ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গ্যাস সিলিন্ডার বিপণনে কেউ মানছে না বিধিমালা

প্রকাশিত: ০৯:৫১, ১৬ মার্চ ২০১৯

গ্যাস সিলিন্ডার বিপণনে কেউ মানছে না বিধিমালা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সম্প্রতি কয়েকটি অগ্নিকান্ডের পেছনে গ্যাস সিলিন্ডারের দায় রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হলেও গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি, পরিবহন, মজুদ ও ব্যবহারে সচেতনতার অভাব ও বিধিমালার তোয়াক্কা না করার অভিযোগ রয়েছে। ব্যবসায়ী ও ব্যবহারকারীদের বেশিরভাগই জানে না সিলিন্ডার ব্যবহারের নিয়ম ও সংরক্ষণের উপায়। আর যাদের এসব বিষয় দেখভালের কথা তারাও জনবল সঙ্কটের অজুহাতে দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ও সচেতন নাগরিকরা বলছেন, গ্যাস সিলিন্ডারের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতে কোম্পানিগুলোকে আরও সচেতন ও আন্তরিক হতে হবে, বাড়াতে হবে সংশ্লিষ্ট দফতরের তদারকি ও নজরদারি। রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে, গ্যাস সিলিন্ডার প্রস্তুতকারক কোম্পানির মূল ডিলাররা সরকারী বিধি মেনে মজুদ, পরিবহন ও সরবরাহ করলেও খুচরা ব্যবসায়ীদের অনেকেই এসব বিষয় মানছেন না। মগবাজার ও পুরান ঢাকার বেশির ভাগ এলাকায় সিলিন্ডার বিক্রির দোকানগুলো গড়ে উঠেছে আবাসিক ভবনের নিচে। এসব দোকানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রেরও সঙ্কট রয়েছে। আবাসিক ভবনের নিচেই তারা গ্যাস সিলিন্ডার মজুদ করছেন। এছাড়া, ফুটপাথ ও রাস্তার ওপরেও দোকানিরা গ্যাস সিলিন্ডার সাজিয়ে রাখছেন। রাজধানীর বিমানবন্দর ও মহাখালী এলাকার বিভিন্ন খাবারের হোটেল ও চায়ের দোকানগুলোতে দেখা যায়, চুলার একেবারে কাছাকাছি রেখে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে। কেউ কেউ গ্যাস সিলিন্ডার মাটিতে শুইয়ে রেখে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যবহার করছেন। বড় মগবাজারের লতিফ সরদার লেনে সরজমিনে দেখা যায়, ইমরান এন্টারপ্রাইজ নামে একটি রঙয়ের দোকানে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হয়। দোকানের সামনে দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে রঙের কয়েকটি বড় ক্যানের সঙ্গে গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হয়েছে। এ দোকানের ভেতরে রং ও রঙের কাজে ব্যবহৃত নানা কেমিক্যাল রয়েছে। এছাড়াও এই দোকানে বিক্রি হচ্ছে গ্যাসের চুলাসহ হার্ডওয়্যারের বিভিন্ন পণ্য। দেকোনের ভেতরে রঙের পাশেই রাখা হয়েছে ১২ কেজি ওজনের ৯টি গ্যাস সিলিন্ডার। শুধু তাই নয়, এসব সিলিন্ডারের ওপরে ঝুঁকিপূর্ণভাবে রাখা হয়েছে বিভিন্ন মালামাল। ইমরান এন্টারপ্রাইজের মালিক ইমরানের বাবা সিদ্দিকুল্লাহকে দোকানে পাওয়া গেল। তিনি জানান, ‘আমাদের এটা হার্ডওয়্যার ও রঙের দোকান।’ গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির অনুমতি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্যবসার পাশাপাশি কয়েকটি সিলিন্ডার বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে।’ দোকানে অগ্নিনির্বাপক কোন যন্ত্র আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না নেই’। একই এলাকার একটি আবাসিক ভবনের নিচে দেখা যায়, গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির আরও দুটি পাশাপাশি দোকান নাদিয়া এন্টারপ্রাইজ এবং মাহফুজ এন্টারপ্রাইজ। দুটি দোকানেই বেশকিছু সিলিন্ডার রাখা আছে। দুটি দোকানেই অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রও দেখা গেল। আলাপে দোকানিরা জানান, তারা সাইকেলে করে ভোক্তাদের বাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ করেন। গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি ও মজুদের বিষয়ে বিস্ফোরক পরিদফতরের কোন অনুমতি আছে কিনা জানতে চাইলে নাদিয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক খুরশেদ মিয়া বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স আছে। কিন্তু বিস্ফোরক পরিদফতর লাইসেন্স নেয় নাই। অনেক টেকা লাগে। আর ছোট জায়গা বলে তারা লাইসেন্সও দেয় না।’ কিভাবে এসব গ্যাস সিলিন্ডার পরিবহন করেন জানতে চাইলে খুচরা ব্যবসায়ীর মোঃ মাহফুজ বলেন, ‘অর্ডার দিলে সাইকেলের পেছনে ঝুলিয়ে সিলিন্ডার গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।’ এদিকে, বিমানবন্দর এলাকার গোলচত্বরে ট্রাফিক পুলিশ বক্সের পেছনে রয়েছে খাবার হোটেল। সরজমিনে দেখা যায়, ওই হোটেলের বাইরে একটি বড় গ্যাস সিলিন্ডার আড়াআড়িভাবে মাটিতে ফেলে রেখে ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহারের নিয়ম সম্পর্কে বলা আছে- ‘এলপিজি সিলিন্ডার খাড়াভাবে রেখে ব্যবহার করুন। কখনও উপুর বা কাত করে ব্যবহার করবেন না।’ গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের নিয়ম সম্পর্কে কোন ধারণা আছে কিনা জানতে চাইলে ওই খাবার হোটেলের ম্যানেজার রূপক বলেন, ‘আইনা চাবি দেই, পরে আগুন জ্বালাই। প্রয়োজন হলে বন্ধ করে দিই। কাইত কইরা রাখলে পইরা যাওয়ার রিক্স থাকে না।’ একপর্যায়ে স্বীকার করে রূপক করেন যে, সিলিন্ডার ব্যবহারের নির্দেশনাগুলো তিনি জানেন না। গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালায় যা আছে: ‘গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা ১৯৯১’-তে বলা হয়েছে ‘গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রয়ের জন্য কমপক্ষে পাকা ফ্লোরসহ আধা পাকা ঘর থাকতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপণ সক্ষমতা সংক্রান্ত লাইসেন্স ও ছাড়পত্রসহ অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র এক্সস্টিংগুইশার মজবুত এবং ঝুঁকিমুক্ত সংরক্ষণাগার থাকতে হবে। সিলিন্ডার আমদানির বিষয়ে বিধির তৃতীয় পরিচ্ছেদে বলা আছে, লাইসেন্স ছাড়া সিলিন্ডার আমদানি নিষিদ্ধ। কোন ব্যক্তি বিনা লাইসেন্সে গ্যাসপূর্ণ বা খালি সিলিন্ডার আমদানি করতে পারবেন না। সিলিন্ডার পরিবহনের বিষয়ে বিধিমালার চতুর্থ পরিচ্ছেদে বলা আছে, গ্যাসপূর্ণ সিলিন্ডার কোন দ্বিচক্রযানে (মোটরসাইকেল, সাইকেল) পরিবহন করা যাবে না। কোন যানে সিলিন্ডার পরিবহনের ক্ষেত্রে সিলিন্ডারের কোন অংশ উক্ত যানের বাইরে থাকা চলবে না। যানের যে অংশে সিলিন্ডার রাখা হয়, সে অংশে কোন ধারালো বস্তু থাকবে না। বিধিমালার সপ্তম পরিচ্ছদে সিলিন্ডারে গ্যাস ভর্তি ও গ্যাসপূর্ণ সিলিন্ডার মজুদ রাখার বিষয়ে বলা আছে, লাইসেন্স ব্যতীত সিলিন্ডারে গ্যাস ভর্তি ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ। বিধি-৪১ এর বিধান অনুযায়ী কোন ব্যক্তি বিনা লাইসেন্সে সিলিন্ডারে গ্যাস ভর্তি করতে পারবেন না অথবা গ্যাসপূর্ণ কোন সিলিন্ডার তার অধিকারে (মজুদ) রাখতে পারবেন না।’ মগবাজারের তাজউদ্দিন রোডের ওমেরা গ্যাস সিলিন্ডার কোম্পানির ডিলার লতিফ রেজা জানান, ‘গ্যাস সিলিন্ডারের ডিলারশিপ নিতে হলে খোলা জায়গা প্রয়োজন। এছাড়া বিস্ফোরক পরিদফতরের লাইসেন্স ও নক্সা নিয়েই আমরা ব্যবসা করছি। কিন্তু এখন অলিগলিতে খুচরা ব্যবসায়ীরা লাইসেন্স ছাড়া গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করছেন।’ গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে করণীয়: বিস্ফোরক পরিদফতরের পরিচালক সামসুল আলম বলেন, ‘গ্যাস সিলিন্ডারের যারা ডিলার বা সাব-ডিলার রয়েছেন, তাদের অবশ্যই বিস্ফোরক অধিদফতরের লাইসেন্স নিতে হবে। এছাড়া, যারা খুচরা ব্যবসায়ী আছেন তারা বিস্ফোরক পরিদফতরের লাইসেন্স ছাড়া ন্যূনতম ১০টি সিলিন্ডার বিক্রি করতে পারবেন। ১০ এর বেশি সিলিন্ডার মজুদ বা বিক্রি করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশও ব্যবস্থা নিতে পারবে।’ বিস্ফোরক পরিদফতরের লোকবল সঙ্কটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একটি বিভাগে মাত্র ৩/৪ জন করে অফিসার রয়েছেন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এই কম লোকবল দিয়ে কাভার করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া, অফিসিয়াল কাজের প্রচুর চাপ থাকে। এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ যদি আমাদের সহায়তা না করে, তবে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন হয়ে যাবে।’ ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অ.) আলী আহম্মদ খান বলেন, ‘গ্যাস সিলিন্ডার একটা আতঙ্কের বিষয় বটে। বর্তমানে এর চাহিদা অনেক এবং ভোক্তা পর্যায়ে অনেক বেশি মাত্রায় তা পৌঁছে গেছে। কিন্তু সিলিন্ডারের যথাযথ ব্যবহার ও দেখভাল করা হয় না। আমাদের দেশে নিম্নমানের সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে সিলিন্ডারের রেগুলেটরগুলো নিম্নমানের। ফ্যাক্টরি লেভেলে সিলিন্ডার পরিদর্শন করা হলেও সেকেন্ডারি লেভেলে পরিদর্শন করা হয় না। বর্তমানে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সেকেন্ডারি লেভেলেও পরিদর্শনে জোর দেয়া হচ্ছে।’ গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে সচেতনতার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘সিলিন্ডারের লিকেজ থেকে আগুন লেগে বড় দুর্ঘটনা ঘটে যায়। যখন গ্যাস সিলিন্ডার ট্রান্সপোর্ট অথবা ভোক্তা পর্যায়ে বহন করা হয়, তখন খেয়াল রাখতে হবে যাতে রেগুলেটরে চাপ না লাগে। রেগুলেটরে চাপ লাগলে লিকেজ হয়ে যায়। এরপর যদি সেটি আগুনের সংস্পর্শে আসে তখন বড় দুর্ঘটনা ঘটে।’ সিলিন্ডার বিক্রি বা মজুদ করতে অবশ্যই বিস্ফোরক পরিদফতরের লাইসেন্স নেয়া এবং সিলিন্ডারের মজুদ ও ব্যবহারের বিষয়ে ডিলার, পরিবেশক ও ভোক্তাসহ সবাইকে আরও সচেতন ও যত্নবান হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
×