ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সোনালি আঁশের নতুন সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ১২:১৫, ২৪ মার্চ ২০১৯

সোনালি আঁশের নতুন সম্ভাবনা

বহুমাত্রিক সম্ভাবনায় পাটের পুনর্জাগরণ বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাট উৎপাদনকারী দেশ। এক সময় আমাদের অর্থনীতির বুনিয়াদি শক্তি ছিল পাট। ধারাবাহিকভাবে পাটের উৎপাদন বাড়ছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬৭.৮৫ লাখ বেল, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭৫ লাখ বেল, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮৫ লাখ বেল, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রায় ৮৯ লাখ বেল এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় ৯২ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হয়েছে। জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১২৯৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকার কাঁচাপাট রফতানি হয়েছে। একই সময় ছয় হাজার ৮০১ কোটি টাকার বেশি পাটপণ্য রফতানি করা হয়েছে। দেশে পাট চাষের ইতিহাস পর্যালোচনা থেকে জানা যায়, ১৮৫০ সালে বাংলায় মাত্র ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হতো। ৫০ বছর পরে ১৯০০ সালে পাট চাষের জমির পরিমাণ ৫০ হাজার হেক্টরে উন্নীত হয়। তারপর নানা চড়াই-উৎরাইয়ে ক্রান্তিকাল পেরিয়ে প্রায় ধ্বংসের মুখ থেকে ২০০৮ সালের পর থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে ২০১০-১৫ সাল পর্যন্ত পাট চাষের ক্ষেত্র আবারও প্রায় ৭-৮ লাখ হেক্টরে উন্নীত হয়। ঘুরে দাঁড়ানো স্বপ্ন দেখেন পাটচাষী ও পাটশিল্প সংশ্লিষ্টরা। এরই পাশাপাশি আবারও পাটকলের চাকার সঙ্গে লাখো পাট শ্রমিকের জীবনের চাকায় নতুন গতি সঞ্চারের সম্ভাবনা জাগরিত হয়। স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৯০ ভাগই আসত পাট খাত থেকে। কিন্তু স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ পরবর্তী সরকারগুলোর সুনজরের অভাবে দেশের পাট শিল্পটি ক্রমশ ধ্বংসের দিকে নিমজ্জিত হয়। তবে সেই দৃশ্য এখন পাল্টে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে দেশের অর্থনীতি স্বগৌরবে পাটের প্রত্যাবর্তন নতুন আশার দুয়ার খুলেছে। সরকার ইতোমধ্যে ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনি, ও মসলা জাতীয় পণ্যসহ ১৯টি পণ্য মোড়কীকরণে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার ফলে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১৫০ কোটি অভ্যন্তরীণ পাটের বস্তার চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। সরকারী হিসাবে, এ আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে পারলে বছরে অভ্যন্তরীণ বাজারে ১০০ কোটি টাকার পাটের বস্তার ব্যবহার বাড়বে। জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি)-এর মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রায় ৬৫০ জন বেসরকারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। উদ্যোক্তারা প্রায় ২৮০ ধরনের পাটের পণ্য তৈরি, বাজারজাত এবং রফতানি করছে। পাটের সুতা, বস্তা, চট, কার্পেট ইত্যাদি প্রচলিত পণ্যের পাশাপাশি পাট দিয়ে পর্দার কাপড়, কুশন কভার, কার্পেট, শাড়ি ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে। পাট খড়ি থেকে তৈরি হচ্ছে উন্নতমানের কার্বন। তাছাড়া পাটের আঁশ থেকে প্রসাধনী, ওষুধ, রং তৈরি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বাঁশ এবং কাঠের বিকল্প হিসেবে পার্টিকেল বোর্ড, কাগজের ম- ও কাগজ তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে পাট খড়ি। পাট থেকে জুট পলিমার দিয়ে পলিথিন ব্যাগের বিকল্প ‘সোনালি ব্যাগ’ তৈরি হচ্ছে। অনুসন্ধানে ১৯৭১ সালে ৭৫টি পাটকল ছিল, সেখানে ১৯৮২ সালে ৮২টি পাটকল। বর্তমানে মাত্র ২২টি সরকারী পাটকল চালু আছে। কেবল অর্থকরী নয়- পরিবেশবান্ধব ফসল পাট পাট হলো পরিবেশবান্ধব ফসল এবং বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য আঁশ। পাটের আঁশ পচনশীল হওয়ার ফলে পরিবেশের ক্ষতি করে না। অপরদিকে প্লাস্টিকের ব্যবহার দিন দিন দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউএনইপির মতে, পৃথিবীর মানুষ প্রতিবছর ৫০ হাজার কোটি প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করে। প্রতিবছর ৮০ লাখ টন প্লাস্টিকের বর্জ্য নদী-নালা হয়ে সাগরে জমছে। প্লাস্টিকের এমন ব্যবহার চলমান থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে সাগরে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক বেশি পরিমাণ থাকবে। এমন প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্ব যখন ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় তখনই বাংলাদেশে আবিষ্কার হয় পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি পলিমার সোনালি ব্যাগ। বিশ্বব্যাপী এই ব্যাগের বড় বাজার তৈরি হয়েছে। এছাড়া ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের তিনটি প্রতিষ্ঠান পাট দিয়ে ভিসকস সুতা তৈরির রাসায়নিক পরীক্ষা, গুণগতমান নির্ধারণ, বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া, কারখানায় উৎপাদনের জন্য নকশা তৈরির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে নরসিংদীর ঘোড়াশালে কো-অপারেটিভ জুট মিলকে ভিসকসের কারখানা হিসাবে গড়েতোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আবার বর্তমানে বিশ্বে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে কৃত্রিম তন্তুর ক্ষতিকর প্রভাব হতে পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য প্রাকৃতিক তন্তু হিসাবে পাটের দিকে বিশ্বের উন্নত দেশসমূহের মনোযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবেশগত দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, অনবরত ধান চাষের ফলে মাটির উপরের অংশে (ঞড়ঢ় ঝড়রষ) খাদ্য উপাদানে যে ঘাটতি দেখা দেয় পাটের প্রধান মূল মাটির গভীর থেকে খাদ্য উপাদান উপরে নিয়ে আসে। ফলে জমির উৎপাদনশীলতা তথা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যই শস্যক্রমে পাট চাষ করা প্রয়োজন। আবার বাংলাদেশের জলবায়ু পাট চাষের জন্য অধিক উপযোগী হওয়ার কারণে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম মানের পাট বাংলাদেশে উৎপন্ন হয়। পাট চাষে পরিবেশে কৃষকের অবদান বাড়ছে পরিবেশের সঙ্গে পাট চাষ নিবিড়বান্ধব। পাটের পরিচয় অর্থকরী ফসল হিসেবে হলেও এখন পরিবেশ সহায়ক হিসাবে পাটজাত পণ্যের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে আড়ালে থেকে যাচ্ছে পাট চাষে পরিবেশের উপকারী দিকগুলোর কথা। আর এ কারণে একজন পাটচাষীর পরিবেশ রক্ষায় অবদানের কথা বিবেচনায় আসে না। এমনকি যিনি পাটের আবাদ করছেন তিনি নিজেও জানেন না যে তিনি কেবলই অর্থকরী ফসল হিসাবে নয়, পরিবেশের সহায়ক অসামান্য অবদান রাখছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন কৃষক এক হেক্টর জমিতে পাট চাষ করলে তা মোট ১০০ দিনে ১৫ টন কার্বন ডাই অক্সাইড প্রকৃতি থেকে শোষণ করে, আর ১১ টন অক্সিজেন প্রকৃতিকে দেয়। পাটজাত দ্রব্য সহজে মাটিতে মিশে যায় বলে, প্রক্রিয়াকৃত পাটজাত দ্রব্যও পরিবেশের কোন ক্ষতি করে না। অপরদিকে বিশ্বে প্রতিবছর এক ট্রিলিয়ন টন পলিথিন ব্যবহার করা হয়- যার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার ১০ লাখেরও বেশি পাখি এবং লক্ষাধিক জলজ প্রাণী। আমরা যদি পলিব্যাগের বদলে পাট জাত দ্রব্য ও মোড়ক ব্যবহার হলে আমরা পরিবেশকে অবক্ষয় থেকে রক্ষা করে মানবজাতির উপযোগী করে তুলতে পারি। আমরা কেবল পাটের অর্থকরী অবদানের দিকটিই জানি। তবে পাট গাছ যে অর্থকরী, পরিবেশবান্ধব ও জলবায়ু পরিবর্তন বিরোধী একটি ফসল সে কথা অনেকেরই হয়ত জানা নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাট ফসলটি নির্মল বাতাস সৃষ্টির অত্যতম কারিগর। কারণ পাট গাছ বাতাস থেকে কার্ব-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে, যা আমরা ত্যাগ করি এবং প্রচুর অক্সিজেন ত্যাগ করে যা আমরা গ্রহণ করে বেঁচে থাকি। কথা আসতে পারে এ তো বৃক্ষর মতোই। কথা সত্যি হলেও পাট গাছের ক্ষেত্রে আছে অনেক ব্যতিক্রম অবদান- যা ফসলি জমির উর্বরতা বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশকে করে সমৃদ্ধ। পাট একটি জলবায়ু সহনশীল ফসলও বটে। কারণ সাময়িক খরা কিংবা জলাবদ্ধতায় পাট ফসলের তেমন কোন ক্ষতি হয় না। পাট সবুজ বৃক্ষ এবং প্রকৃতি ও পরিবেশের নিজস্ব উপাদান। পাট উৎপাদনে খুবই কম পরিমাণের সার প্রয়োজন হয়। এছাড়াও আমরা জানি, বাংলাদেশের প্রকৃতি এবং জলবায়ু পাট ও পাট জাতীয় ফসল চাষাবাদের জন্য খুবই উপযোগী। পাট বৃষ্টিনির্ভর ফসল। পাট চাষ থেকে পশুখাদ্য ও সবজি পাওয়া যায়। পাট পাতা দেশের বহুল ব্যবহৃত একটি উপাদেয় শাক এবং শুকনো পাট পাতার পানীয় ‘চা’ হিসাবে ব্যবহারের প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করা হয়েছে। ঘন ও উঁচু ফসল হওয়ার কারণে পাট বনভূমির ন্যায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। তারচেয়েও বড় ব্যাপারটি হলো- পাট ফসল পৃথিবীর গ্রীন হাউজ গ্যাস ও তার পরিপ্রেক্ষিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে।
×