ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাঁশি শুনে আর কাজ নাই/সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি...

প্রকাশিত: ১০:২২, ২৫ মার্চ ২০১৯

বাঁশি শুনে আর কাজ নাই/সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি...

সমুদ্র হক ॥ বাঁশি। বাঙালীর হৃদয়ের চিরন্তন ঐতিহ্যের সুর। চিত্রপটে প্রথমে ভেসে আসে, ভরদুপুরে কোন এক রাখাল গাছের ছায়ায় বসে ঠোঁটে বাঁশি নিয়ে সুর তুলেছে। কখনও ভেসে আসে পৌরাণিক উপাখ্যানের কৃষ্ণ নীপবনে বাঁশি বাজিয়ে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে রাধাকে। বাঙালীর দুয়ারে নববর্ষ টোকা দিয়েছে। বর্ষবরণে বাঁশি সুর তুলবে না তা কি হয়! ভেসে আসছে বাঁশের বাঁশির সুর। বাঁশিওয়ালারা এখন মহাব্যস্ত। বাঁশি বানিয়ে স্কেলের ধাপগুলো ঠিক আছে কি না তা মিলিয়ে নিচ্ছেন সুর তুলে। বৈশাখের মেলায় এই বাঁশিতে সুর তুলবে প্রজন্মের তরুণরা। বাঁশিওয়ালা ফটিকচন্দ্র দেবনাথের সঙ্গে দেখা। ঝোলার মধ্যে বাঁশি নিয়ে তিনি পথে নেমেছেন। দৃষ্টি আকর্ষণে নিবিড় মনে মিষ্টি সুর তুলেছেন। লোকজন ভিড় করছে। কলেজ ছাত্র শিহাব জানতে চাইল বাঁশির দাম? কিনেও নিল দেড়শ’ টাকায়। হেসে বলল, নববর্ষ সামনে। যমুনার কিনারে এ বাঁশির সুরে বরণ হবে নতুন বছর। সঙ্গে থাকবে একজন। হয়ে উঠবে মধুময় যুগল ছন্দ। ফটিকচন্দ্র বললেন যারা বাঁশি বানায় তারা বাঁশিওয়ালা। যারা বাজায় তারা শিল্পী। দেশে বাঁশি শিল্পীর সংখ্যা কম। বাঁশি শিল্পী যারা আছেন তাদের কালেভদ্রে মঞ্চে দেখা যায় কোন গানের সঙ্গে সঙ্গ দিতে। লালনগীতি শিল্পী ফরিদা পারভীনের অনুষ্ঠানে এক বাঁশি শিল্পীকে দেখা যায় যিনি হরেক রকম বাঁশির সুরের মূর্ছনায় ভরিয়ে দেন দর্শক হৃদয়। হালে বৈশাখের মেলাগুলোতে বিভিন্ন আয়োজনে অনেক তরুণ বাঁশি বাজিয়ে বাঙালীর চিরন্তন ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও বিশ^বিদ্যালয়ের অনেক মেয়ে বাঁশি বাজিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। বাঁশের বাঁশি বাঙালীর পরিচিতির বড় অংশ হয়ে আছে। দূর অতীতে গ্রামের অনেক শিশু কিশোর আম খাওয়ার আঁটি দ্বিখন্ডিত করে তার মধ্যে ছোট পাতা ভরে ফুঁ দিয়ে বাজাত। বলা হতো আমের আঁটির বাঁশি। শিশুরা তাল পাতায় বাঁশি বানিয়ে বাজাত। বৈশাখের মেলা সামনে রেখে চৈত্র মাসের পুরোটা বাঁশির ক্রেতারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ভিড় করে। নববর্ষের অন্যতম আকর্ষণ ও বৈচিত্র্য হলো বাঁশি। এই বাঁশিকে নিয়ে রচিত হয়েছে কবিতা, গান, প্রবাদ। অনেক কথার মধ্যে উপমা হিসেবে আসে বাঁশি। যেমন কারও কণ্ঠ সুন্দর হলে বলা হয় বাঁশির সুরের মতো। কোন নারীর নাক সুন্দর হলে বলা হয় বাঁশির মতো নাক। গানে আছে ‘কে বিদেশী মন উদাসী বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে...’। লতা মুঙ্গেশকরের কণ্ঠের গান ‘বাঁশি কেন গায় আমারে কাঁদায়...’। বাংলাদেশের শিল্পী মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর কণ্ঠের গান ‘বাঁশি বাজে ওই দূরে চেনা কি অচেনা সুরে এ লগনে মন মোর...’। গানের সুরে এসেছে ‘মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি।’ দুষ্টু কথায় প্রবাদ বলা হয় ‘না থাকে বাঁশ না বাজবে বাঁশি’। বাঙালীর ঐতিহ্যের যত সুর আছে তার মধ্যে বাঁশির সুরের মতো মধুমাখা সুর খুঁজে পাওয়া যায় কি! গভীর রাতে কোন বাঁশিওয়ালা যখন বাঁশির সুর তোলে তখন হৃদয় মন আনচান করে ওঠে। যারা ওই সময়ে বাঁশি শুনেছেন তারাই বলতে পারেন অনুভূতিটা কি হয়। অনেকের হৃদয় বাঁশির সুরে কেঁদেও ওঠে। গভীর রাতে কোন দার্শনিক ও প্রেমিকের কানে বাঁশির সুর পৌঁছলে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। অনেকে বলেন, গভীর রাতের বাঁশির সুর আর বেহালার করুণ সুর সমার্থক হয়ে যায়। মধ্য রাতে বগুড়ার সাতমাথায় এক বাঁশিওয়ালা গাইলেন ‘তুমি জানো না রে প্রিয় তুমি মোর জীবনের সাধনা...’। বাঁশি বাজালেন তার সঙ্গী। তার বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালিতে। লালনভক্ত তিনি। ছেউরিয়া আখড়া বাড়িতে গিয়েও বাঁশি বাজান। বললেন, লালনের গানের কথার সঙ্গে বাঁশির সুরের যে ধ্রুপদী ধারা তা অন্য কোন গানে নেই। বাঁশিওয়ালা ফটিকচন্দ্রের বাড়ি বগুড়ার কাহালুর পিলকুঞ্জ গ্রামে। বয়স প্রায় ৬০ বছর। ত্রিশ বছর ছিলেন খুলনার তরঙ্গ যাত্রাদলের সঙ্গে। তপন বসুর কাছে বাঁশির সুর শিখেছেন। যাত্রাপালার দুর্দিনে তিনি গ্রামে এসে বাঁশিওয়ালা হয়ে বাঁশি বানান। জানালেন, কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্রীমদ্দী গ্রামের বাঁশি বিশ্বখ্যাতি এনেছে। ইউরোপ আমেরিকাসহ ২৫ দেশে বাংলাদেশের বাঁশি যাচ্ছে। ফটিকচন্দ্রের বাঁশির সুনাম আছে। চৈত্রজুড়ে তিনি বাঁশি বানিয়ে পাইকারি বিক্রি করেন। নিজেও ফেরি করে বিক্রি করেন। তিনি দেখেছেন বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা বাঁশির প্রতি অনুরক্ত। ভাল ওস্তাদ পেলে তারা বাঁশির সুর তুলে মুগ্ধ করে দিতে পারে। তিনি বাঁশির বাঁশ কিনে আনেন চট্টগ্রাম থেকে। কুমিল্লার শ্রীমদ্দীর বাঁশি কেন বিখ্যাত! খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় দু’শ’ বছর আগে ভারতের কোকিল দাস বৈরাগী ও দীনবন্ধু ওই গ্রামে গিয়ে বাঁশি তৈরি শুরু করে ফেরি করে বিক্রি করতেন। তারা বাঁশি বাজাতে পারতেন। বংশ পরম্পরায় গ্রামে তাদের উত্তরসূরিরা আজও বাঁশি বানায়। ফটিকচন্দ্রের দাবি তার তৈরি বাঁশি দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। বাঁশি মূলত মুলী বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়। লম্বা ১৩ থেকে ২০ ইঞ্চি। তবে অনেক বাঁশি এর চেয়েও বড়। ব্যাসার্ধ বাঁশির মাপ অনুযায়ী। এগুলো বাজাতে দম থাকতে হয়। বাঁশিতেও হারমোনিয়ামের স্কেলের চার ধাপ রাখতে হয়। বাঁশিতে ৩ থেকে ৭ ছিদ্র থাকে। তবে একটি ছিদ্র ঠোঁটে ধরে ফুঁ দিয়ে এবং বাকি ছিদ্রগুলোয় দুই হাতের আঙ্গুলে ওপর নিচ করে সুর গেঁথে নিতে হয়। বাঁশির অনেক ধরন আছে। যেমন মোহন বাঁশি, আঁড় বাঁশি, বীণ, বেলুন, খানদানি কোকিল বাঁশি, তোতা, ফেন্সি বাঁশি। তবে বাঁশির রানী মোহন বাঁশি। একটি বাঁশি বানাতে অন্তত চৌদ্দটি ধাপ পাড়ি দিতে হয়। প্রথমে মুলী বাঁশ কেটে রোদে শুকাতে হয। পরে বাঁশের ছাল তুলে ফেলতে হয়। প্রতিটিতে ছিদ্র করার সময় স্কেল টেনে চিহ্ন করে সমান্তরাল রাখতে হয়। চোখা শিক দিয়ে ছিদ্র করার সময় কয়লার আগুন দরকার। ‘আড় বাঁশি’র জন্য বাঁশের ছাল তুলতে হয় না। কাঁদামাটি দিয়ে নানা ধরনের নক্সা করে আগুনে সেঁকে শুকানোর পর নক্সা ফুটে ওঠে। বাঁশির মুখে মান্দাল কাঠের কটি দেয়া হয়। বাঁশি মসৃণ করতে শিরীষ কাগজে ঘষে ধোয়ার পর রঙে নক্সা করা হয়। বাঁশি তৈরির প্রক্রিয়ায় অনেক নারী কাজ করে। বাঁশের বাঁশি। বাঙালীর জীবনের মধুময় ছন্দের এক সুর। মানুষে মানুষে মেলবন্ধনের পালায় নববর্ষের আমন্ত্রণের সে সুর ভেসে যায় দূর বহুদূর...।
×