ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা নিয়ে টনক নড়েছে বিসিবির

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ১৬ মার্চ ২০১৯

ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা নিয়ে টনক নড়েছে বিসিবির

মোঃ মামুন রশীদ ॥ ২০০৯ সালে পাকিস্তান সফরকারী শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল বন্দুকধারীদের হামলার শিকার হয়েছিল। গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে লঙ্কান দলকে বহনকারী বাসের নিরাপত্তায় যদিও সেদিন ছিল পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) পক্ষ থেকে নিরাপত্তাকর্মঢ। এরপরও বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার হয়েছিলেন গুলিবিদ্ধ। আর এবার নিউজিল্যান্ড সফরে থাকা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ছিল না কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কোন পুলিশ কর্মকর্তা দূরের ব্যাপার, ছিল না কোন লিয়াজোঁ কর্মকর্তাও! কারণ সর্বশেষ গ্লোবাল পিস ইনডেক্স অনুসারে বিশ্বের দ্বিতীয় শান্তিপূর্ণ দেশ নিউজিল্যান্ড। এছাড়া গ্লোবাল ফিন্যান্সের জরিপে নিরাপদ দেশ হিসেবে বিশ্বে নিউজিল্যান্ডের অবস্থান দশে। এরপরও ক্রাইস্টচার্চে শনিবার সিরিজের তৃতীয় ও শেষ টেস্ট খেলতে গিয়ে ভয়াবহ বন্দুক হামলা থেকে ভাগ্যক্রমে অল্পের জন্য বেঁচে গেছে পুরো বাংলাদেশ দল। আর এমন হামলার পর অবশেষে বিদেশে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নিরাপত্তা নিয়ে টনক নড়েছে ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি)। বিসিবি প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন জানিয়েছেন যে কোন দেশেই দল খেলতে গেলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখেই দল পাঠানো হবে। ঘটনার অনেক পর নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট (এনজেডসি) কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে রাখতে পেরেছে মুশফিকুর রহীম-তামিম ইকবালদের। টেস্ট বাতিলও করেছে নিজেদের দোষটা ঢাকতে। টেস্ট বাতিল করায় শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলেরও (আইসিসি) প্রশংসা জুটেছে এনজেডসির কপালে। বাংলাদেশে যে কোন ক্রিকেট দল খেলতে আসলে তাদের জন্য দেয়া হয় কয়েক স্তরের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা। বিদেশী দলগুলো যেভাবে বিসিবির কাছে নিরাপত্তা দাবি করে সেভাবেই তাদের দেয়া হয় নিয়মিত। এমনকি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পাওয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় প্রেসিডেন্টের জন্য যেমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা তেমনটাও বেশ কয়েকটি ক্রিকেট দলকে দিতে দেখা গেছে অতীতে। বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী গোয়েন্দা সংস্থা, বেশ কয়েকটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেই নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন। অথচ বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ দল খেলতে গেলে এমন কড়া নিরাপত্তা দূরের কথা, কোন কোন দেশে একজন পুলিশ কর্মকর্তাও থাকেন না। এবার যেমন নিউজিল্যান্ড সফরে একেবারে নিরাপত্তাকর্মী ছাড়াই খেলছিল বাংলাদেশ দল। এমনকি বিসিবি থেকেও সে জন্য কিছু ভাবা হয়নি। ‘দুর্ঘটনা’ হুট করেই ঘটে বলে সেটিকে দুর্ঘটনা বলা হয়ে থাকে। বলে-কয়ে কখনও আসে না অযাচিত ঘটনাগুলো। এবার তেমনই এক ভয়াবহ সঙ্কট থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে পুরো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ক্রাইস্টচার্চে শনিবার সফরের সর্বশেষ ম্যাচ খেলার জন্য হ্যাগলি ওভাল মাঠে অনুশীলন করছিল সফরকারীরা। টিম বাসে করে নিকটবর্তী এক মসজিদে পুরো দল (নাঈম হাসান ও লিটন দাস ব্যতীত) জুম্মার নামাজ পড়তে গিয়ে গোলাগুলি চলার সময় উপস্থিত হয়েছিলেন। স্থানীয় এক মহিলার সতর্কবাণীতে দৌড়ে আবার বাসে উঠে মাঠে ফিরে আসেন ক্রিকেটাররা। রক্ষা পান সবাই অল্পের জন্য। বিদেশে ক্রিকেট দলের নিরাপত্তা নিয়ে বিসিবি সভাপতি পাপন বলেন, ‘আজকের এই ঘটনার পর সব বদলে যাবে, এটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। সবকিছু সামলে নিয়ে আমাদের দেখতে হবে, নিরাপত্তার জন্য কি কি দরকার। কোন দেশে যখন আমরা খেলতে যাচ্ছি ওই দেশ কি দিতে পারবে, আমাদের তরফ থেকে কি প্রয়োজন সব দেখতে হবে। আমার ধারণা, এখন সব দেশ নিরাপত্তা নিয়ে কোন ছাড় দেবে না। এতদিন আমাদের এটা করা যে দরকার তা মনেই হয়নি, প্রয়োজনই হয়নি। অন্যরা নিরাপত্তা পাচ্ছে, আমরা পাচ্ছি না তা নয়। সবাই চিন্তামুক্ত থেকেই ওসব দেশে খেলতে যায়।’ অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপগুলোয় খেলতে গেলে সব দলই কিছুটা নির্ভার থাকে। এসব দেশে অপরাধের মাত্রা সবসময়ই শূন্যের কোটায়। এ কারণে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা তেমন থাকে না বললেই চলে। আর নিউজিল্যান্ড তো গত ১০ বছর ধরেই গ্লোবাল পিস ইনডেক্সে শীর্ষ চারে অবস্থান করছে। এ বছর তারা শান্তিপ্রিয় দেশের তালিকায় দুই নম্বরে উঠে এসেছে। বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশগুলোর তালিকাতেও ১০ নম্বরে সবুজে ছাওয়া শান্ত, সুনিবিড়, কোলাহলহীন, কম জনসংখ্যার এ দেশটি। এ কারণেই নিরাপত্তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি বিসিবিও। তবে সেখানেই ঘটে যেতে পারতো দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। এ বিষয়ে পাপন আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে কোন দল যখন খেলতে আসে তখন ওরা যে ধরনের নিরাপত্তার কথা বলে সে ধরনের নিরাপত্তাই দিতে হয়। আমরা এখন পর্যন্ত এমন কিছু পাইনি। সত্যি বলতে আমরা এটা নিয়ে জোরাজুরিও করি না। অন্য দেশগুলোও দেখেছি এটা নিয়ে কিছু বলে না। নিউজিল্যান্ডে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে, ওদের ধারণাই নেই। আজ ঘটনাস্থলে পুলিশ যেতে যে সময় লেগেছে, এটাই তো অবাক করার মতো। আমার মনে হয় না আমাদের দেশে বা আশপাশের কোন দেশে এমন কিছু হলে পুলিশ আসতে এত সময় লাগত। ওরা হয়তো অপ্রস্তুত ছিল। এখন হয়তো এই ব্যাপারে আরও সতর্ক হবে। আজকের ঘটনার পর এটা নিশ্চিত, এখন থেকে যে দেশেই আমাদের দল খেলতে যাক না কেন, সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। এটা যারা দিতে পারবে তাদের ওখানে আমরা খেলতে যেতে পারব। এছাড়া খেলতে যাওয়া সম্ভব না।’ দুই মাস পর ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ। এই ঘটনা আইসিসির জন্যও বড় সতর্কবার্তা। বিসিবি সভাপতি মনে করেন, আইসিসির টুর্নামেন্টে সবসময়ই ভাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে। আর ইংল্যান্ডে যেহেতু এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে, আইসিসি সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থাই করবে। এরই মধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা হয়েছে বিসিবি সভাপতির। বিসিবি সঙ্গে কথা বলে তৃতীয় টেস্ট বাতিল ঘোষণা করেছে এনজেডসি। হামলার নিন্দা জানিয়ে ম্যাচ বাতিলের এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছে আইসিসি। আইসিসির প্রধান নির্বাহী ডেভ রিচার্ডসন আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলেন, ‘ক্রাইস্টচার্চে ভয়াবহ হামলায় যে সকল পরিবার ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে তাদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। দুই দল, স্টাফ ও ম্যাচ অফিসিয়ালরা নিরাপদে আছেন। টেস্ট ম্যাচ বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ সমর্থন রয়েছে আইসিসির।’ হামলার ঘটনাটির অনেক পরে পুলিশ কর্মকর্তারা এসেছেন। নিজেদের মতো করেই দৌড়ে মাঠে ফিরে আসেন আতঙ্কিত ক্রিকেটাররা। হাগলি ওভালের ড্রেসিংরুমে ঘণ্টা দু’য়েক অবরুদ্ধ থাকার পর বাংলাদেশ দলকে বিশেষ প্রহরার ব্যবস্থা করে নভোটেল হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের প্রধান নির্বাহী ডেভিড হোয়াইট জানিয়েছেন, বাংলাদেশী ক্রিকেটারদের যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফেরত পাঠানো হবে। শুধু বাংলাদেশ দলের সফরসূচী নয়, বাতিল করা হয়েছে নিউজিল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট দল ও অস্ট্রেলিয়া অনুর্ধ-১৯ দলের মধ্যকার দুটি ম্যাচও। হামলার পর থেকে বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখেন হোয়াইট, ‘বাংলাদেশের (নিজামউদ্দিন চৌধুরী) সঙ্গে কথা বলেছি। এই মুহূর্তে ক্রিকেট না খেলার ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছি। এটা ছিল খুব সহজ সিদ্ধান্ত।’
×