ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আসছে বাঙালীর নতুন বছর, বরণের রং লেগেছে চারুকলায়

প্রকাশিত: ১১:১২, ২০ মার্চ ২০১৯

আসছে বাঙালীর নতুন বছর, বরণের রং লেগেছে চারুকলায়

মোরসালিন মিজান ॥ বৈশাখের এখনও অনেক বাকি। কিন্তু বাঙালীর বর্ষবরণের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। মহা উৎসব যে! লম্বা সময় ধরে কাজ করতে হয়। আর এ কাজের ছবিটা বিশেষ দৃশ্যমান হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। প্রতিবারের মতো এবারও এখানে শুরু হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি। মঙ্গলবার জয়নুল গ্যালারির সামনে প্রস্তুতি পর্বের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এ উপলক্ষে দারুণ উৎসবমুখর হয়ে ওঠে পুরো প্রাঙ্গণ। বৈশাখের ঢাক বেজে ওঠে হঠাৎ করে। তাতেই বেজে ওঠে বাঙালী মন। চারুকলার শিক্ষার্থীরা নেচে গেয়ে মাতিয়ে রাখেন। লোক ঐতিহ্যের মুড়ি মুড়কি বাতাসা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় সকলকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রস্তুতি পর্বটিও ক্রমে উৎসবের রূপ পাবে। শহর ঢাকার মানুষ সুযোগ পেলেই ছুটে যাবেন চারুকলায়। নিজের মতো করে যোগ দেবেন আনন্দযজ্ঞে। বৈশাখের আগের রাত পর্যন্ত চলবে বর্ণাঢ্য এই প্রস্তুতি। বাংলা নববর্ষ বরণের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে এই শোভাযাত্রা বের করা হয়। বাঙালীর হাজার বছরের সংস্কৃতি ও লোক চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে চলে আকর্ষণীয় র‌্যালি। সব বয়সী মানুষ এতে যোগ দেন। রাজধানী শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে চারুকলায় এসে শেষ হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। এবারও ব্যতিক্রম হবে না। আয়োজনটি আরও বর্ণাঢ্য করতে কাজ করছেন আয়োজকরা। মূল দায়িত্ব পালন করছে চারুকলার ২১তম ব্যাচ। ব্যাচের উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হবেন সাবেক ছাত্র ছাত্রীরা। সিনিয়র শিল্পীরা সম্পৃক্ত হবেন। কেউ ছবি আঁকবেন। কেউ আঁকবেন সরাচিত্র। মুখোশ পাখি ফুল ইত্যাদি তৈরি হবে। শিল্পকর্ম বিক্রির টাকায় আয়োজন করা হবে মূল শোভাযাত্রা। আকর্ষণীয় শোভাযাত্রায় ফুল পাখিসহ বিভিন্ন প্রাণীর মোটিভ ব্যবহার করা হবে। সে লক্ষ্যে আগেভাগে কাজ শুরু করেছে চারুকলা অনুষদ। উদ্বোধনী দিন দুপুরের দিকে অনুষদে গিয়ে দেখা যায়, জয়নুল গ্যালারির সামনের খোলা জায়গাটিকে আলাদা করে ঘিরে নেয়া হয়েছে। চলছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার কাজ। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই ঝাড়ু হাতে নেমে পড়েছিলেন। তারপর একাধিক টেবিল পেতে সেখানে সাজিয়ে রাখা হয় রং-তুলি। এরই মাঝে কে যেন বলেন, কোথায়? ঢাক ঢোল কিছু বাজছে না কেন? অমনি বেজে ওঠে লোক সুর। উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। তাতেই ছুটে আসতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। দেখতে দেখতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় নির্ধারিত স্থানটি। ছাত্র ছাত্রীরা একে অন্যের হাত ধরে নাচতে থাকেন। অন্যদিকে চলে মুড়ি-মুড়কি দিয়ে আপ্যায়নের প্রস্তুতি। কিছু সময়ের মধ্য বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী, শিশির ভট্টাচার্যসহ অন্যদের সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হন চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন। সকলেই একটি ক্যানভাসে স্বাক্ষর করে প্রস্তুতি পর্বের সূচনা করেন। তখন আবারও ঢাক ঢোল বেজে ওঠে। শুরু হয়ে যায় নাচ গান। আগে থেকে প্রস্তুত রাখা মুড়ি মুড়কি বাতাসা দারুণ আকৃষ্ট করছিল। অনেকে খুঁজে নিয়ে মুখে দেন। একে অন্যকে খাইয়ে দিতে দেখা যায়। এভাবে একটা আনন্দঘন শুরু। অবশ্য এদিন ছবি আঁকেননি কোন সিনিয়র শিল্পী। পরবর্তী কোন একদিন সকলে একত্রিত হয়ে তারা ছবি আঁকবেন বলে জানা গেছে। এ দলে থাকবেন মুস্তাফা মনোয়ারের মতো খ্যাতিমান শিল্পীও। মূলত এই কাজগুলো থেকে বড় অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করে থাকেন আয়োজকরা। বিকেলে কোন কোন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর ছবি আঁকতে দেখা যায়। ছাত্র প্রতিনিধি ও শোভযাত্রা প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক তন্ময় দেবনাথ জানান, প্রতিদিনই এভাবে ছবি আঁকা হবে। বিক্রি হবে। শিক্ষার্থীদের আগ্রহের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রায় সকল শিক্ষার্থী এ সময়টির জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। এবারও বৈশাখ সামনে রেখে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের প্রস্তুতি চলছিল। গত সোমবার শিক্ষক শিক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিক মিটিং হয়। এর প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজের শুরু হলো। চারুকলা অনুষদের ২শ’র মতো শিক্ষার্থী প্রতিদিন কাজ করবেন বলে আশা করছেন তিনি। এদিকে, উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে শিক্ষক ও বরেণ্য শিল্পীরা চলে আসেন চারুকলা অনুষদের ডিনের কক্ষে। এখানে বসে কথা হয় অনুষদের মূল দায়িত্বে থাকা নিসার হোসেনের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, প্রতিকৃৎ শিল্পীরা যে চেতনা থেকে চারুকলা অনুষদ গড়েছিলেন, যে চেতনা সামনে রেখে কাজ করে গিয়েছেন আমরা সেই চেতনা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, অসাম্প্রদায়িক লোক চেতনাকে ধারণ করে আয়োজন করা হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রার। এবারের আয়োজনের থিম কী হবে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত বেশ কয়েক বছর ধরেই আমরা নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। নানা সঙ্কট এসেছে। ষড়যন্ত্র হয়েছে। কোন কোন সময় অপশক্তি আমাদের জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। তবে বর্তমানে ওই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে এসেছি আমরা। এখন সুন্দর সময়। থিম ঠিক না করলেও বলতে পারি, পজিটিভ কিছুই সামনে রাখা হবে এবার। আশার কথা স্বপ্নের কথাই প্রধান হয়ে উঠবে। জীবনের জয়গান করব আমরা। স্ট্রাকচারাল ফর্মগুলো কেমন হবে এবার? সংখ্যায় বাড়বে না কমবে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মিনিমাম একটা সংখ্যা তো থাকেই। বিভিন্ন প্রাণীর পাখির পুতুলের বড় বড় ফর্ম তৈরি করা হয়। সংখ্যায় পাঁচটার কম হয় না। এবারও বাড়বে বৈ কমবে না। একইসঙ্গে আয়োজনটি খুব জাঁকজমকপূর্ণ হবে বলে জানান তিনি। একই দিন কথা হয় বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবীর সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আশির দশকে আমি যখন চারুশিল্পী সংসদের সভাপতি ছিলাম তখন থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের শুরু। সে সময় অনেক কার্টুন আঁকতাম। মোটামুটি পরিচিত ছিলাম। শোভযাত্রা আয়োজনের জন্য ফান্ড কালেক্ট করার দায়িত্বটা বলা চলে আমার ওপরে পড়ে গিয়েছিল। বলতে পারেন, চাঁদাবাজের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। এখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। চারুকলার শিক্ষক শিক্ষার্থীরা, সিনিয়র শিল্পীরা একসঙ্গে ছবি আঁকছেন। এগুলো বিক্রি করে যে টাকা আসছে তা দিয়ে শোভাযাত্রা আয়োজনের খরচ মেটানো হচ্ছে। তিনি বলেন, আস্তে আস্তে আয়োজনটির শ্রী বৃদ্ধি ঘটেছে। বড় হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় এসেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। তবে এর চেয়ে বড় অর্জনÑ লক্ষ লক্ষ মানুষের অংশগ্রহণ। তারা ভালবেসে আয়োজনটির সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত হন। এমনি এমনি কেউ আসেন না। নিজের সংস্কৃতির প্রতি টান থেকে আসেন। সমর্থন জানাতে আসেন। শিল্পীরাও এসব দিক মাথায় রেখে দিন রাত কাজ করেন। শিক্ষকরা ছাত্ররা তাদের সময় ও মেধা বিনিয়োগ করেন। পুরো বিষয়টি আনন্দের এবং উপভোগ্য বলে মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, অনেকে মনে করেন আমরা একদিন মাত্র উদ্যাপন করি। আসলে তা নয়। বছরের প্রথম দিনে আমরা একটা বর্ণাঢ্য শুরু করি মাত্র। সারা বছরই এ আয়োজন আমাদের প্রভাবিত করে। লোক ঐতিহ্য ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি ও সাহস যোগায়।
×