ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মহিদুলের বিস্ময়কর পেশা

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ১৬ মার্চ ২০১৯

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মহিদুলের বিস্ময়কর পেশা

কেউ ভয় পান, কারো দু’চোখ ভরা বিস্ময় কিন্তু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মহিদুলের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তড়তড়িয়ে গাছে উঠছেন, কাজ করছেন, কোন ভয়ডর ছাড়াই। কারণ ভয়কে জয় করেই তার জীবন চলার পথ। চোখের আলোতে তো আর ভয়কে অনুভব করার উপায় যে নেই। তাই করুণা নিয়ে চলার চেয়ে অদেখা জীবন ঝুঁকি নিয়ে চলা ঢের ভাল তার কাছে। দু’চোখে আলো না থাকলেও গাছই তার চোখের আলো ও বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে উঠেছে। অন্ধ হলেও বিচিত্র উপায়ে ও বিস্ময় সৃষ্টি করে গাছে উঠে আগাছা ও অন্যর জন্য খড়ি হিসেবে গাছের ডালপালা কেটে দিয়ে জীবন চলার এক অদ্ভুত আয়ের পথ বেছে নিয়ে সংসার চালান তিনি। বিচিত্র পেশার কারণেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মহিদুল আশপাশের গ্রামগুলোর মধ্যে এক পরিচিত ও অদম্য সাহসী মানুষ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। দরিদ্র পরিবারে জন্মের পর অজানা অসুখে দু’চোখের আলো হারিয়েছিলেন শেরপুর উপজেলার সুঘাট ইউনিয়নের চরবিনোদপুর গ্রামের মহিদুল। এখন তার বয়স পঁয়ত্রিশের কোঠায়। জন্মের মাত্র দু’বছরের মধ্যে চোখের আলো হারানো মহিদুলের প্রিয় জন্মভূমির কোন সৌন্দর্যই দেখা হয়নি। গ্রাম-প্রকৃতির অপার হাতছানি কিভাবে কাছে টানে তা সব কিছুই অজানা তার। অন্ধু হলেও জীবন চলার পথে সাহস হারাননি কখনও। এজন্যই গাছে উঠে ডাল কাটা ও গাছের ওপরের আগাছা পরিষ্কারের বিচিত্র পেশা তার সামনে এনে দিয়েছে পথ চলার নতুন আলো। শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দুরের গ্রাম বিনোদপুর। এবরোথেবরো মাটির রাস্তা পেরিয়ে যেতে হয় কয়েক কিলোমিটার। নদী পার হলেই মহিদুলের গ্রাম-চরবিনোদপুর। বিনোদপুর ছাড়াও আশপাশের গ্রাম-কল্যাণী, কাশিয়াবালা, জোড়গাছি, বানিয়াগাতি, সূত্রাপুর, জয়লা, নলডাঙ্গা, পেঁচিবাড়ি নলডাঙ্গাসহ শেরপুর ও ধুনটের কয়েকটি গ্রামে মহিদুল এক পরিচিত মুখ। গ্রামের একটি ঘরে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে তার সংসার। বেশির ভাগ সময়ই কাটে বিনোদপুর বাজার এলাকায়। কারও গাছের আগাছা বা ডাল কাটার প্রয়োজন হলে খবর দেয়া হলে দা’ হাতে স্ত্রীকে নিয়ে চলে আসেন মহিদুল। সে গাছ যত উঁচুই হোক না তার পরোয়া নেই। গাছে ওঠা ও ডাল পরিষ্কার বা কাটার দৃশ্য একেবারে অবিশ্বাস্যের মতো। স্ত্রী রওশনা তার সব সময়ের সঙ্গী। মহিদুল স্ত্রীর কাঁধে হাত দিয়ে পথ চলেন। কোন গাছে ওঠে ডাল ও আগাছা পরিষ্কার করার প্রয়োজন হলে স্ত্রী তাকে সেই গাছের গোড়ায় পৌঁছে দেন। এরপর মহিদুল হাতের দা’কাঁধে বিচিত্র উপায়ে মাথা বাঁকিয়ে তা ধরে রেখে দু’হাত দিয়ে গাছ জড়িয়ে ওঠা শুরু করেন। তার পর এক ডাল থেকে আরেক ডালে গিয়ে গাছের আগাছা, মরে যাওয়া ডাল বা গাছ মালিকের নির্দেশ অনুযায়ী ডালপালা ছাটতে শুরু করে। এভাবে গছের মগডালে পর্যন্ত পৌঁছে যান। যে ডালে উঠেন সে ডাল নিচু হয়ে বেঁকে গেলে বুঝতে পারেন আর ওপরে ওঠা যাবে না। কাজ শেষে একইভাবে তিনি নিচে নেমে আসেন। গাছের ডাল কাটা বা গাছ পরিষ্কার করে ৫০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত পান মহিদুল। এই টাকাতেই কোনভাবে সংসার চলে তার। প্রতি দিন ৩/৪টি গাছে কাজ করেন। অনেক সময় এর চেয়ে বেশি কাজ পান। প্রায় ১৫/২০ বছর ধরে গাছে ওঠার কাজ করেন তিনি। তবে বছরের সব সময় তার এই কাজ থাকে না। শুধু শীত ও শুষ্ক মৌসুমে হাতে কাজ থাকে। বাকি সময় তার বসে থাকতে হয়। অপরের কাছে হাত পেতে কিছু নিতে অপছন্দ হলেও বাধ্য হয়ে ওই সময় বিভিন্ন হাটবাজারে গিয়ে লোকজনের কাছে হাত পাততে হয়। মহিদুলের কথা কি করমু কাজ না থাকলে হাত না পাতলে তো আর সংসার চলে না। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়েও কিভাবে গাছে উঠে এই বিচিত্র কাজ তার পেশা হয়ে উঠল সে বিষয়ে মহিদুলের বক্তব্য- শিশু বয়স থেকেই তিনি গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেন। গাছ জড়িয়ে ধরে তার ভাল লাগতো। এভাবেই তার গাছে ওঠা শুরু এবং ধীরে ধীরে তিনি সব গাছে ওঠায় সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন। এখন সেই গাছই এখন তার বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে উঠেছে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় ভিক্ষে করেই তার জীবন সংগ্রাম শুরু। অনটনের কারণে প্রথম বিয়ে টিকেনি। ৮/১০ বছর আগে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এক ছেলে এক মেয়ে ও স্ত্রীসহ বৃদ্ধ পিতাকে নিয়ে সংসার। মহিদুল দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলেও মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারেন। কারও গাছের ডাল কাটা ও গাছের আগাছা পরিষ্কার করতে হলে লোকমুখে ছাড়াও মোবাইলে তাকে খবর দেয়া হয়। দু’চোখ অন্ধ হলেও মোবাইল ফোনের কল লগ বোঝার বিস্ময়কর প্রতিভা রয়েছে তার। সে অনুযায়ী প্রয়োজন বোধে মিসড কল ও কাউকে কাউকে ফোন দেন তিনি। কাশিয়াবালার সেলুনকর্মী সাদ্দাম, বিনোদপুরের কৃষক কবির, ব্যবসায়ী মোমিন, বাঁশ ব্যবসায়ী এনামুল, কলেজ ছাত্র তাজমুল হক, সবাই জানালেন, আশপাশের গ্রামে অন্ধ (দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী) মহিদুল তার বিস্ময়কর ও সাহসী কাজের জন্য পরিচিত মুখ। কারও গাছের ডাল বা আগাছা পরিষ্কার করার প্রয়োজন হলেই তার ডাক পড়ে। ৭০/৮০ ফুট উচ্চতার গাছেও তিনি অবলীলায় ওঠেন। তবে যারা তাকে দিয়ে গাছের ডাল কেটে নেন তারা নিজেরাই অনেক সময় ভয়ে থাকেন, যদি সে গাছ থেকে পড়ে যায়। তবে মহিদুলের কোন ভয় নেই, কারণ গাছকে ভালবেসেই তিনি ডাল কেটে দেন এবং গাছের আগাছা পরিষ্কার করেন। এ কাজে উপার্জিত অর্থ দিয়েই তো তার সংসার চলে। অনেকে গাছের কাটা ডাল খড়ি হিসাবে তাকে দেন। সেটি আবার তিনি বিক্রি করে কিছুটা বাড়তি উপার্জন করেন। তাই গাছের প্রতিও তার গভীর টান। তার আবেদন, তিনি যেন সন্তানদের মানুষ করতে পারেন, আর দু’মুঠো ভাত এবং একটি পরিবারের জন্য একটি ভাল ঘর। এর বাইরে তার চাওয়া তেমন নেই। চলতে চান এভাবেই। -মাহমুদুল আলম নয়ন, বগুড়া থেকে
×