ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লোকনাট্য দলের সোনাই মাধবের সমন্বিত মঞ্চ উপস্থাপনা

প্রকাশিত: ১০:২০, ১৪ মার্চ ২০১৯

  লোকনাট্য দলের সোনাই মাধবের সমন্বিত মঞ্চ উপস্থাপনা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পদাবলি কীর্তন ও যাত্রাপালার সমন্বয়ে উপস্থাপিত লোক নাট্যদলের ‘সোনাই মাধব’ ট্র্যাজিকমেডির এক অপূর্ব সমন্বিত মঞ্চ উপস্থাপনা যা বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারে হলভর্তি দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। মিলনায়তনে সৃষ্টি হয় নাট্যগাথার এক অভাবিত ইন্দ্রজাল। প্রায় দেড় ঘণ্টার এই নাট্য প্রযোজনার কোন মুহূর্তই ফাঁকা মনে হয়নি দর্শকের। নাটকে দেখা যায় গ্রামের দেওয়ান ভাবনা’র অত্যাচারে সুন্দরী মেয়েরা ঘরের বাইরে যেতে পারছে না। সে সোনাইয়ের কথা জেনে তার মামার কাছে যায়। মামা প্রথমে সোনাইকে ভাবনার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয় না, পরে মৃত্যুর ভয় দেখালে সে বলে দেয়, নদীতে জল আনতে গেলে যেন সোনাইকে সে বজরায় তুলে নেয়। ভাবনা তাই করে। বজরা থেকে কান্নার শব্দ শুনে মাধব গিয়ে তাকে উদ্ধার করে এবং দেখে সে মেয়ে তারই সোনাই। ঘরে নিয়ে আসে, বিয়ের আয়োজন করে। কিন্তু দেওয়ান মাধবের বাবাকে ধরে নিয়ে যায়, তাই বাবাকে উদ্ধার করার জন্য মাধব যায় দেওয়ানের কাছে। সোনাই এক বছর একা থাকে ঘরে। তারপর ফিরে আসে তার শ্বশুর। সে বলে সোনাই না গেলে মাধবকে ছেড়ে দেবে না। বাধ্য হয়ে সোনাই যায় মাধবকে ছাড়াতে। দেওয়ান মাধবকে ছেড়ে দিয়ে ঘরে এসে দেখে সোনাই বিষপানে আত্মহত্যা করেছে। কাহিনী শেষ হয় মাধবের হাহাকারে, সে নদীর ঘাটে বসে সোনাইকে ডেকে চলে। এ যেন নাট্যগাথার এক অভাবিত ইন্দ্রজাল। দেশীয় লোকজ নাট্য আঙ্গিক এবং এলিজাবেথিয়ান নাট্য আঙ্গিক কখনো কখনো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। মৈমনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে পদাবলি যাত্রা ‘সোনাই মাধব’। নিরাভরণ মঞ্চে পালা ঢঙে পরিবেশিত সঙ্গীত ও নৃত্যের সম্মিলনে মঞ্চে এক অভাবিত দৃশ্যকাব্যে তরঙ্গায়িত হয়েছে। পাশ্চাত্যের মিউজিক্যাল এবং অপেরার সঙ্গে আমাদের লোকজ নৃত্য অথবা গীতিনাট্যের তেমন কোন সাদৃশ্য নেই। বেইজিং অপেরার সঙ্গেও তেমন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। লোক নাট্যদলের সোনাই মাধব প্রযোজনা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে একীভূত করে মনোজগতে স্থান করে নিয়েছে। বর্তমান, অতীত আর দেশ-বিদেশের নানা সঙ্গীত ও নৃত্যবহুল প্রযোজনার আলোকরশ্মি যেন সবার মনোজগৎকে আলোকিত করে তুলেছিল। মৈমনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে লোক নাট্যদলের পদাবলি যাত্রার সুরারোপ করেছেন যুগ্মভাবে দীনেন্দ্র চৌধুরী ও লিয়াকত আলী লাকী। এই নাট্য উপস্থাপনার পরিকল্পনা, সঙ্গীত পরিচালনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন লিয়াকত আলী লাকী। এই নাট্য প্রযোজনার শেষ দৃশ্যকে কখনো কখনো শেক্সপিয়ারের রোমিও জুলিয়েটের মতো মনে হয়েছিল। কুশীলব, নাট্য কুশলী, গায়ক-গায়িকারা সবাই পালার ঢঙে চতুষ্কোণ মঞ্চের চারধারে বসে ছিল। মঞ্চে প্রবেশ আর বের হওয়া ছিল উপভোগ্য, কারণ চরিত্রকে ধারণ করে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মঞ্চে প্রবেশ করছিল এবং মঞ্চের বাইরে গিয়ে চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসছিল। এই নাটকের প্রায় সব কুশীলবই সঙ্গীত ও নৃত্যবহুল এই প্রযোজনায় মনোগ্রাহী অভিনয় করেছেন। মুখ্য চরিত্র সোনাই আর মাধবের ভূমিকায় রূপসা ও লিটন বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করেছে। তবে দেওয়ান ভাবনার ভূমিকায় লিয়াকত আলী লাকী তাঁর অনন্য অভিনয় প্রতিভার স্ফূরণ ঘটিয়ে স্তম্ভিত করেছেন। যেমন নৃত্যে ছিল তার কুশলী দেহ-ভঙ্গিমা, তেমনি সঙ্গীত ও কথনে ছিল তার পারঙ্গমতা। লাকী আর তার সহশিল্পীদের অভিনয় দর্শকদের আনন্দ হাসির বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছে নাট্যের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে। লিয়াকত আলী লাকী ট্র্যাজিক মুহূর্তেও সমসক্ষমতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন। এ ছাড়া নাটকের অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন রহিমা খাতুন, উম্মে মরিয়ম, কিশোয়ার জাহান, মোমিন মিয়া, সুচিত্রা রানি সূত্রধর, রওশন হোসেন, তাজুল ইসলাম মুন্সি প্রমুখ।
×