ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চৈত্রের শুরুতেই গ্রীষ্মের দাবদাহ, বাড়ছে রোগবালাই

প্রকাশিত: ০৯:৪০, ২৩ মার্চ ২০১৯

  চৈত্রের শুরুতেই গ্রীষ্মের দাবদাহ, বাড়ছে রোগবালাই

নিখিল মানখিন ॥ চৈত্রের শুরুতেই সারাদেশে অনুভূত হচ্ছে গ্রীষ্মের তীব্র গরম। খরতাপে ব্যাহত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগবালাই। ঘরে-বাইরে সবখানেই বিরাজ করছে হাঁসফাঁস অবস্থা। তাপমাত্রা বাড়তে থাকা অবস্থায় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য হ্রাস পাওয়ায় রাজধানীতে তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। আগামী কয়েকদিন তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। এপ্রিলে সৃষ্টি হতে পারে একটি ঘূর্ণিঝড়, বইবে তীব্র তাপপ্রবাহ। তখন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে। আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, এপ্রিলে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। এ মাসে বঙ্গোপসাগরে দু/একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে ৩-৪ দিন বজ্রসহ মাঝারি/তীব্র কালবৈশাখী/বজ্র-বৃষ্টি ও অন্যত্র ৪ থেকে ৫ দিন হালকা/মাঝারি কালবৈশাখী/ বজ্রঝড় হতে পারে। এপ্রিলে দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলে একটি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্যত্র এক থেকে দুটি মৃদু/মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। মে মাসে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্ন চাপের মধ্যে অন্তত একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। দেশের উত্তর, উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে ২ থেকে ৩ দিন বজ্রসহ মাঝারি/ তীব্র কালবৈশাখী/বজ্র-ঝড় ও দেশের অন্যত্র ৩ থেকে ৪ দিন হালকা/মাঝারি কালবৈশাখী/ বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। মে মাসে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ২ থেকে তিনটি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্যত্র ২ থেকে তিনটি মৃদু /মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। চৈত্রের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশের অধিকাংশ জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৩ থেকে ৩৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস রেকর্ড হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ঢাকায় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও। শুক্রবার ঢাকায় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয় যথাক্রমে ৩৪ ও ২৪.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। দেশে বৃষ্টিপাত নেই বললেই চলে। খা খা করছে দেশের মাঠ প্রান্তর। খাল-বিল, নদী-নালা ও জলাশয় শুকিয়ে পানিশূন্য। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশিসহ নানা মৌসুমি জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ভাইরাসজনিত রোগের বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। রাজধানীর আকাশে নেই স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত। দিনে তীব্র রোদ। গরমে অতিষ্ঠ নগরজীবন। ব্যাহত হচ্ছে নগরবাসীর স্বাভাবিক কাজকর্ম। অথচ প্রখর রোদ উপেক্ষা করেই চলতে হয় পথচারীদের। এত অস্বাভাবিক গরমে পরিবহনগুলোর ভেতরের তপ্ত পরিবেশে অস্থির হয়ে ওঠে যাত্রীরা। দাবদাহে জর্জরিত মানুষের কাছে বেড়ে যায় ঠান্ডা পানীয়ের চাহিদা। ঢাকায় গত এক সপ্তাহের তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩১ ডিগ্রী থেকে ৩৪ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে থাকছে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২২ থেকে ২৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস রেকর্ড হচ্ছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, তাপমাত্রা বেশি থাকে, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কমে আসে, এমন পরিস্থিতিতে গরমের তীব্রতা বেশি অনুভূত হয়ে থাকে। বর্তমানে ঢাকায় বিরাজ করছে অস্বস্তিকর পরিবেশ। রাজধানীর মোড়ে মোড়ে ডাবের পানি, লেবুর শরবত, কুল ও পেয়ারার আচার বিক্রি অনেক বেড়েছে। শাহবাগ মোড়ে একের পর এক ডাব বিক্রি করে চলেছেন সবুর। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, কিছুদিন আগেও ডাবের কদর তেমন ছিল না। কম দামেও ক্রেতা পাওয়া যেত না। গরম বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে ডাবের কদর ও দাম। একেকটি ডাব ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়। হাসি ফুটেছে মগবাজার রেলগেটের পাশে দোকান সাজানো জব্বার আলীর মুখেও। দু’দিন ধরে তিনি স্বাভাবিক দিনের চেয়ে দ্বিগুণ ডাব বিক্রি করতে পারছেন। বেড়েছে ক্রেতার সংখ্যা। এই গরমে যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে লেবুর শরবত। ওসব ভাসমান দোকানে বরফ মজুদের ব্যবস্থাও রয়েছে। ঠা-া লেবুর শরবত খেয়ে ক্লান্তি দূর করছেন অনেকেই। ফার্মগেটে বিজ্ঞান কলেজের সামনে ভাসমান দোকান সাজিয়েছেন সাজ্জাদ। তিনি জানান, গরমে এই লেবুর শরবতের চাহিদা বেড়ে যায়। এটি আমার মৌসুমি ব্যবসা। শীতকালে এই ব্যবসা চলে না। গরম যত বাড়বে, তত বেশি লেবুর শরবত বিক্রি হয়। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে দোকান চালু করেছি। ক্রেতার সাড়াও পাচ্ছি। আশা করি, এবারও ব্যবসা ভাল হবে। মার্চে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন আবহাওয়াবিদরা। এমন অবস্থায় হিটস্ট্রোক ও ডায়রিয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। গত বছর সময়ে হিটস্ট্রোকে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটে। রাজধানীতে ইতোমধ্যে তাপমাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন করে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। তাপমাত্রা বাড়লে ডায়রিয়া জীবাণুর সংক্রমণের ক্ষমতা বেড়ে যায়। এমন অবস্থায় চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়রিয়ামুক্ত থাকতে পানি ফুটিয়ে খেতে হবে। আর হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আগেই সতর্ক থাকতে হবে। দীর্ঘক্ষণ রোদে থাকা যাবে না। অতি প্রয়োজন না হলে রোদ এড়িয়ে চলতে হবে। রোদে কাজ করার সময় মাথা ও শরীরে ঢাকনা দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রচুর তরল জাতীয় কিছু খেতে হবে। ঢিলে ঢালা পোশাক, বিশেষ করে সুতি কাপড় পরতে হবে। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তাকে ছায়াচ্ছন্ন স্থানে শুইয়ে দিতে হবে। ঠা-া পানি (রেফ্রিজারেটরের পানি নয়) দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। এতে উন্নতি না হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ও ইউনিট প্রধান ড. শাহাদাত হোসেন বলছেন, তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের ওপরে গেলেই হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে এ দেশে। যতটা সম্ভব প্রখর রোদ এড়িয়ে চলতে হবে। বেশি করে পানি পানের পরামর্শ দেন তিনি। আবহাওযা অফিসের পরামর্শও প্রায় একই। ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের তাপমাত্রা এদেশের মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এর ওপরে চলে গেলে তা হবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, যা অবর্ণনীয় অবস্থার কথাই জানান দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আগেই সতর্ক থাকতে হবে। দীর্ঘক্ষণ রোদে থাকা যাবে না। প্রচুর তরল বিশেষ করে ‘ওরস্যালাইন’ খেতে হবে। ঢিলেঢালা জামা কাপড় পরতে হবে। আর হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তাকে ছায়ায় নিতে হবে। ঠা-া জলে শরীর মুছে দিতে হবে। এতে আক্রান্তের অবস্থার উন্নতি না হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। তিনি বলেন, হিটস্ট্রোকে আক্রান্তের আগে শরীরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক অবস্থার বেশি থাকবে। শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। বমি বমি ভাব দেখা দেবে। মাথা ঘুরবে। প্রস্রাব কমে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তের চাপও কমে যাবে। এসব লক্ষণ দেখা দিলেই ছায়াচ্ছন্ন স্থানে দ্রুত বিশ্রাম নিতে হবে। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আগেই বিশেষ সতর্ক থাকার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন তিনি।
×