ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ আরিফুল হক

গণহত্যা ১৯৭১ ॥ শেরপুরের সোহাগপুর

প্রকাশিত: ০৯:০০, ২৮ মার্চ ২০১৯

গণহত্যা ১৯৭১ ॥ শেরপুরের সোহাগপুর

একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটির সদস্যদের সহযোগিতায় দেশের প্রতিটি অঞ্চলে চালায় নির্মম গণহত্যা ও নির্যাতন। পাকিস্তানী সৈন্যরা এমনই এক নারকীয় গণহত্যা চালায় শেরপুর জেলার নলিতাবাড়ি থানার কাকরনন্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে। একাত্তরে বাংলাদেশের অন্যান্য গণহত্যার মতো সোহাগপুর গণহত্যাও পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংসতার চিহ্ন বহন করে। ২৫ জুলাই ১৯৭১। আর দশটা দিনের মতোই সেদিন সকালেও সোহাগপুর গ্রামের মানুষ কেউ লাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে মাঠে গিয়েছিলেন, কেউ বাড়িতেই নাস্তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এমন সময় পািকস্তানী হানাদার বাহিনীর মেশিনগানের শব্দে কেঁপে উঠে উত্তর সোহাগপুর এলাকা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মানুষজন আতঙ্কে দিগি¦দিক ছোটাছুটি শুরু করে। রাজাকার- আলবদরদের সহায়তায় পাকিস্তানী বাহিনীর প্রায় ১৫০ জন সৈন্য সোহাগপুর প্রফুল্লের দীঘি থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত এলাকা ঘিরে রাখে। সেদিন প্রথমেই পাকিস্তানী বাহিনীর শিকার হয়েছিলেন রমেন রাসেল, চটপাথাং ও মিরিশ গ্রাব্রিল নামের ৩ জন আদিবাসী গারো। চটপাথাং ও মিরিশ বাড়ির সামনে মাঠে কাজ করছিলেন। পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে থাকা রাজাকার নজিমুদ্দিন রমেন রাসেলকে ঘর থেকে ডেকে আনেন। তারপর তিনজনকে একসঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানী বাহিনী। সামনেই মাঠে কাজ করছিলেন হাসেন আলী, দিনমজুর আব্দুল লতিফ, সফর উদ্দিন, জহুরুল হক, শহর আলী ও আনসার আলী। গ্রামের খেটে খাওয়া এসব নিরীহ মানুষগুলোকে পাকিস্তানী সেনারা একসঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। একইভাবে মাঠে কাজ করছিলেন হযরত আলী, উমেদ আলী, কাসেম আলী, আছত আলী, মহেজ, মহেন, রহম, সিরাজ, ইমান আলী, খেজর আলী, আবুল হোসেন, মোসলেম আদ, হিদুল্লাহ, নওয়াজ আলী, হসিম উদ্দিনসহ অনেকে। গ্রামের প্রান্তিক মানুষদের পাকিস্তানি সেনারা গুলি করবে না- এই সরল বিশ^াসে এসব নিরীহ মানুষগুলো পাকিস্তানী সেনাদের দেখেও পালানোর জন্য দৌড় না দিয়ে মাঠেই কাজ করছিল। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাকিস্তানী বাহিনী গুলি করে তাদের বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। এখানেই শেষ নয়, গুলি লাগার পরও মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে থাকা রহম আলী, ছেলে সিরাজুল ও নাম না জানা আরেকজনের গোঙানি থামছে না দেখে পাকিস্তানী নরপশুদের একজন তার বেয়নেট দিয়ে মাথায় আঘাত করে তাঁদের মৃত্যু নিশ্চিত করে স্থান ত্যাগ করে। মোহাম্মদ তনা সেক বাড়ির সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন এবং গরুগুলোকে বাঁচানোর জন্য বাঁধন মুক্ত করে দিলেন। কিন্তু সবাইকে বিপদমুক্ত করতে পারলেও নিজে ধরা পড়ে যান পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে। তাকে তার বাড়ির সামনেই জীবন দিতে হয়, এরপর হত্যা করা হয় নেকবর আলী, নুরু ও কাঞ্ছা মিয়াকে। শমসের আলী ও তার ছেলে হযরত আলী মাঠ থেকে দৌড়ে ঘরে আশ্রয় নিয়েও পাকিস্তানী বাহিনীর নিষ্ঠুরতা থেকে বাঁচতে পারেননি। স্ত্রী লাকজান বেওয়া পাকিস্তানী সৈন্যদের পায়ে পড়ে স্বামী-সন্তানের প্রাণভিক্ষা চাইলেও তারা তাঁকে লাথি মেরে সরিয়ে ঘর থেকে বের করে আনে তার স্বামী শমসের আলীকে। পাকিস্তানী নরপশুরা স্ত্রীর সামনেই নির্মমভাবে হত্যা করে স্বামী-সন্তানকে। গুলি করতে করতে সামনে এগুতে থাকে পাক হানাদার বাহিনী। ফজর আলী, মালেক ফকির, তোফাজ্জল হোসেনকে হত্যার পর তারা হামলা করে নুরে বেওয়া ও সমলা বেওয়ার বাড়িতে। শিশুপুত্র সাইফুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার আকুতি জানিয়েছিলেন সমলা বেওয়ার স্বামী জসিম উদ্দিন। কিন্তু পাকিস্তানী হায়েনারা বাবার কোল থেকে ছিনিয়ে উঠানে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গুলি করে হত্যা করে শিশু সাইফুলকে। একই সঙ্গে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয় সাবু শেখকে। প্রাণের ভয়ে আলেক নেসার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল তার ভাই কিতাব আলী, সহর আলী, মমিন, মন্নাছ, ইমান আলীসহ অনেকে। আলেক নেসার বাড়িতেও পাকিস্তানী বাহিনী হামলা করে এবং একই সঙ্গে ১১ জনকে হত্যা করে। আলেক নেসা একটি কোরান শরীফ বুকে জড়িয়ে ধরে সবাইকে নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আকস্মিকভাবে প্রচ- এক গুলির শব্দে তার বুক থেকে খসে পড়ে কোরান শরীফ, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। ঘরের ভিতর আশ্রিত সবাই তখন খিড়কি খুলে পালাতে যায়। জ্ঞান ফেরার পর আলেক নেসা দেখতে পান বাড়ির আশপাশে নিথর লাশ হয়ে পড়ে আছে তাদের। মসজিদের ইমাম হাসান আলী ও ধর্মপ্রাণ জমির উদ্দিন মসজিদ থেকে বের হয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে গণহত্যা বন্ধের অনুরোধ জানাতে সামনে এগিয়ে যান। কিছুটা অগ্রসর হতেই পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে থাকা এক রাজাকার সদস্য তাকে গুলি করে, সেই গুলি তাদের বক্ষভেদ করে পেছনে থাকা এক হানাদার সৈন্যের শরীরে লাগে। এরপর ক্ষোভে অন্য সৈন্যরা সঙ্গে সঙ্গে রাজাকারটিকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এভাবেই ছয় ঘণ্টার নজিরবিহীন গণহত্যায় ১৮৭ জন নিরীহ গ্রামবাসীর মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে যায় সোহাগপুর গ্রাম। যারা পালাতে পেরেছিল তারা একজন, দু’জন করে গ্রামে ঢুকতে থাকে। তাড়াহুড়ো করে তারা কোন মতে গর্ত করে শাড়ি, মশারি, চাদর, কলাপাতা পেঁচিয়ে আপনজনের লাশ মাটি চাপা দেন। রাতের আঁধারে মই দিয়ে লাশ টেনে গণকবর দেয়া হয়। পুরুষরা আর কেউ জীবিত না থাকায় অনেকক্ষেত্রে গ্রামের নারীরা লাশ মাটি চাপা দেয়ার কাজটি করেন। ৩২ জন বিধবা সেদিনের নৃশংস গণহত্যার ভয়াল স্মৃতি নিয়ে আজও বেঁচে আছেন। যে সকল লাশের আত্মীয়-স্বজন তাৎক্ষণিকভাবে গ্রামে ফেরত আসতে পারেনি, সে সকল লাশ খাবার হয় শেয়াল-শকুনের। সোহাগপুর গণহত্যা সম্পর্কে ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট’ কর্তৃক প্রকাশিত গণহত্যা নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালায় ‘সোহাগপুর গণহত্যা’ নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ গবেষণাগ্রন্থের গ্রন্থমালা সম্পাদক বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন এবং গ্রন্থটির লেখক উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক আইরীন আহমেদ, প্রকাশকাল বৈশাখ ১৪২৪/মে ২০১৭। লেখক : গবেষণা কর্মকর্তা, গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র, খুলনা
×