ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নারী ক্রিকেটার তৈরিতে লাভলীর উদ্যোগ

প্রকাশিত: ১১:৪৫, ২৭ মার্চ ২০১৯

নারী ক্রিকেটার তৈরিতে লাভলীর উদ্যোগ

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ ক্রিকেটে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ও দক্ষ নারী ক্রিকেটার তৈরিতে বরিশালে প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে নারীদের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। তবে এটা কোন প্রতিষ্ঠান বা ক্রীড়া সংস্থার উদ্যোগে নয়। শারমিন আক্তার লাভলী নামের সাবেক এক নারী ক্রিকেটার এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। কোচ হিসেবে নিজেই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের দক্ষ ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তুলতে নিরলসভাবে কাজ করছেন। ক্রিকেট অঙ্গনে বরিশালের নারীদের এগিয়ে আসাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তাসহ ক্রিকেটপ্রেমীরা। সরকারী ও সমাজের সকলের সহযোগিতায় এ অঞ্চলের নারী ক্রিকেট অঙ্গনকে আরও শক্তিশালী হবে বলে মনে করছেন তারা। এজন্য শারমিন আক্তার লাভলীকে প্রশিক্ষণ কাজে সার্বিক সহযোগিতার জন্য সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসহ সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান করেছেন ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তারা। বরিশালে রয়েছে নারীদের বিভাগীয় ক্রিকেট দল। যা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বিভাগীয় নারী ক্রীড়া সংস্থা। তবে টিম থাকলেও নেই নির্দিষ্ট নারী ক্রিকেটার। প্রতিযোগিতার সুযোগ আসলে বিভাগের বাইরে থেকে খেলোয়াড় ভাড়া করে আনা হয় টিম গঠনের জন্য। তবে সর্বশেষ কবে বরিশাল থেকে নারী ক্রিকেটাররা টুর্নামেন্ট বা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন তা জানা নেই স্বয়ং ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তাদেরও। বরিশাল নারী ক্রিকেটাঙ্গনের এমন দুর্দশার জন্য ক্রীড়া সংস্থার নিষ্ক্রিয়তার পাশাপাশি নিয়মিত অনুশীলন না থাকাকেই দায়ী করছেন খেলোয়াড়রা। নারী ক্রিকেট অঙ্গনকে উজ্জীবিত করতে ক্রীড়া সংস্থা কিংবা সংশ্লিষ্টদের কোন উদ্যোগ নেই। এ অভিযোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে ক্রীড়া সংস্থার উদ্যোগ না থাকলেও বরিশাল নারী ক্রিকেটাঙ্গনকে জাগিয়ে তুলতে কাজ করছেন সাবেক নারী ক্রিকেটার শারমিন আক্তার লাভলী। তিনি একজন গৃহবধূ হয়েও নিজের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীকে দক্ষ ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। এ জন্য তিনি বরিশাল শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত স্টেডিয়ামের অভ্যন্তরে মেয়েদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প তৈরি করেছেন। সপ্তাহের তিনদিন অর্থাৎ বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার প্রতিদিন বিকেল তিনটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত তিনি মেয়েদের নিজ হাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে সাড়া ফেলেছেন। বরিশাল নগরীর কাউনিয়া মনষাবাড়ি এলাকার বাসিন্দা মোঃ রিপন মিয়ার স্ত্রী শারমিন আক্তার লাভলী ইডেন কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় ঢাকার ধানমন্ডি লেডিস ক্লাবের নারী ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় ছিলেন। ওই ক্লাবের হয়ে তিনি ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত লেগ স্পিনার হিসেবে খেলেছেন। ধানমন্ডি ক্লাবের হয়ে তিনি সেকেন্ড ডিভিশন লীগ খেলেছেন। ক্রিকেট নিয়ে সুদূর পরিকল্পনা থাকলেও বিবাহবন্ধন আটকে দেয় তাকে। তবে ক্রিকেট নিয়ে ভাবনা ফুরায়নি তার। স্বামী এবং পরিবারের সম্মতিতে পুনরায় তিনি ক্রিকেটাঙ্গনে ফিরেছেন। আলাপকালে শারমিন আক্তার লাভলী বলেন, ক্রিকেট আমার ধ্যান-জ্ঞান। তাই বিয়ের পরও ক্রিকেট নিয়ে ভেবেছি। সেই ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতেই বরিশালে নারী ক্রিকেট একাডেমি করার উদ্যোগ নিয়েছি। গত ৭ মার্চ থেকে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত স্টেডিয়ামে মেয়েদের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ শুরু করেছি। বর্তমানে ১৪ জন মেয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এরা সবাই চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্রী। সপ্তাহে তিনদিন ওদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে কোন পারিশ্রমিক নেয়া হচ্ছে না। বরং তারা (প্রশিক্ষণার্থী) আমার নিজ অর্থে কেনা ব্যাট, বল, প্যাড, গার্ড, স্টাম্পসহ অন্যান্য ক্রিকেট সামগ্রী প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করছে। এ কাজে আমাকে সহযোগিতা করছেন ট্যালেন্ট হ্যান্ড ক্রিকেট একাডেমির কোচ তানিম। লাভলী বলেন, বরিশালে নারী ক্রিকেট দল রয়েছে কিন্তু ক্রিকেটারদের প্রশিক্ষণের কোন ব্যবস্থা নেই। যে কারনে কোন দক্ষ খেলোয়াড় তৈরি হয়নি। তাই দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে বরিশালের নারীদের কোন অবস্থান নেই। তাই বরিশাল নারী ক্রিকেট অঙ্গনকে দেশের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে নিজ উদ্যোগে ‘প্রমীলা ক্রিকেট একাডেমি’ গড়ার চেষ্টা করছি। এ জন্য বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে মেয়েদের ক্রিকেটে অংশগ্রহণে উৎসাহী করতে কাজ করছি। এতে বেশ সাড়াও পেয়েছি। পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে একটি শক্তিশালী টিম গঠনের কথা ভাবছি। লাভলী আরও বলেন, প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের আরও প্রসার ঘটাতে সরকারী এবং বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি সুযোগ সুবিধা দরকার। কেননা স্টেডিয়ামে প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের নির্দিষ্ট কোন জায়গা নেই। স্টেডিয়ামে মেয়েদের ড্রেসআপের জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থাও নেই। এখানে যারা প্রশিক্ষণে আসছে তারা তৃণমূলের মেয়ে। ফলে ওদের ক্রিকেট সামগ্রী ক্রয় করা সম্ভব নয়। বিষয়গুলোতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পেলে এ কার্যক্রমকে আরও এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। বরিশাল বিভাগীয় নারী ক্রীড়া সংস্থার সদস্য সচিব সৈয়দা মনিরুন নাহার মেরী বলেন, অতীতে মেয়েদের ক্রিকেট প্রশিক্ষণের কোন ব্যবস্থা ছিল না। যখন টিম হয় তখন বাইরে থেকে লোক এনে মেয়েদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু নিয়মিত অনুশীলন না থাকায় খেলার মান বৃদ্ধি হচ্ছে না। লাভলী নিজ উদ্যোগে যে প্রশিক্ষণ শুরু করেছে তা প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক ও বরিশাল বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সদস্য সচিব আলমগীর খান আলো বলেন, আমাদের বিভাগীয় নারী ক্রিকেট টিম থাকলেও খেলোয়াড়ের বড়ই অভাব। যখন কোন টিম হয় তখন খেলোয়াড় খুঁজে পাই না। জেলায় জেলায় চিঠি দিয়ে খেলোয়াড় খুঁজতে হয়। তাতেও পূর্ণাঙ্গ টিম হয় না। তাই বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে খেলোয়াড় ভাড়া করে আনতে হয়। আগে একজন মেয়ে ছিল যাকে টিম লিডার করে বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হতো। সেই মেয়েও এখন একটি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে চাকরি করছেন। তিনি বলেন, দেশের সবখানেই এখন ক্রিকেটে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। জাতীয় পর্যায়েও আমাদের মেয়েরা বেশ ভূমিকা রাখছে। শুধু বরিশালের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে ফুটবল ও ক্রিকেটে মেয়েদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। কারণ প্রশিক্ষণের অভাব। ক্রিকেট বা ফুটবল দুটিতেই নিয়মিত অনুশীলনের প্রয়োজন। যার ব্যবস্থা বরিশালে নেই। লাভলী যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেছে সেটা আমাদের বরিশালের মেয়েদের জন্য কল্যাণকর। বরিশাল নারী ক্রিকেট অঙ্গনকে উজ্জীবিত এবং শক্তিশালী করতে তাকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বরিশালের নারী সংগঠনগুলোর দাবি, ক্রীড়াপ্রেমী বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সাবেক ক্রিকেটার লাভলীর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বরিশালের মেয়েরা দক্ষ নারী ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দক্ষিণাঞ্চলবাসীসহ গোটা বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।
×