নুরুল হুদা মাস্টারের ছেলে ফারদিন। এই ছেলেকে আগ থেকে চিনতেন আজাদ রহমান। সৎ ছেলে হিসেবে দশ গেরামে ফারদিনের নাম ডাক। পৃথিবীর যেন সমস্ত রূপ নিয়ে জন্মেছে ফারদিন। ফারদিনের জন্মের পর পুরো গাঁয়ে খবর হয়ে গেছে, নুরুল হুদার ঘরে আল্লাহ একখানা চাঁদ দিয়েছেন। ছাত্র হিসেবে ফারদিন স্কুল কলেজে সুখ্যাতি অর্জন করে। আজাদ রহমান ফারদিনকে ভালভাবে চিনতেন বলে মনে মনে পছন্দও করতেন। মেয়ে মৌমিতার বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকার পর হঠাৎ করে ফারদিনের কথা মনে হলো আজাদ রহমানের। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মেয়েকে এই ছেলের হাতেই দান করবেন। নুরুল হুদা মাস্টার আজাদ রহমানের প্রস্তাবে এক বাক্যে রাজি হলেন। ফারদিনও বাবার সিদ্ধান্তে দ্বিমত করেনি। এক শুভ দিনের মৌমিতার আর ফারদিনের বিয়ে হয়। ২. মৌমিতা পুত্র সন্তানের মা হয়েছে। সব চেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন নুরুল হুদা মাস্টার। মিষ্টি বিতরণে তিনি বেশ দেখার মতো ভূমিকা পালন করলেন। নিজেই নাতির নাম রেখেছেন তামিম। পুত্রের জন্মের পর যেন ভাগ্যটাও ঘুরে উঠল ফারদিনের। এক সরকারী ব্যাংকে সে ম্যানেজার পদে নিয়োগ হলো। মাইনে প্রায় পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি। সংসারে যেন সুখের বান এসে গেল। অথচ এক সময় নুরুল হুদা মাস্টারের সংসারে ছিল টানাপোড়নের দুঃসময়। শিক্ষকতা পেশায় অর্জিত টাকা দিয়ে দিন ভালই পার তো হতো না, বরং নিত্য অভাবের সঙ্গে এক ধরনের নীরব সংগ্রাম করতে হতো পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে। সংসারের কর্ণধার পিতার প্রতি কোন অভিযোগ ছিল না ফারদিনের। টিউশনি করে সংসারের বোঝা হাল্কা করার এক আপ্রাণ চেষ্টা ছিল তার। অনেকগুলো টিউশনি করে তখন অবসর পার করত ফারদিন। জীবনের সেই দুর্গম দিন শেষ হয়েছে। না, এখন আর টিউশনি করতে হয় না ফারদিনকে। সে এখন ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এক সন্তানের পিতাও। আরও আছে ঘরে মৌমিতার মতো একজন সুন্দরী স্ত্রী। মৌমিতার এখন সময় কাটে ছেলেকে সঙ্গ দিয়ে। তার সমস্ত চিন্তা চেতনা জুড়ে বাস করে ছেলে তামিম। ঘরের বউ হিসেবে যথেষ্ট সুনাম আছে মৌমিতার। শ্বশুরালয়ের সকলের মন কাড়তে সক্ষম হয়েছে সে। একদিন আলমারির ভেতরে যত্নে ভাঁজ করা ফারদিনের শার্টের পকেট থেকে খসে পড়ে একখানা চিঠি। মেঝে থেকে তুলে এনে মৌমিতা দেখে সেটি একটি প্রেমপত্র। মেয়েলি হাতের লেখায় মোটা মোটা অক্ষরে প্রেমকে অপমান করে ফিরিয়ে দেয়ার আকুল নিবেদন চিঠির লাইনে লাইনে। এ কার চিঠি? চিঠি নিয়ে ফারদিনের মুখোমুখি হয় মৌমিতা। ফারদিন তাকে শোনায় তার জীবনের এক অব্যক্ত গল্প। শুক্লার গল্প। ধনীর মেয়েটি শুক্লাকে জীবন দিয়ে ভালবাসত ফারদিন। কিন্তু শুক্লা ফারদিনের প্রেমকে গ্রহণ করেনি তাদের মতো বিপুল সম্পদের অবস্থা ফারদিনের ছিল না বলে। তবু ফারদিন তার এক তরফা প্রেমের দায় থেকে শুক্লাকে চিঠি পাঠাত। রাগে ক্ষোভে একদিন শুক্লা অপমানের ভাষা দিয়ে ফারদিনকে চিঠি পাঠায়। সে চিঠি পড়ে ফারদিন বেদনাতে জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়। তারপরও সে বেদনাতে জ্বলতে সুখ পেত ফারদিন। প্রেম জিনিসটা এমন বলে। শুক্লার সেই চিঠি যত্নে তুলে রাখে ফারদিন। মাঝে মাঝে বের করে পড়ে আর চোখের জল মুছে। না। জীবন থেমে থাকেনি। সময়ের পরিক্রমায় ফারদিনের জীবনে এসেছে মৌমিতা। শুক্লা আজ কোথায় কে জানে! মৌমিতার মধ্যে ফারদিন আজ খুঁজে নিয়েছে জীবনের ঠিকানা। ফারদিনের কাছে শুক্লার গল্প শুনে মৌমিতার মধ্যে বিপরীত কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বরং বাস্তববাদী মেয়ে বলে সে স্বামীর যৌবন বেলার গল্প শুনে মৃদু হেসেছে। যে চিঠি ফারদিনের কাছে এতদিন ছিল যত্নে তুলে রাখার বস্তু, আজ সে চিঠি সে নিজ হাতে ছিঁড়ে কুচি কুচি করে বাতাসে উড়িয়ে দিল। না, ফারদিন আজ আর না পাওয়ার অতীতে ফিরে যাবে না। তার এখন জীবন জুড়ে কেবল দুজন মানুষ। একজন স্ত্রী, আরেকজন সন্তান। এই তো জীবন।
×