ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ফুরফুরা শরীফের যুব সংস্কারক

প্রকাশিত: ০৯:১৭, ১৫ মার্চ ২০১৯

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ফুরফুরা শরীফের যুব সংস্কারক

বাংলাদেশে পীর-আওলিয়াগণের ইসলাম প্রচারের সর্বাধিক অবদানের কথা আমাদের সবারই জানা। গত শতাব্দীতে ফুরফুরা শরীফের মহান পীর মাওলানা শাহ সূফী আবু বকর সিদ্দিকী (রহ) এক বিপ্লবী অবদান রেখে যান। তিনি ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন পশ্চিম বাংলার হুগলী জেলার ফুরফুরা শরীফে। কলকাতা থেকে ২২ মাইল উত্তর-পশ্চিমে এই গ্রামের অবস্থান। এখানে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির আমলে একটা সেনাবাহিনী বালিয়া বাসন্তির অত্যাচারী রাজাকে দমন করার জন্য আসে সেই বাহিনীর সঙ্গে হযরত মুনসুর বাগদাদী আগমন করেন। তিনি ছিলেন ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা)-এর বংশধর। বালিয়া বাসন্তির রাজা যুদ্ধে পরাজিত হন। স্বভাবতই বিজয়ের আনন্দ লহরী প্রবাহিত হয়। বালিয়া বাসন্তির নামকরণ হয়ে যায় ফুরফুরা- অর্থাৎ আনন্দমুখর। মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকীর পিতা সূফী আবদুল মুকতাদীর মক্কা শরীফ গিয়ে বসবাস করতে থাকেন। কিছুদিন পর তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাধ্য হয়ে তাকে ফুরফুরা শরীফে চলে আসতে হয়। মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকী (রহ) ভূমিষ্ঠ হওয়ার ৯ মাসের মাথায় তাঁর পিতা সূফী আবদুল মুকতাদির ইন্তেকাল করেন। তাঁর মাতা মুহতারিমা মহব্বতুন নেসা পিতৃহারা আবু বকরের লালন-পালনে যতœবান হন। প্রথমে সন্তানকে ইংরেজী স্কুলে ভর্তি করে দেন। কিন্তু তিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হন মাদরাসায় ভর্তি করে দেয়ার জন্য। তাঁকে ফুরফুরা শরীফের অদূরে অবস্থিত নওয়াব আলী বদী খাঁ প্রতিষ্ঠিত শিতাপুর মাদরাসায় ভর্তি করে দেয়া হয়। এই মাদরাসা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি হুগলী মহসিনিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। এই মাদরাসা থেকে তিনি মাদরাসা শিক্ষার উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর তিনি কলকাতার সিন্দুরিয়াপট্টি মসজিদে অবস্থানরত গাজীয়ে বালাকট হযরত হাফেজ জামালুদ্দীন (রহ)-এর তত্ত্বাবধানে কোরআন, হাদিস, ইলমে ফিক্হ, সিয়াসিত্তা, ওসুল ইত্যাদি বিষয়ে পা-িত্য অর্জন করেন। এরপর মাওলানা বিলায়েতীর কাছ থেকে মান্তিক ও হিকমত বিষয়ে পা-িত্য অর্জন করেন। অতঃপর ইলমে তাসাওউফেও শিক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি সুফী ফতেহ আলী ওয়াইসীর মুরিদ হন। তাঁর কাছ থেকে তিনি কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নফ্সবন্দিয়া, মুজাদ্দেদীয়া আওর মুহম্মদীয়া তরিকাসমূহের তালিম গ্রহণ করেন। কঠোর রিয়াফাতের মাধ্যমে অচিরেই তিনি পূর্ণ কামালিয়াত হাসিল করেন এবং পীর সূফী ওয়াসী (রহ) তাঁকে খিলাফতনামা প্রদান করেন। খিলাফতনামা দেয়ার সময় পীর তাঁকে বলেন : বাবা আবু বকর তুমি ঝড়ের বেগে সমাজ থেকে শিরক, বেদাত ও সকুসংস্কারের শেকড় উৎপাটিত করবে। অচিরেই তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। দলে দলে লোক এসে তাঁর নিকট মুরিদ হয়। মুজাদ্দিদে যামান অর্থাৎ যুগ সংস্কারক হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি জমিয়তে উলামায়ে বাংলা-অসম এবং আঞ্জুমানে ওয়ায়েজিন গঠন করে তিনি নানা মত ও পথের আলেমগণের মধ্যে ঐক্য বন্ধন স্থাপন করেন। তিনি বাংলা ভাষায় পুস্তক-পুস্তিকা ও পত্র-পত্রিকা প্রকাশে মুসলিম লেখকদের উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয় বহু পত্রিকা। যেমন : মিহির সুধাকর ইসলাম প্রচারক, কোহিনূর, বঙ্গনূর, সুলতান, ইসলাম দর্শন, মোসলেম ভারত, সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, শরিয়ত, শরিয়তে ইসলাম প্রভৃতি। এমনকি মাওলানা আকরাম খাঁ ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক আজাদ প্রকাশ করলে এই পত্রিকা প্রকাশে তাঁর সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফুরফুরা শরীফে প্রতিষ্ঠিত করেন ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মাহফিল। এই মাহফিলে লাখ লাখ লোক সমবেত হয়ে সত্যিকার শিক্ষা ও হিদায়েতের আলো লাভে ধন্য হতে থাকে। তিনি বাংলা ও অসমের বিভিন্ন স্থানে এ ইসালে সওয়াব মাহফিল কায়েম করেন। তিনি সত্যিকার অর্থে মুজাদ্দিদ ছিলেন। তাঁর মুজাদ্দিয়াতের প্রভাব আজও অব্যাহত রয়েছে। তাঁর অসিয়তনামা আজও পথহারাদের সঠিক পথে চালিত করে। তিনি মিলাদ, কিয়াম এবং মুরাকাবা-মুশাহিদা ও যিকর-আযকারের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। সুন্নতের পুরোপুরি পাবন্দ হওয়ার তাকিদ দিয়েছেন। তাঁর খলিফাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন বহু গ্রন্থ প্রণেতা মাওলানা রুহুল আমীন, শর্ষিনার পীর মাওলানা নিসার উদ্দীন আহমদ, বহু ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মাওলানা শাহ সূফী তোয়াজ উদ্দিন (রহ), সূফী সদর উদ্দিন (রহ), যশোরের এনায়েতপুরের খান বাহাদুর মাওলানা এনায়েতপুরী (রহ), খুলনার মইজউদ্দিন হামিদী (রহ), সিলসিলায়ে ফুরফুরাভুক্ত ছিলেন প্রফেসর আবদুল খালেক, সোনাকান্দার পীর সূফী আবদুর রহমান প্রমুখ। তিনি সহস্রাধিক মসজিদ এবং ৮ শতাধিক মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ শুক্রবার মুতাবিক ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৩ চৈত্র সুবহে সাদেকের সময় তিনি ফুরফুরা শরীফে নিজ হুজরায় যিকর করতে করতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ইন্তেকালে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। দৈনিক আজাদে মাওলানা আকরাম খাঁ দীর্ঘ শোকবার্তায় বলেছিলেন : মাওলানা আবু বকর সাহেবের ইন্তেকালে অন্তত অর্ধ শতাব্দীব্যাপী একটা কর্মজীবনের ও ধর্ম সাধনার অবসান ঘটল... তাঁর কর্মময় জীবনের বিভিন্ন দিকের অসাধারণ তৎপরতার পরিচয় দিতে যাওয়া আজ আমাদের পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব। তাঁর অমায়িক ব্যবস্থার তাঁর অসাধারণ আখলাক এবং আমাদের প্রতি তাঁর অশেষ স্নেহের বর্ণনা করতে যাওয়াও আজ আমাদের সাধ্যাতীত। তাঁর লাখ লাখ মুরিদ ও গুণমুগ্ধ ভক্তের ন্যায় আমরাও আজ এই বিরাট ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের তিরোধানে শোকে অভিভূত। বাংলা ও উর্দুতে তাঁর অনেকগুলো জীবনী গ্রন্থ রয়েছে। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ
×