ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ধ্রুপদী দৃষ্টির কবি

প্রকাশিত: ১২:১৫, ১৫ মার্চ ২০১৯

ধ্রুপদী দৃষ্টির কবি

আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা নীরবে, নিভৃতে আপন মহিমায় কাজ করে যাচ্ছেন। সমাজকে দিয়েছেন সুউচ্চ আসন। জাতিকে করেছেন মহিয়ান। এঁরা সংবাদের শিরোনাম হন না। এদের নিয়ে কবিয়াল কবিগান করেন না। তাতে এ সমস্ত লোকের কিছু আসে যায় না। এদের একটাই আনন্দ যে এঁরা কিছু করছেন। নিজেদের মহান কর্মে সমুজ্জ্বল রেখেছেন। কোন কোন মানুষ পরিবেশের নয়, রীতি মতো প্রতিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করে আদর্শিক অভিযাত্রায় ও সাফল্য লাভ করেন। নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে স্থাপন করেন দৃষ্টান্ত। অনীক মাহামুদ এরূপ একটি তেজস্বী দৃষ্টান্তের নাম। জন্মে ছিলেন রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলার শুভডাঙ্গা ইউনিয়নের অজপাড়া মচইল গ্রামে। শৈশবে হয়েছেন পিতৃহীন। গ্রামের স্কুলে নিয়েছেন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠ। সেখান থেকেই শিক্ষা বোর্ডে মেধা তালিকায় বাণিজ্যে চতুর্থ স্থান করে নিয়েছেন। এরপর এসেছেন নগর জীবনে। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পড়তে এসেও দেখেছেন অকর্ষিত ভূমি। এখানেও তিনি সর্বপ্রথম এবং এ পর্যন্ত সর্বশেষ সম্মান শ্রেণীর মেধা তালিকায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছেন। অনীক মাহামুদের জীবন সাধনা তাঁর চলার পথের কণ্টক মাড়িয়ে সকল চড়াই-উতরাই পার হয়ে এগিয়ে চলার সহায়ক হয়েছিল। স্বনামধন্য ছাত্র, খ্যাতিমান অধ্যাপক, যশস্বী কবি-সাহিত্য শিল্পী হিসেবে তাঁর অর্জন আমাদের আশান্বিত ও মুগ্ধ করে। ১৯৮৫ সালে ‘নিজেরা করি’ নামক একটি বেসরকারী সংস্থায় কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। এর পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০০০ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। এর পর বাংলা বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অধ্যাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষা সহায়ক কাজের একাডেমিক কাউন্সিল, আইবিএস, কেন্দ্রীয় গ্রন্থগার, বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, কলা অনুষদ বাংলা বিভাগের কার্যপরিচালনা প্রক্রিয়ার নানা পর্যায়ে অনীক মাহামুদ দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশের কাব্যঙ্গনে অনীক মাহামুদ একটি বিশিষ্ট আসন অলঙ্কৃত করে আছেন। বহমাত্রিক সাহিত্য সাধনায় ব্যাপৃত এই কবি ব্যক্তিত্ব এবারে ষাট বছর পূর্ণ করলেন। কবিতা, গল্প, উপস্যাস, প্রবন্ধ, শিশু সাহিত্য, জীবনী গ্রন্থ, স্মৃতিকথা মিলে তিনি প্রায় এক শ’ গ্রন্থ রচনা করেছেন। ইতোমধ্যে গ্রন্থগুলো রচনা সংগ্রহের ভেতরও সন্নিবদ্ধ হয়েছে। ১১ খ- রচনা সংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে। আগামী ২১ বইমেলায় ১২ খ-টি প্রকাশিত হবে। কবির ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত রুদ্র ৭৩ জন লেখকের রচনা স্থান পেয়েছে। ‘হিরণ্যসম্বিৎ’ নামে একটি সংবর্ধন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে সাম্প্রতিক। প্রফেসর আবদুল মান্নান, ড. গোলাম সাকলাইন, জাতীয় অধ্যাপক মোস্তফা নূরউল ইসলাম, সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়. ড. মুর্শীদ, প্রফেসর ড. আবদুল খালেক তাদের উত্তরসূরি হিসেবে সাহিত্য জ্ঞানচর্চার অঙ্গনে সংখ্যাতিমান হয়ে উঠছেন প্রফেসর ড. অনীক মাহামুদ। তিনি বাংলা সাহিত্যের বিচিত্র শাখায় বিচরণ করেছেন তার লেখনী নিয়ে। বাংলা একাডেমিসহ দেশ-বিদেশের প্রকাশনা থেকে তার গ্রন্থরাজি প্রকাশিত হয়েছে। ইতোমধ্যে তার ১১ খ- রচনা সংগ্রহ বাংলাবাজার ‘সূচয়নী পাবলিসার্স ’ প্রকাশ করেছে। এগুলোর মধ্যে কাব্য সংগ্রহ প্রথম দ্বিতীয় খ-ে ২৪টি কাব্য সংগ্রহ সঙ্কলিত। তার ১৯টি প্রবন্ধ গ্রন্থ যেগুলো দেশের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে পাঠ্য তালিকাভুক্ত হয়েছে। সেগুলো ৫টি খ-ে প্রকাশিত হয়েছে। অনীক মাহামুদ প্রবন্ধ সংগ্রহ ১, ২, ৩, ৪, ৫ নামে। শিশুদের ছড়া ৬টি সংগ্রহে প্রকাশিত হয়েছে। শিশু ও কিশোরতোষ গল্পের ১৮টি বই ছোটদের গল্প সংগ্রহ ১, ২, ৩, নামে খ-াকারে প্রকাশিত হয়েছে। তার নির্বাচিত কবিতা গ্রন্থ কাব্য ‘সারথী’ কলকাতার ১টি বনেদী প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপনা সূত্রে অনীক মাহামুদের সাহিত্য বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা সূত্রপাত। উচ্চতর শ্রেণীতে পাঠদান এবং পাঠপ্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে গবেষণারপত্রের তত্তা¡বধান করতে হয়। এ ক্ষেত্রে অনীক মাহামুদ একজন সফল গবেষণা পরিচালক। সৃজনশীল মানুষের পেশাদারিত্ব যেখানেই প্রযুক্ত হবে সেখানেই সোনা ফলবে। কথাটির যথার্থতা মিলেছে তার গবেষণা তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে। তিনি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপনা দায়িত্বেও অরিহার্য অংশ হিসেবে সাহিত্যেও গবেষণা কাজকে অপাঙ্ক্তেয় মনে করনেনি। এ কারণে ছাত্রছাত্রীরা এমএ এমফিল, পিএইচডি পর্যায়ে তার নির্দেশনায় অভিসন্দর্ভেও প্রণয়নের কাজ করছেন। তার তত্ত্বাবধানে ৯ জন গবেষক পিএইচডি, ২ জন গবেষক এমফিল ডিগ্রী অর্জন করেছেন এবং ২৪ জন গবেষক এমএ থিসিস প্রণয়ন করেছেন। ১৯৮১ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশ বেতারের প্রথম শ্রেণীর গীতিকার। ২০টি জাতীয় জীবনের বিশেষ দিবসকে নিয়ে লেখা ২০টি গীতিনকশাসহ পাঁচ শতাধিক গানের রচয়িতা অনীক মাহামুদ। তার সাহিত্য কৃত্তি নিয়ে ইতোমধ্যে খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রুবেল আনসার রচনা করেছেন ‘অনীক মাহামুদ কবি সত্তা ও কাব্য কলা’ (২০১৫)। খ্যাতিমান গবেষক ময়মনসিংহের ফুলবাড়ী বিশ^বিদ্যালয় কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান গাউছুর রহমান ৪শ’ ৬৪ পৃষ্ঠার গবেষণা গ্রন্থ ‘অনীক মাহামুদের কবিতা যাপনের সূত্র’ (২০১৫) রচনা করেছেন। অনীক মাহামুদ এক দ্বন্দ্ব রক্তিম সময়ের কবি। কুশলী কোলাজ শিল্পীর মতো তিনি সমকাল, পুরাণ, বিশে^র উচ্চাঙ্গ সাহিত্য থেকে বিজ্ঞান থেকে এবং আটপৌরে সাধারণ জীবন থেকে দেখা উপাদান তার কবিতায় সংযোজন করেছেন। তার গ্রন্থস্থ কবিতাগুলোর প্রধান উপজীব্য প্রেম হলেও তিনি জীবন উপলব্ধির ভিন্ন ভূম-ল সাজিয়ে নিয়েছেন তার কাব্যে। তিনি তার কাব্যে সমাজতাত্ত্বিকের মতো শৈলবিদের প্রেমানুভূতির বিভিন্ন আত্মার এ্যানাটমিতে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ধ্রুপদী দৃষ্টির কাব্যকার অনীক মাহামুদ। কাব্য ভাষায় যাঁর অনায়াস অধিকার এবং ‘অমৃতলোকের স্বপ্নভাষ্য’ আর শুভ্রতার সমার্থক চেতনায় কবিতাচর্চার যিনি নিপাট কারিগর। কাব্যশিল্পী হওয়ার পাশাপাশি সমমাত্রায় কাব্যবোদ্ধা ও প-িত জন তিনি। সৃজন শীলতা আর মননশীলতা এক সফল সংমিশ্রণ তাঁর অতিবাহিত সুদীর্ঘ সাহিত্য জীবনে প্রমাণিত। কবি পরিচয়েই তাঁর অধিক স্বাচ্ছন্দ্য ও ততোধিক শিল্প বিস্তার। জীবনকে কবিতাময় এবং কবিতাকে জীবনময় আকারে তোলার মতো অবাক দুঃসাধ্য শিল্পকর্মে তিনি ঈর্ষণীয় মাত্রায় প্রকৌশলী এবং সিদ্ধহস্ত। নিজের বোধের সঙ্গে কাব্য ব্যাকরণের যে সমস্বত্ব মিশ্রণ অনীক মাহামুদ আজ অবধি অব্যর্থভাবে করে চলছেন, শুধু ভাষাকে ভিত্তি করে। অনীক মাহামুদ খুব ছোটবেলা থেকে নানা বিষয়ে আগ্রহ ও কর্মপ্রাণনা তার মধ্যে ছিল। খেলাধুলা নাটক, অভিনয়, পড়াশোনায় বিচিত্র বিষয়ে তাঁর বুৎপত্তি লক্ষ্য করা গেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে তিনি বিদগ্ধ জনের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। সাহিত্য চর্চায় তিনি যে বরাবর পজিটিভ ও প্রতিশ্রুতিশীল ছিলেন তা পুরস্কারপ্রাপ্তি ও সম্মাননাপ্রাপ্তির মধ্যে উপলব্ধি করা যায়। রাজশাহী কলেজ, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়, কিশোর কুঁড়ির মেলা, উত্তরা সাহিত্য মজলিস, উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সাংস্কৃতি সংগঠন, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, হিলালী স্মৃতি সংসদ, রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থগার, বাংলাদেশ ইন্সিউরেন্স একাডেমি থেকে কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প ও নাটক রচনার জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন। স্থানীয় পুরস্কারের সঙ্গে সম্মাননা-সংবর্ধনাও তাঁর ললাটে কম জোটেনি। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের বেশি সময় সাহিত্যের সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করছেন অনীক মাহামুদ। সাহিত্যেও বিচিত্র শাখায় বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে তার হাতে। বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে তার কবিতা নিয়ে সেমিনার, আলোচনা, টার্মপেপার, জার্নালগুলোতে লেখালেখি হচ্ছে। তিনি চেষ্টা করেছেন প্রকৃত সাহিত্যের দোসরতা করতে। কোন পুরস্কার-তিরস্কারের মোহ বা অনুরাগ-বিরাগ কখনও তাকে তাড়িত করেনি। এর পরেও যে তিনি প্রান্তবাসী হিসেবে নিভৃতে তার কৃতিগুলো সারস্বত সমাজের সামনে নিয়ে আসতে পেরেছেন তাতেই তিনি স্বস্তি বোধ করেন। কোন কিছুতেই এক্সট্রিমিস্ট না হয়ে সাদামাটা জীবন পরিবৃত্তে সন্নিহিত থেকে তোষামোদ- তাঁবেদারি পরিহার করে আপন চৈতন্যের সীমায় তার মতো করে দাঁড়িয়ে আছেন এটাই তার শান্তি এবং তার প্রাপ্তি। পারিপাশির্^কতা বিরুপতা প্রদর্শন করেছেন। কোন শক্তিই তার গতিকে থামাতে পারেননি। হয়ত বয়স তার দেহকে বার্ধক্যে পৌঁছে দিবে। পক্ব দেশের হাত ধরে দেহ পিঞ্জরের পাখ-পাখালি একদিন উড়াল দেবে আদি নীড়ের খোঁজে। যাবার আগে জন্মের ঋণ যদি কিছু শোধ করা যায় তাহলে তার জ্ঞানচর্চার মধ্যে উদ্দীপ্ত হোক এই তিনি চেয়েছেন। অনীক মাহামুদ যা পেলেন- যা নিলেন –যা করলেন সবই জগতের মানুষের কাছে রেখে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত লাভালাভের বিষয়টা বরাবরেই তার কাছে মুখ্য ছিল না-এখনও নেই। টাকা পয়সা অহঙ্কার কোন দিনই তাকে টানেনি। মিথ্যাচারকে ঘৃণা করেছে আজীবন। দেহের লাগাম নিজ হাতে নিতে পেরেছেন সংযমের চাবুকে। তার বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী ভক্ত-শিষ্য-ছাত্রছাত্রীদের অপার ভালবাসাই তার সাফল্য-তার সাহিত্য শিল্পের ওজারতি-তেজারতি। তাই তো তিনি রবীন্দ্রনাথের এই কবিতার মাঝে নিজেকে বার বার মেলাতে চেয়েছেন আজ আমি কোন মোহ নিয়ে আসিনি তোমার সম্মুখে এতদিন যে দিনরাতির মালা গেঁথেছি বসে বসে তার জন্য অমরতার দাবি করব না তোমার দ্বারে। তোমার অযুত নিযুত বৎসর সূর্য প্রদক্ষিণের পথে যে বিপুল নিমেষগুলো উন্মীলিত নিমীত হতে থাকে তারই এক ক্ষুদ্র অংশে কোন একটি আমলের সত্য মূল্য যদি দিয়ে থাকি, জীবনের কোন-একটি ফলবান খ-কে যদি জয় করে থাকি পরম দুঃখে তবে দিয়ো তোমার মাটির ফোঁটার একটি তিলক আমার কপালে; যে রাতে সকল চিহ পরম অচিনের মধ্যে যায় মিশে। হে উদাসীন পৃথিবী, আমাকে সম্পূর্ণ ভোলাবার আগে, তোমার নির্মম পদপ্রান্তে আজ রেখে যাই আমার প্রণতি। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
×