ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শাহরিয়ার কবির

জামায়াতে ইসলামী খোলস বদলায়, স্বভাব বদলায় না

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ১৫ মার্চ ২০১৯

জামায়াতে ইসলামী খোলস বদলায়, স্বভাব বদলায় না

দক্ষিণ এশিয়ায় জামায়াতে ইসলামী প্রথম দল যারা ইসলাম প্রচারের পূর্বশর্ত হিসেবে রাজনৈতিক দল গঠন করে নিয়মতান্ত্রিক বা অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার কথা বলেছে। অবিভক্ত ভারতে ১৯৪১ সালে লাহোরের আবুল আলা মওদুদী জামায়াতে ইসলামী হিন্দ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে সময় ভারতের মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদসহ অনেকেই মওদুদীকে ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠন করতে বারণ করেছিলেন প্রধানত মানুষে মানুষে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও বিদ্বেষ নিরুৎসাহিত করার জন্য, কারণ এতে মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, একইভাবে সমাজে সম্প্রীতি ও মানবতার মূল্যবোধও বিপন্ন হবে। আমার ‘জিহাদ উইদাউট বর্ডার’ ছবিতে আবুল আলা মওদুদীর পুত্র হায়দার ফারুখ মওদুদী মওলানা আজাদ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘জামায়াতে ইসলামী ঘোষণা ও গঠনতন্ত্র পড়ে তার পিতাকে মওলানা আজাদ বলেছিলেন, ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল করার চেষ্টা করে আমি ব্যর্থ হয়েছি। তুমি ওই পথে যেও না।’ ভারতের ইসলাম ধর্মের অনুসারী, যারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান চেয়েছেন তারা মুসলিম লীগ, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল করতেন কেউ জামায়াতে ইসলামীর মতো কট্টরপন্থী দল পছন্দ করেননি। মওদুদী এই সব রাজনৈতিক দল থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন সব রকম জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে কুফরি বা ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে। মওদুদীর মতে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি মানবসৃষ্ট সব মতবাদ হচ্ছে ইসলামবিরোধী, যারা এসব মতবাদ সমর্থন করবে তারা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে। পরবর্তীকালে মওদুদীর এসব বয়ান দেলোয়ার হোসেন সাঈদীসহ তাবৎ জামায়াতপন্থী মোল্লার ওয়াজ ও বক্তৃতার প্রধান উপজীব্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মওলানা মওদুদীর চিন্তাগুরু আরবের মুহাম্মদ বিন আবদাল ওয়াহাব (খৃ: ১৭০০১৭৮২) সৌদি রাজতন্ত্রকে ইসলামের নামে জায়েজ করার জন্য যেভাবে রাজনৈতিক ইসলামের জন্ম দিয়েছেন একই উদ্দেশ্যে মওদুদী হায়দ্রাবাদের নিজামের রাজতন্ত্রকে কায়েম রাখার জন্য ঘোষণা করেছিলেন, ‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য মুসলমান হিসেবে আমি এই নীতির সমর্থক নই।’ (সিয়ামী কাশমকাশ, ৩য় খন্ড, পৃ. ৬২) জামায়াতে ইসলামী গঠনের পর মওদুদী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য ভারতের চলমান স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছেন। জিন্নাহর পাকিস্তান আন্দোলনেরও বিরোধিতা করেছেন তিনি। ‘সিয়াসী কাশমকাশ’-এর তৃতীয় খ-ে তিনি জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের পাশাপাশি গান্ধী-নেহরু-মওলানা আজাদের নেতৃত্বাধীন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সমালোচনা করে লিখেছিলেনÑ‘... এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য আপনাদের ইসলামের নাম ব্যবহার করার অধিকার নেই। কেননা, ইসলাম সকল প্রকার জাতীয়তাবাদের শত্রু, সেটা ভারতীয় জাতীয়তাবাদই হোক কিংবা নামগড়া মুসলিম জাতীয়তাবাদই হোক।’ (উদ্ধৃত: জামায়াতের আসল চেহারা, আবদুল আউয়াল, ১৯৯৩, ঢাকা)। জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠার আগে মুওদুদী সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে ‘দারুল ইসলাম’ কায়েমের জন্য জিহাদের কথা বলেছেন। সাম্প্রতিককালে ‘আল কায়েদা’ ও ‘আইএস’ হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে ভারতবর্ষ দখলের জন্য ‘গাজওয়ায়ে হিন্দু’-এর যে তত্ত্ব প্রচার করছে সেটি তারা নিয়েছে মওদুদীর কাছ থেকে। দক্ষিণ এশিয়ায় ‘আল কায়েদা’ ও ‘আইএস’-এর সন্ত্রাসী জিহাদী বলয় সম্প্রসারণের মূল খুঁজতে হবে মওদুদীবাদে, যা রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করলেও দর্শন হিসেবে কার্যকর থাকবে। ‘আল কায়েদা’ ও ‘আইএস’-এর অভিধানে ভিন্নধর্ম, ভিন্নমত ও ভিন্ন জীবনধারায় বিশ্বাসীদের যে কোনও স্থান নেই এটি আমরা আফগানিস্থান, পাকিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ার সাম্প্রতিক গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় প্রত্যক্ষ করেছি। এ বিষয়ে মওদুদী তার পত্রিকা ‘তারজুমানুল কুরআন’-এ ১৯৪২ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৪৩ সালের জুন পর্যন্ত কয়েক সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলেন, যা পরে ‘মুরতাদ কি সাজা ইসলামী কানুন মে’ নামে পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী এর অনুবাদ প্রকাশ করেছে ১৯৯০ সালে ‘মুরতাদের শাস্তি’ নামে। মওদুদী এতে লিখেছেন ‘একটি সত্যিকারের ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলমানদের ইসলাম প্রচারের ন্যায় অমুসলিমরা তাদের নিজস্ব ধর্মমত প্রচারের অবাধ সুবিধা লাভ করা সঙ্গত বিবেচিত হবে কি? খোলাফায়ে রাশেদাসহ পরবর্তী খলিফাদের সময় কাফের ও আহলি কিতাবরা তাদের ধর্ম প্রচারের অধিকার ভোগ করেছিল কি? ‘মুরতাদ হত্যার আইনই এ সমস্যাটার সমাধান বহুলাংশে করে দিয়েছে। কেননা আমরা যখন আমাদের আওতায় ও রাষ্ট্রের সীমারেখায় ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাওয়া মুসলমানকে অন্য ধর্ম বা মতবাদ গ্রহণ করার অধিকার দিতে প্রস্তুত নই এমতাবস্থায় এর অর্থ দাঁড়ায়, আমরা ইসলামী রাষ্ট্রের সীমারেখায় ইসলামবিরোধী অন্য কোন দ্বীনের দাওয়াত ও প্রসারকে স্বীকার করি না। অন্য ধর্ম প্রচারের অধিকার দেয়া ও মুসলমানকে ধর্মান্তরিত হবার অপরাধে অপরাধী করা পরস্পরবিরোধী ও বিপরীতমুখী দুই জিনিস। অধিকন্তু শেষোক্ত আইন বলে প্রথমোক্ত বিষয়টি আপনা আপনি বাতিল হয়ে যায়। অতএব মুরতাদ হত্যার আইন বলবতের স্বাভাবিক পরিণামেই ইসলাম তার রাষ্ট্রীয় সীমারেখায় কুফরীর প্রচার প্রসারের বৈধতা স্বীকার করে না।’ মওদুদীর এই তত্ত্বই হচ্ছে সাম্প্রতিকালের রাজনৈতিক ইসলামের ভিত্তি। ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে মওদুদীবাদী দর্শন প্রচারিত হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী নামেই যে রাজনৈতিক ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হবে মওদুদীর মতবাদে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও তাদের সহযোগী অন্যান্য মৌলবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো প্রতিনিয়ত ভিন্নমত ও ভিন্নধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে সন্ত্রাসের যে জমিন উর্বর করছে তার উৎস হচ্ছে মওদুদীর দর্শন। ॥ দুই ॥ ১৫ ফেব্রুয়ারি (২০১৯) জামায়াতে ইসলামীর সহকারী মহাসচিব ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের দলত্যাগে সর্বত্র আলোচনা ও জল্পনা-কল্পনার ঝড় বয়ে গেছে। দলের বর্তমান প্রধান (আমীর) মকবুল আহমেদের কাছে লেখা পদত্যাগপত্রে আবদুর রাজ্জাক দলের কয়েকটি ভুল বা বিচ্যুতির উল্লেখ করেছেন, যার ভেতর প্রধানতম হচ্ছে ’৭১-এর ভূমিকার জন্য জামায়াতের ক্ষমা না চাওয়া। দলের সাংগঠনিক কাঠামো, গণতন্ত্রায়ন, নারীদের মূল্যায়ন ইত্যাদি কিছু বিষয়ে তার ভিন্নমত প্রকাশ করে পদত্যাগপত্রের উপসংহারে জামায়াতে ইসলামী নাম পাল্টে নতুন নামে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের অধীনে ইসলামিক রাজনীতি প্রচারের পরামর্শ দিয়েছেন রাজ্জাক। বিএনপি এবং সমমনারা ব্যারিস্টার রাজ্জাকের এই বোধোদয়কে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন বিবেচনা করে স্বাগত জানিয়েছে। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ প্রথম দিকে এ বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করলেও পরে আমাদের কঠোর সমালোচনার কারণে পিছিয়ে এসেছেন। গণমাধ্যমে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন জামায়াতের একজন শীর্ষ নেতার পদত্যাগ নিয়ে চায়ের পেয়ালায় তুফান সৃষ্টি হয়েছে তখন আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলেছি ব্যারিস্টার রাজ্জাকের এই পদত্যাগ ও দলের সমালোচনা সাপের খোলস বদলানোর মতো স্বাভাবিক ঘটনা। রাজ্জাক দলত্যাগ করেছেন, দলের দর্শন মওদুদীবাদ ত্যাগ করেননি। যে কারণে জামায়াতের মহাসচিব বলেছেন, রাজ্জাকের সঙ্গে তাদের ‘মহব্বতের সম্পর্ক’ অটুট থাকবে। ’৭১-এর ভূমিকা সম্পর্কে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের বক্তব্য রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। জামায়াত এবং রাজ্জাক মনে করেন ’৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে জামায়াত ভুল করেছে। রাজ্জাকের আগে নিজামী ও অন্যান্য নেতাও মৃদু আত্মসমালোচনা করে বলেছিলেন, ’৭১-এ দলের শীর্ষ নেতা ও নীতিনির্ধারকরা ‘ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ’ ও ‘পাকিস্তান ভাঙার চক্রান্ত’কে বেশি প্রাধান্য দিতে গিয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্খা বুঝতে পারেনি। এটা ছিল জামায়াতের রাজনৈতিক ভুল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুলালে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসামি পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক সব সময় গণহত্যার জন্য দায়ী তার নেতাদের রাজনৈতিক ভুলের কথাই বলেছেন। পদত্যাগপত্রেও রাজ্জাক এই রাজনৈতিক ভুলের জন্য দলকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন, গণহত্যার জন্য নয়। চলবে...
×