ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহীন রেজা নূর

সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেব কোথা!

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ২৪ মার্চ ২০১৯

সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেব কোথা!

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচন বিষয়ে ড. কামাল হোসেন ও বিএনপি নেতাদের শেখ হাসিনা সরকারবিরোধী কথার প্রতিধ্বনিই শোনা গেল। লক্ষণীয় যে, হিউমান রাইটস ওয়াচ থেকে শুরু করে এই ধারার বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা (আসলে বেসরকারী নয় এরাও স্ব-স্ব দেশের সরকারের বা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর তাঁবেদার মাত্র) বাংলাদেশে এক ঝামেলা বাঁধাবার তালে সক্রিয় রয়েছে। এই জাতীয় টালবাহানা আমরা জাতীয় নির্বাচনের বেশ কিছুকাল আগে থেকেই দেখে আসছিলাম। একটু লক্ষ্য করলেই বুঝা যাবে, কামাল গং আর এদের মধ্যকার যোগাযোগ আসলে ‘মণি-কাঞ্চনের’ যোগাযোগের মতোই সরস আর উভয় পক্ষের অভিযোগ এবং কথাবার্তা সব একই সুরে বাঁধা। এদিকে, দেশে বিভিন্ন মহল কর্তৃক চারদিকে নানা ধরনের গোলযোগ বাঁধাবার চেষ্টা যে চলছে তাতো জানা কথা। ড. কামাল গংরা মার্কিন ও অন্যান্য দেশের তাদের মেন্টরদের দিয়ে এখনও আমাদের জাতীয় নির্বাচনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকারের যে প্রতিবেদনটি সম্প্রতি বেরিয়েছে তা ড. কামাল সাহেবদের তথাকথিত গণশুনানির প্রতিধ্বনি মাত্র! যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকারের প্রকৃত চিত্রটি যদি মেলে ধরা হয় তাহলে তাদের এসব প্রতিবেদন প্রকাশের নৈতিকতা ও যৌক্তিকতাই প্রশ্নবিদ্ধ হবে কেবল! যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেন তাদের মানবাধিকার আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বুলি কপচিয়ে ইরাক, লিবিয়া, লেবানন, সিরিয়াসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে কত লাখ নিরীহ আবালবৃদ্ধবনিতার প্রাণ সংহার করেছে গত এক দশকে সেই হিসেবটি কি মার্কিন প্রতিবেদনগুলোতে কখনও স্থান পায়? যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে ধরনের জালিয়াতি ও অসচ্ছতা চলে তার কোন ছিটে-ফোঁটা নিদর্শন ঐ প্রতিবেদনে থাকে না কেন? গরিবের বৌকে সকলেই ভাউস বানিয়ে মজা লুটতে চায় আর মার্কিনীদের এই জাতীয় প্রতিবেদন তারই এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ মাত্র! যাহোক, এবার বাংলাদেশের দিকে একটু তাকানো যাক। ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন সংগঠন ও কতিপয় চিহ্নিত ব্যক্তি যে তেলেসমাতি কা--কারখানা শুরু করেছেন তা এক কথায় তাদের অসাধুতা ও কপটতারই পরিচায়ক মাত্র! একটু কোন ফাঁক-ফোকর পেলেই টিভির টক শোতে এসে আসর জমানোর জন্য আবারও হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে সেই চেনামুখ ও আওয়ামী লীগ-বিরোধী শিবিরের বাক্যবাগীশ তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা জায়গা করে নেয়ার চেষ্টা করে চলেছেন। অবশ্য, আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিক-মোক্তারদের বা কর্মকর্তাদের কাছে এরা নানা কারণেই ‘প্রিয়ভাজন’ ব্যক্তি হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে বিধায় নতুন করে স্থান পেতে এদেরকে খুব একটা বেগ পেতে হচ্ছে না। একদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যার বেসাতি আর অন্যদিকে এসব বুদ্ধি-ফেরি করা ব্যক্তিদের ইনিয়ে-বিনিয়ে বলা মিথ্যাচার সমাজকে বিভ্রান্ত করার মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যাচ্ছে। ডাকসু নির্বাচনে বিরাট কোন অনিয়ম ঘটে থাকলে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তা উপস্থাপনের পরিবর্তে ঢালাও ও মনগড়া অভিযোগ তুলে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় দূরভিসন্ধিমূলকভাবে ছড়িয়ে দেয়া মিথ্যা বা গুজবকে টক শোতে বড় গলায় তুলে ধরে এসব সরকারবিরোধী ও দালাল গোত্রীয় সুশীলরা বাজিমাৎ করতে চাইছে। ঠিক যেমনটি কিনা এক নাগাড়ে করেই চলেছেন আমাদের বিশ্বখ্যাত আইন বিশারদ ড. কামাল হোসেন ও তার সঙ্গী-সাথীরা। ডাকসুর ভিপি পদে নির্বাচিত নুরুল হককে নিয়ে একটি স্বার্থান্নেষী মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ কিছু তরুণের মাঝে যে ধরনের মাতামাতি ইদানীং দেখা যাচ্ছে তা ঐ তরুণদের চিন্তা-চেতনার মারাত্মক দীনতার প্রকাশ বৈ নয়! কোটা আন্দোলনের এই তরুণ ‘নেতা’কে কেউ কেউ এমনভাবে উপস্থাপন করছেন যেন তাদের জন্য সে একরূপ ‘ত্রাণ কর্তা’-বিশেষ! আবার কেউ কেউ তাকে ছাত্রলীগের প্রাক্তন নেতারূপেও দাঁড় করাবার প্রয়াস পাচ্ছেন। অথচ, কোটা আন্দোলনকালে তার বিভিন্ন বক্তব্য কি পরিমাণ শেখ হাসিনার প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ এবং প্রকারান্তরে তা যে পরিপূর্ণভাবে জামায়াত-শিবির গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির অনুকূলে ক্রিয়াশীল ছিল তা কি আমাদের তরুণেরা এত সকালেই ভুলে গেল? অবশ্য, বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি হিসেবে আমাদের ‘সুখ্যাতি’র কথা তো সর্বজনবিদিত! এই নুরুল হক যে এক কপট ব্যক্তি তা বুঝতে প্রধানমন্ত্রীর সামনে প্রদত্ত তার বক্তব্য এবং সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়েই তার ঠিক এর বিপরীতধর্মী বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নয় কী! প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সে তার প্রয়াত মায়ের চেহারার আদল খুঁজে পেয়েছে বলে দাবি করে অতঃপর বাইরে গিয়েই ডাকসুর পুনঃনির্বাচন দাবি করার মধ্যে এক ধরনের অসাধুতা প্রকটরূপে ধরা পড়ে নিশ্চয়ই! উল্লেখ্য, ছাত্রলীগ কিন্তু ভিপি পদটি হারিয়েছে নিছক নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সংকীর্ণতা, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও আদর্শিক চেতনাগত ধ্যান-ধারণার নিতান্ত অভাবজনিত কারণে। বলাই বাহুল্য, ছাত্রলীগের যে বিশাল ও গৌরবজনক ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে সে সম্পর্কিত কোন প্রকার চর্চার বন্দোবস্ত সংগঠনে না থাকায় এক অন্তঃসারশূন্য নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে ও হচ্ছে আকাশচুম্বী গৌরবের অধিকারী প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগে। বর্তমান সরকার ক্ষমতারোহণের অব্যবহিত পর থেকেই আমরা বিভিন্ন মন্ত্রীকে জিরো টলারেন্স নীতির আওতায় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার ঘোষণা দিতে শুনেছি। অতঃপর আমরা বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজদের শনাক্তকরণের ব্যাপারে কিছু উদ্যোগ-আয়োজনও লক্ষ্য করেছি। তবে সে ক্ষেত্রে রাঘববোয়ালদের তুলনায় চুনোপুঁটিদের দিকেই কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি অধিক নিবদ্ধ থাকতে দেখা গেছে। ব্যাংকিং সেক্টরে যে হরিলুটের মোচ্ছব চলেছে তা বন্ধের ব্যাপারে কি ধরনের কঠিন-কঠোর নীতি অর্থমন্ত্রী গ্রহণ করবেন সেটিও এখনও খুব স্পষ্ট নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কেরানি দম্পত্তির যে বিপুল বিত্ত-বৈভবের সন্ধান পাওয়া গেছে এরপর ঐ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটটিকে শনাক্তকরণ ও তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে আর কোনপ্রকার উচ্চ-বাচ্চ্য এ অবধি শোনা যায়নি, কিন্তু কেন? শুধু স্বাস্থ্য নয়- আদতে সকল মন্ত্রণালয় ও সরকারী-বেসরকারী সেবামূলক প্রতিষ্ঠানেই দুর্নীতিবাজদের যে রবরবা অবস্থা তার বিরুদ্ধে জেহাদ শুরু করা ভিন্ন এর থেকে পরিত্রাণের আর কোন উপায় আছে কী ! তবে, এই দুর্নীতির সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে আইন, বিচারিক ব্যবস্থা, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে পরিপূর্ণভাবে আটঘাট বেঁধে নামতে হবে, নইলে অতীতের মতো এসব অভিযানই পর্বতের মূষিক প্রসবরূপে দেখা দিতে পারে! আমরা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর দখলীকৃত এলাকা মুক্ত করতে নৌপরিবহন সংস্থাকে যে ধরনের আপোষহীন ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখছি তা প্রশংসনীয় এবং এ ক্ষেত্রে তারা কোন প্রভাবশালী মহলের বাধা বা ওজর-আপত্তিকেও আমলে না নিয়ে অত্যন্ত শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে মানুষের কাছ থেকে ভূয়সী সুনাম কুড়াচ্ছেন। তবে যে উদ্দেশ্যে এই অভিযান চলছে সে উদ্দেশ্য সফল করার জন্য আগামীতে আরও অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে আর সে ক্ষেত্রে প্রভাবশালীরা একাট্টা হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত শুরু করবে না সে কথা নিশ্চয়ই হলপ করে বলা যাবে না; সুতরাং, এ সব ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে সর্বক্ষণ চোখ-কান খোলা রেখে কাজ করতে হবে। আমাদের সুপারশপ, রেস্তোরাঁ ও প্রায় সব রকমের খাদ্য বিষয়ক দোকান- পাটে এমনকি প্রসাধনী ক্ষেত্রেও চলছে দেদার ভেজালের কারবার! প্রায় প্রতিদিনই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্মীরা এই ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে জেল-জরিমানা করে চলেছেন কিন্তু তাতেও এদের এতটুকুও বিবেকের দংশন বোধ হয়নি। যেসব দোকান খাদ্যে ভেজাল, বাসি-পঁচা- মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার বিক্রি করবে সে সব দোকান তাৎক্ষণিকভাবে সিল-গালা করে দেওয়া ভিন্ন কোন পথই তো নেই দেখছি। তথাকথিত সুপারশপগুলো কিভাবে ক্রেতাদের সঙ্গে এই ধরনের জাল-জালিয়াতি ও জোচ্চুরি করে? ওজনে ফাঁকি দেয়া তো মাংস, মাছ, সবজি ও অন্যান্য পঁচনশীল খাদ্য বিক্রেতাদের জন্য একেবারেই সাধারণ ঘটনা। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার যে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠছে তাকে কোনভাবেই হেলা-ফেলাভরে দেখার কোনই সুযোগ নেই। কি কারণে এত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে তা কর্তৃপক্ষ বোঝেন না তাতো হতে পারে না। বিআরটিএ’র অসৎ-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নগদ নারায়ণের বিনিময়ে হেলপারকে বা কন্ডাক্টরকে দীর্ঘদিন যাবত ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে যে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে তার কি ব্যবস্থা হবে? খাদ্যের মান পরীক্ষা ও ভেজালমুক্ত খাবারের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য বিএসটিআই নামক যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে এর কর্মকর্তারা জাল সার্টিফিকেট দিয়ে দেদার পয়সা কামিয়ে এখন অবস্থা খানিক বেগতিক দেখে সাধু-সন্ন্যাসী সাজার চেষ্টা করছে। আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে দুর্ধর্ষ জঙ্গী, মহা মহা দাঙ্গাবাজ ও দুর্নীতিবাজরা রেহাই পেয়ে গেছে ও যাচ্ছে। সুতরাং, এ ক্ষেত্রে অবিলম্বে কেন আইনের সে সব ফাঁক বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না দেশবাসী তা জানতে চায়। অবস্থা এই যে, ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা’? দুর্নীতিবাজ, দাঙ্গাবাজ, মতলববাজ আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলীয় নেতা-কর্মী, অসাধু আমলা, অসৎ ব্যবসায়ী, ব্যাংক ও সরকারী খাতের টাকা লোপাটকারী, প্রশাসন যন্ত্রের বিভিন্ন স্থানে শক্ত অবস্থান করে নেয়া স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শনাক্তকরণে বলিষ্ঠ ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের কোনই বিকল্প নেই। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×