ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ছবির ক্যানভাসে উইন্ড টারবাইন ফার্ম

প্রকাশিত: ১২:৩৮, ২২ মার্চ ২০১৯

ছবির ক্যানভাসে উইন্ড টারবাইন ফার্ম

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু।’ কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের এই বিখ্যাত কবিতাটির দুটি লাইন হঠাৎ মনে হলো আর লিখে ফেললাম এমনটি নয়। ঘরের কাছেই আছে একটা বিশাল আকার ও আকৃতির উইন্ড টারবাইন ফার্ম। প্রতিদিন কত লোক যে এই ফার্ম দেখতে আসে তার কোন হিসাব আমার কাছে নেই। থাকলে বলতে পারতাম কি আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থাপনার পাশে ঘর বেঁধেছি। তাই অনেকদিন থেকেই ভাবছি একটা উইন্ড টারবাইন ফার্মও কি ভ্রমণের বিষয় হতে পারে? আর তাকে নিয়ে একটা ভ্রমণালেখ্য লিখে ফেলা যায়? অবশ্যই যায়। না হলে কেন হাজার হাজার লোকের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে এর প্রাঙ্গণ। প্রথম যেদিন এই ফার্মের আঙ্গিনায় পা রেখেছিলাম সেদিনের গুরুত্ব তেমন করে বোঝার চেষ্টা করিনি। এরপর যতদিন গেছি বোঝার চেষ্টা করেছি কেন এত লোকের সমাগম হয় এই ভিজিটর সেন্টারে? সুতরাং সহজেই অনুমান করা যায় কি বিশাল কর্মযোগ্য চলে এই ফার্মকে ঘিরে। এবার বলি এখানকার প্রধান আকর্ষণ হলো এই ভিজিটর সেন্টার। যেখানে বসে সকলে রসনা তৃপ্তির পাশাপাশি বাড়তি পাওনা, বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা টারবাইনগুলোর প্যানোরমিক দৃশ্য অবলোকন করা। ইউকের সর্বোবৃহৎ এবং ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই উইন্ড ফার্ম গ্লাসগো শহর থেকে মাত্র ১৫ মাইল দূরে। আশ্চর্যজনক এক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার জন্য হোয়াটলি উইন্ড ফার্মে আপনাদের স্বাগতম। বিশেষ করে এখানকার ভিজিটর সেন্টারে। বিনা খরচে ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সারাটা দিন কাটানোর একটা চমৎতার পরিবেশ। এখানকার ২১৫টা টারবাইন থেকে প্রতিদিন ৫৩৯ মেঘাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হয় বাতাসের দ্বারা। পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য এনার্জি। তাহলে সহজেই অনুমান করা যায় কি বিশাল কর্মযোগ্যের আয়োজন করা হয়েছে এই ফার্মে। তাই তো হাজার হাজার মানুষের ভিড় এই স্থানটিতে। আসলে ভিজিটর সেন্টারকে এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যে, মূল আকর্ষণই হলো এই সেন্টার। এখানে একদিকে যেমন আছে ফার্মের ডেমোসহ নানা কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু, তেমনি অপরদিকে সকল বয়সের উপযোগী করে স্থানীয় লোকদের তৈরি করা লোকাল খাবারের সমাহার। আছে গরম ঠা-া পানীয় দ্বারা অতিথি আপ্যায়নের সুবন্দবস্থ। এক কাপ বা গ্লাস পানীয় নিয়ে বসে গেলেন উন্মুক্ত আকাশের তলায় পিকনিক বেঞ্চের ওপর। অবশ্য যদি সূর্যমামা সহায় থাকে! চুমুকের ফাঁকে ফাঁকে চোখ বোলালেন ৫৫ স্কয়ার কিলোমিটারের বিস্তৃতি নিয়ে গড়ে তোলা আকাশচুম্বি টারবাইনগুলোর পাখার ঘূর্ণির জালে। দূর থেকে কিছুই বোঝার উপায় নেই কি তার বিশালত্ব। কাছে গেলে মাথা ঘুরে যায়। কানে লাগে তালা। বাতাসের তীব্রতার উপর নির্ভর করে ১০০ মাইল বা ১৬০ কিলোমিটার গতিতে পাখাগুলো ঘুরছে আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যায় শব্দের তীব্রতাও। সব থেকে বড় আকারের এক একটা অফশোর টারবাইনের উচ্চতা মাটি থেকে ১২০ মিটার। তবে সাগরের মাঝে যে টারবাইন বসানো হয় সেগুলোর উচ্চতা ২২০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। আর পাখার দৈর্ঘ্য ৪০ মিটার। সর্বোচ্চ বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষমতা ৩.৫ মেগাওয়াট। যার দ্বারা এক হাজার গৃহস্থালিতে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো যায়। ডাঃ প্রীতিলতা ও আমি একটা তথ্য এখানে জানিয়ে রাখা প্রাসঙ্গিক মনে করছি এই কারণে যে, যুক্তরাজ্য সরকার পরমাণবিক চুল্লি থেকে বিদ্যুত উৎপাদনকে আর অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখতে চাচ্ছে না। তারা এখন পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক উৎস থেকে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর দিকে বেশি নজর দিচ্ছে। তারই কারণে আজ এদেশের সরকার স্কটল্যান্ডকে বেছে নিয়েছে। কারণ ইউরোপের মধ্যে সব থেকে বেশি বাতাসের প্রবাহ এই স্কটল্যান্ডে। এর পাশাপাশি গবেষণা চলছে সাগরের ঢেউকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে বিদ্যুত উৎপাদন করা যায়। অচিরেই এই প্রকল্প সাফল্যের মুখ দেখতে যাচ্ছে। আর এসব প্রকৃতি ভিত্তিক উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতকে বলা হচ্ছে নবায়নযোগ্য এনার্জি। ভিজিটর সেন্টারে প্রবেশ মুখে বিশাল পার্কিং। ব্লু ব্যাজ ধারি স্বেচ্ছাসেবকরা সদা প্রস্তুত আপনাকে সাহায্য করার জন্য। আছে ইলেক্ট্রিক গাড়িতে চার্জ দেয়ার ব্যবস্থাসহ ঘোরার জন্য বিশেষ বক্সের আয়োজনও বাদ যায়নি। এবার আসি আউটডোর এক্টিভিটিজের কথায়। যারা এ্যাডভেঞ্চার করতে ভালবাসেন তাদের জন্য মজার মজার আয়োজন। ঘোড়ায় চড়ে ১৩০ কিলোমিটার ট্রাকে দৌড়ে বেড়ানো, সাইকেল চালিয়ে উপভোগ করা প্রকৃতির অপারদানে সমৃদ্ধ পুরো ফার্মটি। আর হেঁটে বেড়াতে নেই মানা। দল বেঁধে কিংবা মেয়ে বন্ধুর আঁচল, স্যরি আঁচল তো নেই হাত ধরে হেঁটে বেড়াতে কতই না মজা। ভয় নেই এসবের কোনটাই যার পছন্দের তালিকায় নেই তার জন্য আছে বাস ট্যুরের আয়োজন। ফার্মের রেঞ্জারা সারা বছর কোন না কোন ইভেন্টের আয়োজন করে থাকে যার অধিকাংশই বিনা মূল্যে। সুতরাং কোন অবস্থায় এই উইন্ড ফার্মের সার্বিক কার্যক্রমকে উপভোগ না করার অজুহাত কাজে আসবে না। এখানেই শেষ নয়, এই ভিজিটর সেন্টার গ্লাসগো বিজ্ঞান কেন্দ্র দ্বারা পরিচালিত এবং তাদের দক্ষ কর্মীরা সর্বক্ষণ আপনার সকল প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য সদা প্রস্তুত। এতক্ষণ নিরস বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম এবার একটু বিনোদন নিয়ে কথা বলতেই হয়। সেদিন দুজনে বেরিয়ে পড়লাম হাঁটার পরিকল্পনা নিয়ে। বাড়ির আঙ্গিনা পার না হতেই তো চোখে পড়ে আকাশচুম্বি সব টারবাইনগুলো স্বশব্দে ঘূর্ণায়মান অবস্থায়। বাতাসের অনুকূলে শব্দের মাত্রা মাঝে মধ্যে এতটাই প্রকট হয়ে উঠে যে, প্রলয়ঙ্করী কোন ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। আর সে কারণে এই টারবাইনগুলো যেন স্থানীয়দের বিরক্তির কারণ না হয়ে দাঁড়ায় সে দিক বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ দুরুত্বে এদের নির্মাণ করা হয়েছে। তবুও সব সময় যে পরিত্রাণ পাওয়া যায় তা কিন্তু নয়। সীমানা পার না হতেই চোখে পড়ে যায় আকাশচুম্বি সব টারবাইনগুলো। সব থেকে কাছেরটাকে লক্ষ্য করে হাঁটা শুরু করলাম কিন্তু পথ যে আর শেষ হতে চায় না। টারবাইনটার গোঁড়ায় যেতে যেতেই আর যাওয়া গেল না। পথটা অন্যদিকে বেঁকে গেছে। সেই পথ ধরেই হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু পথের তো আর হয় না শেষ। এ যে জনমানববিহীন গহীন অরণ্য। একটু একটু শিহরণ যে মনে দানা বাঁধেনি তা কিন্তু নয়। গিন্নি তো বারে বারেই বলছে চলো ফিরে চলো। তাকে বললাম চলো না, পথের শেষটা না দেখে গেলে মনের শঙ্কাটা থেকেই যাবে। আর ভাগ্য যদি সুপ্রসন্ন হয় তবে দেখা মিলে যেতে পারে আমাদের সব থেকে কাছের প্রতিবেশী হরিণের দলের সঙ্গে। এরা তো লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের রান্না ঘরের আঙিনায় কচি ঘাস খেতে চলে আসে। আজ না হয় ওদের আস্তানায় আমরা হানা দিই। কিন্তু হায় পায়ে চলা জঙ্গলের পথে, দেখা হলো না কারও সঙ্গে। আসলে বনের এই জায়গাটুকুতে গভীরতা এতটাই বেশি যে এই ভর দুপুরেও ভয় পেতে কোন অভয়বাণী কাজে আসবে না। তবে আশার কথা হলো এই বনে কোন হিং¯্র প্রাণী বা সাপের ভয় নেই। এখানে গাছের ডালপালা পাতালতাগুলোর ঘনত্ব এতটাই বেশি যে বনের মধ্যে আলো জালিয়ে চলার মতো অবস্থা। এরই মাঝে আমরা প্রায় দুই মাইল পথ অতিক্রম করে ফেলেছি। আসলে এই পথ তৈরি করা হয়েছে যারা প্রকৃতির নৈসর্গিক সান্নিধ্য লাভের পাশাপাশি শরীর চর্চা ও হাঁটতে আনন্দ পান তাদেরই জন্য। অবশেষে পথেরও সন্ধান পাওয়া গেল। বনের মধ্যে হাঁটতে গিয়ে যে গল্পটা বলা হলো না সেটাই তো সব থেকে আকর্ষণীয়। সেটা হলো ঝরনা। নাম না জানা সে নদীর কোথায় জন্ম, কোথা দিয়ে এসেছে আর কোথায় গিয়ে মিশেছে, সবকিছুই অজানা। তবে আমি তার নাম দিয়েছি আমাদের কপোতাক্ষ। ছোট বড় পাহাড়ের পাদদেশ ভেদ করে, এঁকে বেঁকে চলতে গিয়ে থমকে গেছে সেই খানে, যেখান থেকে লাফ দিতে হয়েছে অনেক দূরে, অনেক নিচে। তাই নাম হয়েছে তার ওয়াটার ফলস। চলতে ফিরতে দেখা হয় প্রতিদিন আর কথা হয় সারা রাতদিন। কি কান ফাটা তার অবিরাম চিৎকার, আর চেঁচামেচি শোনা যায় যদি ঝরনার কাছে যাওয়া যায়। যেদিন বর্ষা হয় সেদিন যেন যৌবন ফিরে পায়। তখন তাকে দেখে মনটা ভরে যায়। মন ভাল থাকলে, খারাপ হলেও কোন সমস্যা নেই। মন খারাপকে ভাল করে আর ভাল মন আরও ভাল হয়ে যায়। প্রকৃতির কাছে মানুষ যে কতভাবে ঋণী তার কোন হিসাব নেই। এমনি করেই সেদিন কেটে গেল টারবাইন দেখার পর্ব। তবে টারবাইন ফার্মের সবকিছু উপভোগ করার এখনও অনেকটাই বাকি। সময় সুযোগ পেলে সে আশাটাও পূর্ণ করতে পারব আশা করি।
×