ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাকি গণহত্যা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন ফোরামে তোলা হবে ॥ এ্যাডামা ডিয়েং

প্রকাশিত: ১০:১০, ২৫ মার্চ ২০১৯

 পাকি গণহত্যা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন ফোরামে তোলা হবে ॥ এ্যাডামা ডিয়েং

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিশ্বের যে কোন দেশে যে কোন স্থানে ঘটনা ঘটার শুরুতেই গণহত্যা প্রতিরোধ করা জরুরী। এছাড়া গণহত্যার কারণ কি তা গভীরভাবে ভাবতে হবে ও কারণ চিহ্নিত করতে হবে। তবেই কেবল গণহত্যা বন্ধ করা সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি ও গণহত্যা প্রতিরোধে বিশেষ উপদেষ্টা এ্যাডামা ডিয়েং। একইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের ফেরাতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে হবে বলে জানান। রবিবার রাজধানীর ইস্কাটনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিস) মিলনায়তনে আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। অপরদিকে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো গণহত্যার স্বীকৃতির বিষয়টি বিষয়টি জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলা হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে নারী ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছেন মি. এ্যাডামা। এর আগে রবিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাত করে এ্যাডামা ডিয়েং এসব কথা বলেন। সাক্ষাত শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। ‘বাংলাদেশে গণহত্যা : ১৯৭১’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে বিস। সেমিনারে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য মফিদুল হক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শমসের মবিন চৌধুরী, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি এমপি, বিস চেয়ারম্যান মুন্সী ফায়েজ আহমদ, বিস মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম আব্দুর রহমানসহ বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালন করা সাবেক ও বর্তমান রাষ্ট্রদূতগণ ৭১ সালের গণহত্যার স্বীকৃতির পক্ষে তাদের বক্তব্য ও মতামত তুলে ধরেন। সেমিনারে জাতিসংঘের বিশেষ উপদেষ্টা বলেন, রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, তা বাস্তবায়নে মিয়ানমার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে মিয়ানমারে যথাযথ পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে নিরাপদে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হবে। এজন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে হবে। মিয়ানমারকে গণহত্যা বন্ধ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে। এ্যাডামা ডিয়েং বলেন, ‘আমরা গণহত্যা বন্ধে জেনেভা কনভেশন চুক্তি করেছি। বাংলাদেশও তার একটি সদস্য। মূলত দেশীয় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পলিসিই গণহত্যা বন্ধে কাজ করবে। গণহত্যা যে একটি অপরাধ তা সহজেই বুঝতে হবে। এছাড়া ইসলাম ধর্মে তাদের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) যুদ্ধে যে গণহত্যা নিষেধ ও এটি বিশাল অপরাধ তা সকলকে বুঝাতে মুসলিম দেশের ইমামদের কাজে লাগাতে হবে। সমাজে মসজিদের ইমামদের যথেষ্ট সম্মান ও গুরুত্ব দেয়া হয়। এ্যাডামা ডিয়েং বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ৫০ এর দশকে এবং এরপরও গণহত্যা হয়েছে। আর্মেনিয়া, বাংলাদেশ, রুয়ান্ডার গণহত্যা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তবে গণহত্যা এক রাতেই ঘটে না। এর জন্য দীর্ঘ পরিকল্পনা থাকে। এর পেছনে অনেক সময়ও নেয়া হয়। সে কারণে গণহত্যার মূল কারণ খুঁজে বের করে শুরুতেই এর প্রতিরোধ করা জরুরী। ৭১ সালের এত বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের গণহত্যা আজও কেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের গণহত্যার বিষয়টি বাংলাদেশ জাতিসংঘের ফোরামে তুলে ধরতে পারে। গণহত্যার স্বীকৃতির বিষয়টি আমার এখতিয়ারের মধ্যে নয়। গণহত্যা প্রতিরোধের লক্ষ্যেই আমি কাজ করছি। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বাণীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে নৃশংস গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এই গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের নিয়ে বিএনপি রাজনীতি করেছে। গণহত্যায় জড়িত দু’জন মতিউর রহমান নিজামী-আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে বিএনপি মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছে। তাদের গাড়িতে পতাকা তুলে দেয়া হয়েছে। এখনও গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে বিএনপি রাজনীতি করছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য মফিদুল হক বলেন, বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের গণহত্যা বিশ্বজুড়ে আলোচিত। এই গণহত্যায় ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছেন। গণহত্যার বিচারও বাংলাদেশ শুরু করেছে। এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশ কাজ করছে। অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে বিস চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, পাকিস্তানী আর্মি কর্তৃক ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করে যুদ্ধের সর্বশেষ পর্যন্ত এই গণহত্যা পরিচালিত হয়। এদেশের মেধাবী ও জ্ঞানী লোকসহ জাতির মেধাবী সন্তানদের পাকিস্তানীরা ধরে ধরে হত্যা করে। যুদ্ধের মাঝের সময় পাকিস্তানীরা গ্রামের নিরীহ কৃষক জনতা নারী পুরুষকে গণহত্যা করে। তিনি বলেন, যে দেশে ২৫ মার্চ গণহত্যার রাত হিসেবে স্বীকৃত আর বিশ্বে ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা প্রতিরোধ দিবসটি স্বীকৃত। একটি আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হলো এবার ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। আমাদের তখন গণহত্যা প্রতিরোধের সঙ্গতি ছিল না। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ছিল বাঙালীরা। তাই এসব গণহত্যা প্রতিরোধ করতে পারিনি। বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পূর্ণ পরিকল্পিত হত্যাকান্ড । যে গণহত্যার জন্য বাংলাদেশী ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীও জড়িত ছিল। বিএনপির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শমসের মুবিন চৌধুরী বলেন, ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে আমি নিজে পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতার স্বীকার। আমি ভিক্টিম তাই অবশ্যই পাকিস্তানীরা গণহত্যা সংঘটিত করেছিল। আমার চোখের সামনে কাতার করে একের পর এক হত্যাকা- সংঘটিত করেছিল। হত্যাকান্ড চোখের সামনে দেখলেও কোন নারী ও শিমুকে হত্যা করার কোন শব্দ পর্যন্ত করতে দেয়নি। পাকিস্তানী আর্মি কর্তৃক প্রকাশ্যে গণহত্যা সম্পন্ন করে। তাই এই গণহত্যার স্বীকৃতি প্রয়োজন। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম বলেন, দেশী-বিদেশী আইন ও জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী অবশ্যই ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাতের হত্যাকা- গণহত্যা। আন্তর্জাতিক বিশ্বকে এর স্বীকৃতি দিতেই হবে। জাতিসংঘের উপদেষ্টার আগে থেকেই গণহত্যা বন্ধে প্রস্তুতি নেয়া সম্পর্কে কথার জবাবে সাবেক এক রাষ্ট্রদূত বলেন, যেখানে গণহত্যার সঙ্গে একটি সরকারের মধ্যেই একটি অংশ জড়িত থাকে সেখানে গণহত্যা প্রতিরোধ করা কিভাবে সম্ভব? বাংলাদেশের গণহত্যা পাকিস্তানি সরকার কর্তৃক সংঘটিত হয়েছিল। এদিকে একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর চালানো গণহত্যার স্বীকৃতির বিষয়টি আলোচনায় তোলার কথা বলেছেন এ্যাডামা ডিয়েং। রবিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাত করে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোঃ নজিবুর রহমান, সামরিক সচিব মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীনসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম এ নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি জানান, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কীভাবে এ দেশে গণহত্যা শুরু হয়েছিল, এদেশের সাধারণ মানুষকে কীভাবে নির্বিচারে হত্যা করেছিল পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী ও এদেশে তাদের দোসরেরা, সে বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধে দুই লাখের বেশি নারী নির্যাতিত হয়েছিলেন এবং স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন, সে বিষয়গুলোও শেখ হাসিনা জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারির সামনে তুলে ধরেন। ইহসানুল করিম বলেন, এ্যাডামা ডিয়েং বাংলাদেশের জেনোসাইডের বিষয়টা রেইজ করবেন বলেছেন। তিনি বলেছেন, তখন হয়তো কিছু দেশ এর বিরোধিতা করতে পারে। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে করা বৈঠকে নারীর ক্ষমতায়ন এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়েও আলোচনা হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইসলামে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে। তিনি সারা দেশ ঘুরেছেন। সরকার নারীর ক্ষমতায়নকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। প্রেস সচিব জানান, জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক’ হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আপনি বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক। নিউজিল্যান্ডে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় শোক প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে বলেন, ওই ঘটনার পর দেশটির সরকার ও জনগণ যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তা প্রশংসার দাবি রাখে। একইসঙ্গে বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলেও সরকার সেগুলো কঠোরভাবে দমন করেছে। প্রেস সচিব বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে সহায়তা দিয়েছে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে ধন্যবাদ জানান। অন্যদিকে এ্যাডামা ডিয়েং রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থানকে সমর্থন করার কথা বলেন। এ্যাডামা ডিয়েং বলেন, বাংলাদেশ একা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। এ বিষয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। সে প্রচেষ্টা আমরা নিয়েছি। আমরা চাই মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নে যারা জড়িত তাদের বিচার হোক। রোহিঙ্গারা ফিরে যাক। সেখানে একটা শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে উঠুক।
×