ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

বঙ্গবন্ধুর এবারের লন্ডন সফর

প্রকাশিত: ০৮:৪৩, ২০ মার্চ ২০১৯

বঙ্গবন্ধুর এবারের লন্ডন সফর

এ বছর ২০১৯ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লন্ডন আগমন আমার কাছে সবচাইতে প্রাণবন্ত মনে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তো বেঁচে থাকতেও লন্ডনে এসেছেন। ১৯৭৫ সালের সম্ভবত মে মাসে জ্যামাইকার রাজধানীতে কমনওয়েথ শীর্ষ সম্মেলন শেষে ফিরে যাওয়ার পথে লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টে যাত্রা বিরতি ঘটিয়েছিলেন। কয়েক ঘণ্টার যাত্রা বিরতি। তিনি ভিভিআইপি লাউঞ্জে অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানদের মতো সময় কাটাতে পারতেন। ব্রিটিশ সরকার তাকে বিমানবন্দরে অবস্থানের জন্য রানীর ব্যবহৃত কুইন্স লাউঞ্জ ছেড়ে দেন। লন্ডনে তাকে বিরল সম্মান দেখানো হয়েছিল। এবার বঙ্গবন্ধু নশ্বর দেহে লন্ডনে আসেননি। কিন্তু মনে হচ্ছিল তার জন্মদিনের প্রতিটি উৎসবেই তিনি উপস্থিত। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। লন্ডনে আসার পর প্রতিবছর আমি বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের সভায় উপস্থিত থেকেছি। এবারেও থেকেছি। কিন্তু এবারের মতো এত প্রাণবন্ত উৎসব এবং তাতে এত শিশুর যোগদান আগে কখনও দেখিনি। আমি বাংলাদেশ দূতাবাসের অনুষ্ঠানসহ যে কটি অনুষ্ঠানে গেছি, তাতে এবার দলমত নির্বিশেষে বিশিষ্ট মানুষের ভিড় দেখেছি। আমার মনে হয়েছে এসব অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু স্বয়ং উপস্থিত আছেন। এ জন্যই লিখেছি বঙ্গবন্ধুর এবারের লন্ডন সফর আমার কাছে সবচাইতে প্রাণবন্ত মনে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটেনের টোরি, লেবার এবং লিবারেল এই তিন দলের নেতারাই শ্রদ্ধা করতেন। নেহরু ও নেলসন ম্যান্ডেলা ছাড়া আফ্রো-এশিয়ার আর কোন নেতা এই শ্রদ্ধা ও সম্মান পেয়েছেন বলে আমার জানা নেই। ১৯৭২ সালে ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশ যাত্রার পথে লন্ডনে এলে তখনকার টোরি প্রধানমন্ত্রী এডোয়ার্ড হীথ নিজে হিথরো বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছিলেন তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। লেবার দলীয় প্রধানমন্ত্রী হ্যারাল্ড উইলসনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতা এতই বেড়েছিল যে, তারা পরস্পরকে ফার্স্ট নেম ধরে ডাকতেন। উইলসন সব সময় পাইপ ঠোঁটে রাখতেন। বঙ্গবন্ধুকে ডাকতেন মুজিব। আর বঙ্গবন্ধুর ঠোঁটেও থাকতো পাইপ। উইলসনকে ডাকতেন হ্যারল্ড। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলে উইলসন শোক বাণীতো দেনই, তার ওপর যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের তখনকার সভাপতি গউস খানের কাছে লেখা চিঠিতে বলেন, ‘Sheikh mujbs death is a great national tragedy for you, but it is a personal tragedy for me.’ এটা তোমাদের জন্য বিরাট জাতীঠ ট্রাজেডি, কিন্তু আমার জন্য ব্যক্তিগত ট্রাজেডি। রানী এলিজাবেথ বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাতদান করেন। সাম্প্রতিক কালেও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যখন কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে যান, রানী এলিজাবেথ তিন মহিলা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা ফটোসেশন করেন। এই তিন মহিলা প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে শেখ হাসিনাও ছিলেন। লন্ডনে মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা প্রমুখ মহানেতাদের ভাস্কর্য আছে। বঙ্গবন্ধুর ছিল না। বছর দুই আগে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইস্ট এন্ডের সিডনি রোডে একটি আবক্ষ ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশী-বিদেশী বহু ভিজিটর প্রায় প্রতিদিন এই ভাস্কার্যটি দেখতে ভিড় জমায়। দিন দিন ভিড় বাড়ছে। এই ভাস্কর্যটির প্রতিষ্ঠাতা বৃহত্তর সিলেটের আফসার খান সাদেক যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের একজন নেতা। এই ভাস্কর্র্যটি তার বাড়ির সামনে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে বার কাউন্সিলের অনুমোদন নিয়ে স্থান করলেও স্থানীয় বাংলাদেশী জামায়াতী এবং বিএনপি সমর্থকদের কেউ কেউ এই ভাস্কর্য অপসারণের জন্য চেষ্টা তদ্বির করে। এমনকি মামলা মোকদ্দমাও হয়। কিন্তু এলাকার সকল বর্ণ এ ধর্মের মানুষের সমর্থনের ফলে এই ভাস্কর্য সরানো সম্ভব হয়নি। এখন শুধু বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে নয়, প্রায় প্রতিদিনই ক্যামেরা হাতে টুরিস্টদের এই ভাস্কর্যের ছবি তুলতে দেখা যায়। ব্রিটিশ টুরিস্ট গাইডেও লন্ডনের দর্শনীয় স্থান হিসেবে সিডনি স্ট্রিটের নাম উঠে এসেছে। এ বছর বঙ্গবন্ধুর ৯৯তম জন্মবার্ষিকীতে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম দশ বারোটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার। তা একদিনে সম্ভব নয়। শুধু লন্ডন শহরে নয়, ব্রিটেনের অধিকাংশ বড় বড় শহরে দিনটি পালিত হয় এবং এবারেও হয়েছে। তবে আরও বড় করে এবং সাড়ম্বরে। সব অনুষ্ঠানে যাওয়া অসম্ভব। তাই বাছাই করে ঠিক করলাম তিনটি অনুষ্ঠানে যাব। বাংলাদেশ দূতাবাস, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে এবং সিডনি স্ট্রিটে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করব। লন্ডনের বাংলাদেশ দূতাবাসে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আমলে জাতির পিতার জন্মদিন অথবা মৃত্যু দিবস পালন করতে দেয়া হতো না। দেশে গণতন্ত্র নিয়ে আসার পর হাসিনা সরকারের আমলে আবার এই দিবস পালন শুরু হয়। আমি লন্ডনে থাকি। তাই বাংলাদেশ দূতাবাসে এই জন্মদিবস পালন শুরু হলে অধিকাংশ অনুষ্ঠানেই থেকেছি। তার মধ্যে এবারের অনুষ্ঠানটি ছিল সবচাইতে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এর আগে দূতাবাসের একটি ছোট রুমে ১৭ মার্চ পালিত হতো। যারা অংশ নিতেন তারা বেশির ভাগই ছিলেন দূতাবাসের অফিসার ও স্টাফ। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও আসতেন। দু’একজন বিদেশী কূটনীতিক আসতেন। ব্রিটিশ নেতাদের মধ্যে মাইকেল বার্নস প্রতিবছর নিয়মিত এসেছেন। সম্প্রতি মৃত্যু হওয়াতে তার অনুপস্থিতি সকলেরই বুকে বাজে। নতুন হাইকমিশনার সাইয়িদা মুনা তাসনীম এবার জাতির পিতার জন্মদিবসের বৈশিষ্ট্য একেবারে পাল্টে দিয়েছেন। আগামী বছর জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী। ফলে এ বছর থেকে বা বিশালভাবে পালনের উদ্যোগ শুরু হয়েছে। লন্ডনের দূতাবাসও এই ব্যাপারে সক্রিয়। নতুন হাই কমিশনারের উদ্যোগ ও তৎপরতা সকলের কাছেই প্রশংসা পেয়েছে। ১৩ মার্চ তিনি ইস্ট এন্ডের ওসমানি সেন্টারে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত সরোদ সন্ধ্যার আয়োজন করেন। সরোদ বাজান ঢাকা থেকে আগত বিখ্যাত শিল্পী রাজরূপা চৌধুরী। ১৭ মার্চ ইস্ট এন্ডের ইমপ্রেশন হলে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন এবং জাতীয় শিশু দিবস পালন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শিশুদের ভালবাসতেন। তাই তার জন্মদিনে শিশু সমাবেশের এই আকর্ষণীয় ব্যবস্থা। জাতির পিতাকে স্মরণ করার জন্য দূতাবাসের এবারের অনুষ্ঠানে সকল দলমতের মানুষ, বিদেশী বিশিষ্টজনেরও এসেছিলেন। শিশুদের জন্য রাখা হয়েছিল গান, কবিতা আবৃত্তি ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে হাইকমিশনের অনুষ্ঠানে এত শিশুর উপস্থিতি আগে কখনও দেখিনি। এই অনুষ্ঠানে বসে আমি যেন প্রতিমুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি টের পেয়েছি। একটি ছোট বালক যখন বঙ্গবন্ধুর মতো সাজ পোশাক পরে ওইরকম উদাত্ত কণ্ঠে তার সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিচ্ছিল তখন আমার মনে হচ্ছিল, বঙ্গবন্ধু বালক বেশে আমাদের সামনে হাজির হয়েছেন। মনে মনে হাইকমিশনার সাইয়িদা মুনা তাসনীমসহ দূতাবাসের সকলকে অভিনন্দন জানিয়েছি এমন একটি সুন্দর সন্ধ্যা সকলকে উপহার দেয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল ইতিহাস এবং জনগণের মন থেকে তাকে মুছে ফেলার জন্য। কিন্তু খুনীদের সেই অভিলাষ পূর্ণ হয়নি। সিংহের মতো বঙ্গবন্ধু আবার জাগ্রত এবং জাতীয় জীবনে বিশালভাবে প্রতিষ্ঠান। আর যারা তাকে হত্যা করেছিল, সীব্যয় বলেছিলেন “দাউ টু ব্রুটস” তাদের অস্তিত্ব আজ কোথাও নেই। জনগণের মনে নেই। ইতিহাসের পাতায় তারা চিহ্নিত জাতির কলঙ্ক হিসেবে। ফাঁসির রুজুতে ঝুলে তাদের অনেকের কলঙ্কিত জীবনের অবসান হয়েছে। ফিডেল ক্যাস্ট্রোর ভাষায় বলতে ইচ্ছা করে “আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি,” ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭৫ দীর্ঘ ২৬ বছর তার সান্নিধ্যে ছিলাম। গত ১৭ মার্চ এসে মনে হলে বাংলাদেশ দূতাবাসের অনুষ্ঠানে বসে মনে হচ্ছিল- ‘বঙ্গবন্ধু নেই কে বলে? তার সান্নিধ্যেইতো আছি।’ লন্ডন, ১৯ মার্চ, মঙ্গলবার, ২০১৯
×