ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জলে ভাসা জলকুমারী

প্রকাশিত: ১১:৪৬, ২৮ মার্চ ২০১৯

জলে ভাসা জলকুমারী

মেধা-ক্ষমতা এবং সামর্থ্যকে জেনে বুঝে একজন সৃজনশীল মানুষ যখন তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে মরমিয়া চেষ্টা চালায় তখন সে হয় অপরের দৃষ্টিতে আকর্ষণীয়। যদি বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে পাড়ে তবে সে হয় দৃষ্টান্ত। আর যদি চেষ্টা এবং স্বঘোষিত সফলতাকে পুঁজি করে নিজেই হয়ে ওঠে দিকভ্রান্ত তবে চিন্তাশীল মানুষের কাছে সে হয়ে ওঠে প্রশ্নবিদ্ধ। অনেকটা সে রকম মরমীয় প্রচেষ্টা, খানিকটা প্রাপ্ত সফলতা এবং সাবজেক্ট অপেক্ষা অবজেক্ট প্রাধান্যের মঞ্চ প্রযোজনা নাটক ‘জলকুমারী’। নাট্যকার-নির্দেশক দেবাশীষ ঘোষ রচিত-নির্দেশিত, দলপ্রধান শামীমা আক্তার মুক্তার নাট্যদল মেঠোপথ থিয়েটার এবং দলপ্রধান প্রদীপ কুমার মাইতির নাট্যদল সহজ পাঠ থিয়েটার যৌথ প্রযোজিত, দুই বাংলার নাট্যকর্মীদের অংশগ্রহণমূলক নাটক জলকুমারী মঞ্চস্থ হলো গত ১৮ মার্চ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে। পরীক্ষার হলরুম নাকি ঘরের ড্রয়িং রুম সেটি পরিষ্কার না হলেও যেটি পরিষ্কার হয় সেটি হলো বেসরকারী বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী সাদিয়া থিসিস পেপার তৈরি করতে যেয়ে থিসিস বিষয়ের সঙ্গে নিজেই খুঁজে পায় নিজের সাদৃশ্য। অর্থাৎ জলকুমারীর সঙ্কট এবং সাদিয়ার সঙ্কট এক এবং অভিন্ন, নারীর জীবনের আলোকে ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার প্রবাহমান ধারায় জন্মই যেন আজন্ম পাপে নিমজ্জিত। সাদিয়ার সঙ্কট নাটকে দৃশ্যমান না হলেও জোনাকী থেকে মেঘকুমারী হয়ে চূড়ান্ত রূপে জলকুমারীতে পর্যাবসিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে বোঝা যায়, প্রবল পৌরষত্বের কাছে নারী বরাবর নির্যাতিত এবং সমাজের মঙ্গল সাধনে তার আত্মহুতি এক রকম নিয়তির মতোই দুলঙ্গনীয়। নাট্যকার দেবীশীষ ঘোষ নাটক রচনা অপেক্ষা সংকলনের মতো চটজলদী পথে দ্রুত হেঁটে যেতে পারলেন বলে চমৎকার ট্রেলার দেখা গেল এবং মূল প্রদর্শনী কি হতে পারে সেটুকু কল্পনা শক্তি দর্শকের আছে বলেই না দেখাকে না দেখেই সে তৃপ্ত হল। নাট্যকার দেবাশীষ ঘোষকে বুঝতে হবে, কেউ একজন শিলাইদহের জাদুঘরে গেল বলেই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কথা নেই বার্তানেই অশরীরে দেখা দিল কিংবা জলকুমারী নিয়ে থিসিস করছে বলেই জলকুমারী ভেসে উঠল ব্যাপারটা এতটা যেমন সহজ না তেমনি আধুনিকতা ও এতটা সেকালে না। বাল্মিকীকে মনোজগতে রামচন্দ্রকে দেখতে একশ’ বছর সাধনার পথ দিয়ে যেতে হয় যেমনিভাবে ডুবরির তুলে আনা গলার চেইনের খবর বিবিসি কিংবা সিএন এনের সংবাদ পরিক্রমার মধ্যে দিয়ে এক সমকালীন বৃদ্ধার চোখ এবং স্মৃতির মধ্যে দিয়ে ডুবন্ত টাইটানিক জাহাজকে জলে ভাষিয়ে তোলা হয়। দ্বিতীয়ত পুরুষের দোষ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেই নারীর প্রতি মমতা বাড়ে না বরং আত্মবিস্মৃত দেওয়ানের নির্মমতা সত্ত্বেও স্ত্রী মদিনার, স্বামী দেওয়ানের প্রতি বিশ^াস-ভালবাসা এবং মমতাই দেওয়ানকে নকল ফেলে আসলের দিকে ধাবিত করে এবং অনুশোচনা-অনুতাপে দগ্ধ করে। অনুরাগী দর্শকশ্রোতা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, তারা দেওয়ানের মতো ভুল পথে যাবে না এবং মদিনার মতো মমতাময়ী নারীদের কিছুতেই পুনঃহারিয়ে যেতে দেবে না। লোকনাট্যের উপকরণে প্রচার ধর্মিতা নেই, উদ্দেশ্য নেই, কৌশল নেই, আছে সরলতা, সহজবোধ্যতা আর মানুষের প্রতি ভালবাসা। নেই ভান আছে প্রজ্ঞা, নেই প্রযুক্তির ঝলকানি আছে নৈসর্গের বারতা, নেই অহমিকা আছে বিনয়ের ফল্গুধারা। আর এত এত আছে বলেই আধুনিক মানুষেরা হিমশিম খাচ্ছে তুলে আনতে ঐতিহ্যের পরম্পরা। পরম্পরায় নাটককে মঞ্চায়নের নির্দেশনায় দেবাশীষ ঘোষ সংকলনের দৃশ্যকল্প নির্মাণে যার পর নাই সফল। শুভাআগমনে পিতার চঞ্চলতা, কন্যা হওয়ায় উন্মাদ দশা, হাবিল-কাবিলের বৈকল্য, কাঠুরিয়ার বৌয়ের জিগাংসা, ঋষির তপস্যা, রাজ কুমারের প্রণয়, জোনাকীর দাম্ভিকতা, মেঘকুমারীর প্রণয় বিহবলতা-বিচ্ছেদে মুষড়ে যাওযা এবং রাজার সুখ নিশ্চিত করতে প্রজাদের জল অন্মেষণে মেঘ কুমারীর আত্মহুতির মধ্যে দিয়ে জলকুমারী হয়ে ওঠা প্রভৃতি প্রাসঙ্গিক, যৌতিক এবং দৃষ্টি নান্দনিক। বিশেষত জলে নিমজ্জিত অংশে কাপড়ের ঢেউ, আবহে জলোচ্ছ্বাস এবং আলোতে আলো-আঁধারির হাতছানি, মঞ্চযাদুকে টপকিয়ে এক বেদনাময় মঞ্চামায়া তৈরি করে।
×