ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

আমরা সিনেমা দেখতে চাই

প্রকাশিত: ১১:৪৪, ২৮ মার্চ ২০১৯

আমরা সিনেমা দেখতে চাই

কখনও জীবনের প্রয়োজনে, কখন মনের তৃষ্ণা মেটাতে দেশের অনেক এলাকায় ঘোরার সুযোগ হয়েছে। প্রতিবারই কিছু না কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞাতা হয়েছে। লেখার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। তার আগে একটুখানি ভূমিকা লিখতে হবে। দেশ। স্বাধীনতা অর্জনের পর শিল্প প্রেমিক রাষ্ট্র নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পছন্দের চিন্তায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা।’ যদিও স্বাধীনতা পূর্ব, পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র নির্মাণে- নির্মম শোষণের হাত থেকে নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতি এবং সৃজনশীলতা রক্ষায় সেই সময়ের ৩৭ বছরের তরুণ মন্ত্রী (শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে) বঙ্গবন্ধু, ১৯৫৭ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্ব বাংলার মানুষ তখন এবং তারও আগে থেকে কলকাতা, বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) হলিউড, করাচী এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র নিয়মিত দেখতে পেত। সে সময়ে সারা বিশ্বের চলচ্চিত্রের সঙ্গে এক রকম পাল্লা দিয়ে নির্মিত হতো দেশীয় চলচ্চিত্র। আব্দুল জব্বার খান, ফতেহ লোহানি, খান আতাউর রহমান এবং জহির রায়হানসহ অন্যরা নিজস্ব চিন্তাধারার চলচ্চিত্র বানিয়ে দর্শকদের সমানে মুগ্ধ করতেন। ৪৭ সালে দেশ ভাগ পরবর্তী সময়ে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানের নির্দয় শোষণ, অত্যাচারে দিশাহীন সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় চলচ্চিত্র ছিল অগণিত মানুষের কাছে এক পেয়ালা সুখের পরশের মতো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জনের পর অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে আমাদের টিকতে হয়েছে কঠিন সংগ্রাম করে। এ সবের মধ্যে দেশের চলচ্চিত্র বহু মানুষকে বার বার আশার তরীতে তুলেছে। স্বপ্ন দেখিয়েছে সুন্দরের... আগামী দিনে সোনালি ফসলের মতো। সত্তর-আশি থেকে নব্বইয়ের শেষ পর্যন্ত আমাদের চলচ্চিত্র ছিল সব শ্রেণীর মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। হাজার হাজার সিনেমা হল, লাখ লাখ দর্শক হলে গিয়ে সিনেমা দেখে মুগ্ধ হতো। কিন্তু, আমাদের এই শিল্পে ঘুন ধরতে শুরু করে নতুন শতাব্দীর শুরু থেকে। আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যেতে থাকে শিল্পের এই সোনালি স্তম্ভ। দিনে দিনে কমতে থাকে সিনেমা এবং হলের সংখ্যা। রুগ্ন হতে শুরু করে এই শিল্প। আধুনিক পৃথিবী, সময়ের স্রোত এবং মানুষের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে আমাদের এই করুন পরিনতি মেনে নিতে হচ্ছে। কেবল যে শুধু সিনেমার বিষয়ের কারণে ব্যর্থ হচ্ছি, তা নয়। সিনেমায় যথাযথ আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রেক্ষাগৃহের অনআধুনিকতা, মিলনাতয়নের পরিবেশ- সব মিলিয়ে আমাদের হল বিমুখ করেছে। তাই বলে কি আমরা সিনেমা দেখা বন্ধ করেছি? মোটেও না! আমরা সিনেমা দেখি, আগের থেকে অনেক বেশিই দেখি। এই প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এখান থেকে বলি, বছর দশেক আগে ঢাকা থেকে দূরবর্তী জেলা কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে বেড়াতে যাবার সুযোগ হয়েছিল। প্রায় সাত দিন ছিলাম ওই এলাকায়। কুড়িগ্রাম, নাগেশ্বরী এবং ভূরুঙ্গামারী এই তিন জায়গাতেই ভালভাবে ঘুরে বেড়াতে পেরেছিলাম। ওখানকার বাজারগুলো অন্যসব এলাকার মতো ইট-পাথরের তৈরি নয়। বেশিরভাগ টিনের ছাউনি এবং কাঠের তক্তায় তৈরি। কুঁড়েঘরের ছাপরার নিচেও দোকান দেখেছি। নিজেও পাড়াগাঁয়ের মানুষ যে কারণে, ছোট থেকে অনেক হাট-বাজারে ঘোরার সুযোগ হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের মাঝামাঝি সময়ে শহর এবং গ্রামের দোকানগুলোতে টেলিভিশন এবং ডিস এন্টিনা সংযোগ মোটামুটি সচরাচর হয়। সময় আরও এগিয়ে গেলে শহর থেকে গ্রামের দোকানগুলোতে টেলিভিশন রাখার সংখ্যা বেড়ে যায়। এই ট্রেন্ড চালু হবার প্রথম থেকেই একটা কমন ব্যাপার দেখেছি আর তা হলো, ‘সব দোকানে ঢাকাই সিনেমা চালিয়ে ক্রেতাদের উৎসাহিত করা।’ সারা দিনের কাজ শেষে সন্ধ্যায় যখন বাজারে মানুষের আনাগোনা বারতে থাকে, দোকানগুলো দিনের অন্য সময়ের থেকে চঞ্চল হয়ে ওঠে। বেশিরভাগ দোকানে- চোখ স্থির রেখে, উষ্ণ চায়ের কাপে ঠোঁট লাগিয়ে বহু মানুষকে হারিয়ে যেতে দেখেছি ঢাকাই সিনেমার রূপালি আলোয়। সেই সঙ্গে দেখেছি সারা দিনের ক্লান্তি ভুলে যেতে। আহা! কি আবেদন-ই না ছিল অতীতের সিনেমার। সময়ের অল্প দূরত্বে সে অধ্যায় এখন ইতিহাস। এখনকার বস্তবতা, গ্রাম-গঞ্জের বাজারে টেলিভিশনের সংখ্যা আগের থেকে কমেনি। কোন কোন জায়গায় দিনে না চালালেও সন্ধ্যায় চলে। কিন্তু ছোট্ট এই বিনোদন বাক্সে এখন আর ঢাকাই সিনেমা চলে না। চলে স্টার জলসা, জি বাংলার সিরিয়াল কিংবা সনি সেটম্যাক্সে তামিল-তেলেগু সিনেমা। কী করবে দোকানি কিংবা সাধারণ মানুষ! তাদের তো বিনোদন চাই। এক জিনিস আর কত। নতুন যা আসছে তা বর্তমান সময়ের সঙ্গে বেমানান! জনসাধারণের রুচির উন্নতি ঘটেছে, দেখার চোখ খুলেছে। তাইতো যে সিনেমা মুক্তি পায় তা জেলা শহর তো দূরের কথা বড় শহরেই পর্দ ওঠে না। কোন কোন জেলায় তো সিনেমা হল-ই নেই। ভাবা যায় কত অল্প সময়ে চোখের সামনে জলজ্যান্ত এই শিল্পটি ডুবতে বসেছে! দিন দিন লোকসান গুনতে গুনতে শেষে এক রকম ক্লান্ত হয়ে হল মালিক সমিতি এবং প্রদর্শক সমিতি সিদান্ত নিয়েছে- এভাবে চলা সম্ভব নয়! হয় বিদেশী সিনেমা হলে চালানোর অনুমুতি দেন, না হয় আসছে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে (১২ এপ্রিল) বাংলাদেশের সব সিনেমা হল বন্ধ করে দেব। বিদেশী সিনেমা চালানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং সংগঠন আগে থেকেই বিরোধিতা করে আসছে। তাদের যুক্তি, বিদেশি সিনেমা চালু হলে দেশীও চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে, চলচ্চিত্র নয় সিনেমা হলের সংস্কার দরকার। দেশের বেশিরভাগ হলে গিয়ে সিনেমা দেখার পরিবেশ নেই। এখন কথা হলো, হলে যখন সিনেমা দেখতে দর্শকই পাওয়া যায় না। তাহলে, পরিবেশ কিভাবে মুখ্য বিষয় হয়। আগে তো দর্শকদের হলে যেতে হবে তারপর না হয় পরিবেশ! বর্তমান সময়ে যেসব সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে তার দর্শক গ্রহণযোগ্যতা সকলেই ভাল যানেন। এমন অবস্থার পরিবর্তন না ঘটিয়ে নতুন করে অর্থ খরচ কারা তাদের কাছে যুক্তিযুক্ত নয়। এই যখন পারস্পারিক অবস্থা তখন আমরা কি দল বেঁধে বড় পর্দায় সিনেমা দেখার কথা ভুলে যাব! অবশ্যই না। আমরা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে চাই! মোবাইলের পাঁচ ইঞ্চি মনিটর কিংবা ল্যাপটপের বার ইঞ্চিতে নয়। শহরের প্রাণকেন্দ্রে বিনোদনের ঘরটি বন্ধ রেখে, আত্মকেন্দ্রিক পন্থায় সিনেমার দর্শক হতে চাই না। দলবলে বড়পর্দায় দেশ-বিদেশের সিনেমা দেখে মুখরিত হতে চাই। প্রতিযোগিতার বিশ্বে নিজেদের প্রমাণ করতে চাই।
×