ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পঞ্চগড়ে নদীর গতিপথ বন্ধ

প্রকাশিত: ০৮:৩৮, ২৪ মার্চ ২০১৯

পঞ্চগড়ে নদীর গতিপথ বন্ধ

স্টাফ রিপোর্টার, পঞ্চগড় ॥ কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না প্রকৃতি বিধ্বংসী ড্রিল ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন। মাঝে মধ্যে লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে কিছু মেশিন জব্দ কিংবা ভেঙ্গে ফেলার পর দু-চারদিন বন্ধ থাকার পর অদৃশ্য খুঁটির জোরে ফের চলছে অবৈধ ড্রিল ড্রেজার মেশিন। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের গ্রীন সিগন্যালেই চলছে ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত করতোয়া, সাও ও ডাহুক নদীতে ৩শ’র বেশি ড্রেজার মেশিন দিয়ে ১শ’ থেকে দেড় শ’ মিটার গভীরে মাটি খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে নদীর আসল গতিপথও পরিবর্তনসহ মরা নদীতে পরিণত হচ্ছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর হাওয়া ভবনের সরাসরি তত্ত্বাবধানে সরকারী নদী থেকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। পরবর্তীতে হাইকোর্ট থেকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সরকার পরিবর্তনের পরই পাথর খেকোরা ভোল পাল্টিয়ে শুরু করে দেয় মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন। অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনকে কেন্দ্র করে সাধারণ শ্রমিকদের সঙ্গে ড্রেজার মেশিন মালিকদের সংঘর্ষ বাধে। এতে একজন শ্রমিক নিহত হন। ড্রেজার সিন্ডিকেটের মূল হোতা শ্রমিক ও লাইনম্যান থেকে বক্কর, এসারুল, শেখ ফরিদ এখন কোটিপতি বনে গেছেন। স্থানীয়দের দাবি, শুধু পুলিশ প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ নিলেই বোমা মেশিনগুলো বন্ধ হতে বাধ্য। সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, তেঁতুলিয়া উপজেলার কয়েকটি এলাকায় বিশেষ করে ডাহুক, সাও ও করতোয়া নদীর বুক চিরে রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত এমনকি কখনও দিনদুপুরেও চলে প্রায় তিন চার শ’ বোমা মেশিন। ভজনপুর থেকে শুরু করে কালিয়ামনি, জয়গুণজোত, ঝালেঙ্গীগছ, শিবচন্ডি, ধান শুকা, পীরের ডাঙ্গা, আঠারো খাড়ি, শিয়াল খাওয়া, শুকানী ইত্যাদি এলাকা এমনকি ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত করতোয়া ও সাও নদীতে চলে। নিচু এলাকা ছাড়াও সিপাহীপাড়ার লিচুবাগান, ভদ্রেশ্বর, ফকিরহাট, গোলাব্দি গছ, গণাগছ, ঘগার খাল, কুকুরমুহা, শান্তিনগর, কীর্তনপাড়া প্রভৃতি সীমান্ত এলাকার সমতল ভূমি থেকেও ড্রেজার দিয়ে পাথর তোলা হচ্ছে। অথচ সীমান্ত এলাকার দুই কিলোমিটারের মধ্যে সকল প্রকার পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এভাবে ড্রিল ড্রেজার মেশিন দিয়ে মাটির গভীর থেকে পাথর উত্তোলন করায় তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় মাটির নিচে হাজার হাজার গর্ত তৈরি হয়েছে। প্রতিটি গর্ত ১০০ থেকে ১৫০ মিটার পর্যন্ত গভীর। ডাহুক, করতোয়াসহ কিছু নদী ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে, মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প ছাড়াও ওই এলাকার অধিকাংশ জায়গা ভূমিধসে তলিয়ে যাওয়াসহ মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা। তারা বলছেন, এভাবে পাথর উত্তোলনে জমির উর্বরতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে। ওই জমিতে দীর্ঘদিন কোন ফসল হবে না এমনকি ভূমিকম্পসহ বন্যায়ও তলিয়ে যেতে পারে এলাকাটি। পঞ্চগড় চেম্বারের সহ-সভাপতি মেহেদী হাসান খান বাবলা বলেন, ‘ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন না রুখলে যে কোন সময় ভূমিধসসহ মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমনকি বন্যায় তলিয়েও যেতে পারে হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত দেশের সর্বোত্তরের ওই এলাকা।’ স্থানীয় পরিবেশবাদীদেরও একই অভিমত। জেলা জজকোর্টের আইনজীবী এ্যাডভোকেট জিল্লুর হোসেন সিদ্দিকী বলেন, ‘ড্রেজার মেশিনের মামলাগুলো তেমন শক্তিশালী নয় বলে আসামিরা সহজেই জামিন পেয়ে যাচ্ছে। কী এই ড্রেজার মেশিন ॥ মাটির গভীর থেকে পাথর উত্তোলনে ব্যবহƒত হয় বোমা মেশিনগুলো যাদের হর্ষক্ষমতা ৩২ থেকে ৪০। এগুলো মূলত ড্রিল ড্রেজার মেশিন যাতে পাম্প ও রিং পাইপ বিশেষভাবে জুড়ে মাটির অতি গভীর থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করা হয়। মাত্র ৬ থেকে ৭ ঘণ্টায় ১০ ট্রলি পাথর বা ১ হাজার সিএফটি পাথর উত্তোলন করা যায় একেকটি মেশিন দিয়ে যার বাজার মূল্য প্রায় লাখ টাকা। মাটির নিচে এক শ’ থেকে দুই শ’ মিটারের বেশি গভীর থেকে পাথর তুলতে সক্ষম বলে এই মেশিন ব্যবহারে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিষিদ্ধ এই ড্রেজার মেশিন বানাতেও তেঁতুলিয়া ভজনপুর এলাকায় অসংখ্য ওয়ার্কশপ গড়ে উঠেছে। গড়ে ওঠা এসব ওয়ার্কশপে প্রকাশ্যে ড্রেজার মেশিন তৈরি হলেও স্থানীয় প্রশাসন থাকছে নীরব। মূল হোতা বক্কর, এসারুল, শেখ ফরিদ ॥ স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সময় যারা ড্রেজারের শ্রমিক ছিল তারাই এখন ড্রেজার মেশিনের মালিক। এদের পেছনে মূল ইন্ধনদাতা ও সিন্ডিকেটের মূল হোতা ভজনপুর ইউনিয়নের ডিমাগছ এলাকার আব্দুল জব্বারের ছেলে আবু বক্কর, গণাগছ এলাকার আজিজুল ইসলামের ছেলে এসারুল এবং শালবাহান ইউনিয়নের পেদিয়াগছ এলাকার চাঁনমিয়ার ছেলে শেখ ফরিদ যারা এখন কোটিপতি। মেশিন চালুর আগে সন্ধ্যার পর ড্রেজার মালিকদের পুলিশের পক্ষে সবুজ সঙ্কেত দেয়া হয়। স্থানীয় এই তিন লাইনম্যান মিলে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পুলিশসহ বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করতে প্রতিরাতে মেশিন প্রতি নেয় ৮ হাজার টাকা। সে হিসেবে প্রায় তিনশত মেশিনে এক রাতেই ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকার লেনদেন হয়। এর বড় অংশটি তারা নিজেরা নেয়। শ্রমিক-মজুর থেকে কোটিপতি ॥ এক সময় বক্কর নিজেই ছিল পাথর শ্রমিক। এখন সে ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার মালিক। তার নির্মিত বাড়িটিও আলিশান। এছাড়াও পাঁচটি ট্রাক্টর, নিজস্ব ওয়ার্কশপ ছাড়াও রয়েছে নামে বেনামে কয়েক কোটি টাকার জমি। এক শ’টির বেশি ড্রেজারে তার শেয়ার রয়েছে। এখন সে নিজেই পরিচালনা করছে কোটি কোটি টাকার পাথর ব্যবসা। এসারুল এক সময় দিনমজুরের কাজ করতেন। সে বক্করের বিশ্বস্ত বন্ধু। দুটি ট্রাক্টর, জমি, পাথরের ব্যবসাসহ এখন প্রায় ১০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক সে। আর শেখ ফরিদও আগে ছিল শ্রমিক। ২০ একর জমিতে তার নিজস্ব চা বাগান, ৩টি ট্রাক ও মজুদ পাথরসহ সে এখন ৫০ কোটি টাকার মালিক। তেঁতুলিয়ার শালবাহান ও মাঝিপাড়া এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন শেখ ফরিদ। আর ভজনপুর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার নিয়ন্ত্রণ করে বক্কর ও এসারুল। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভজনপুর এলাকার আশরাফুল ইসলাম, সালাম, রুবেল, ঢিপা ও মেহের আলী। গোলাব্দিগছ ঘাটে সুমন, কালাম ও মোমিনের নেতৃত্বে চলে ড্রেজার, দক্ষিণ গণাগছে রুবেল ও স্থানীয় ইউপি সদস্য জাহিদ হোসেন, উত্তর গণাগছে এসারুল, আলমগীর ও আশরাফুল, ঘগারখালে জলিল, আরিফ ও মোতালেব মাস্টার, কুকুরমুহায় জাহাঙ্গীর, আব্দুর রহিম ও মশিবুল, ধানশুকা ঘাটে নাজিম, ঝালেঙ্গিগছে রেজাউল, মশারুল ও ইউনুস, কালিয়ামনিতে সালেক, পীরের ডাঙ্গায় নাসিরুল, শিবচন্ডি ঈদগায় শেবা, জয়গুনজোতে আবু। শুকানি দোমুখায় খোকা ও আলম, আঠারোখারিতে কলিম উদ্দিন, পাথরঘাটায় জাহিদুল মেম্বার, শিয়ালখাওয়ায় আবু বক্কর ও এনতা, সিপাইপাড়া চায়না বাগানে এশিয়ার, আবু বক্কর, সিপাইপাড়া লিচু বাগানে কালাম ও রহিম, ভদ্রেশ্বর শিবমন্দিরে আলম, ভদ্রেশ্বর ঈদগায় হামিদ, ফকিরহাট দোমুখায় হামিদ ও সুবাস, ভুসমারী এলাকায় কাজল এবং কীর্তনপাড়া, শান্তিনগর, ভাঙ্গিপাড়া ও বাঁশবাড়ি এলাকায় ড্রেজারে নেতৃত্ব দেন ভজনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোকছেদ আলীর স্বজনরা। জানা গেছে, লাইনম্যান ও মূল হোতা বক্কর, এসারুল ও ফরিদের নামে ড্রেজারের বিভিন্ন মামলা রয়েছে। শেখ ফরিদের একার বিরুদ্ধেই রয়েছে ড্রেজার বিষয়ক ৯টি মামলা। লোক দেখানো পুলিশ ধরলেও দুদিনেই জামিনে বেড়িয়ে আসেন তারা। বন্ধ হয়ে গেছে নদীর গতিপথ ॥ বিভিন্ন নদীর মাঝখানে ড্রেজার দিয়ে পাথর উত্তোলন করে নদীতেই বালু ফেলে রাখা হয়। এতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে যা আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থী। ইতোমধ্যে ডাহুক নদীর গতিপথ বন্ধ হয়ে গেছে। একই অবস্থা করতোয়া নদীটিরও। এছাড়া অনেক স্থানে ড্রেজারের খনন করা খালে পার্শ্ববর্তী সমতলের ফসলি জমি ভেঙ্গে পড়ছে। ভজনপুর বাজার থেকে ভূতিপুকুর সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার গ্রামরক্ষা বাঁধটির চিহ্ন মুছে ফেলেছে ড্রেজার মালিকরা।
×