ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কিডনি বিকল রোগীদের জন্য কিডনিদাতার তীব্র সঙ্কট

প্রকাশিত: ১০:১৬, ১৪ মার্চ ২০১৯

  কিডনি বিকল রোগীদের জন্য কিডনিদাতার তীব্র সঙ্কট

নিখিল মানখিন ॥ দেশে কিডনি বিকল রোগীদের জন্য কিডনিদাতার সঙ্কট প্রকট হয়েছে উঠেছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষমাণ মোট রোগীদের মাত্র শতকরা ২ ভাগ রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন সম্ভব হয়। অন্যরা নিজেদের মতো চেষ্টা করে রোগী নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। বাকিরা ডায়ালাইসিস দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে থাকেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাকা দিয়েও কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিডনি দেয়ার পর ফলোআপ চিকিৎসা ও বিভিন্ন কারণে নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন জীবিত কিডনিদাতারা। পাশাপাশি রয়েছে কিডনি সার্জনের সঙ্কট। আইনী জটিলতাসহ নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার কারণে কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রমে অংশ নিতে চান না সার্জনরা। এভাবে ব্যয়বহুল চিকিৎসা, উন্নত চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনের জটিলতার কারণে শত শত কিডনি বিকলরোগী অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। মৃত্যুর মুহূর্ত দেখার অপেক্ষা করা ছাড়া বিকল্প কোন উপায় থাকছে না রোগীর স্বজনদের। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব কিডনি দিবস। বিশেষজ্ঞরা জানায়, দেশে প্রায় ২ কোটি লোক কোন না কোন ধরনের কিডনি রোগে ভুগছে। আক্রান্তের শতকরা ৭৫ ভাগ রোগী কিডনি নষ্ট হওয়ার আগে এ মরণব্যাধির অস্তিত্ব ধরতে পারেন না। কিডনি বিকল রোগীর চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে, মাত্র শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ লোকের চিকিৎসা চালিয়ে যাবার সামর্থ্য আছে। দেশে প্রতিবছর ২৫ হাজার লোকের কিডনি বিভিন্ন কারণে হঠাৎ অকেজো হয়ে যায়। প্রতিবছর কিডনিজনিত রোগে প্রায় ৪০ হাজার লোক মারা যায়। দেশে প্রতিবছর ৩৫ হাজার মানুষের কিডনি স্থায়ীভাবে অকার্যকর হয়ে আছে। এদের মাত্র ২০ শতাংশ প্রতিস্থাপন চিকিৎসা (ডায়ালাইসিস ও ট্রান্সপ্লান্ট ) পাচ্ছে। চিকিৎসা ব্যয় ॥ দেশে কিডনি রোগ চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও খুব ব্যয়বহুল। প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু থাকলেও সফলতার মাত্রা খুব বেশি সন্তোষজনক নয়। দেশের সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কিডনি প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা নেই। সীমিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ডায়ালাইসিসি ও প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু রয়েছে। কিডনি রোগের উপসর্গ ও চিকিৎসা সম্পর্কে অধ্যাপক ডাঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। তিনি জানান, বিভিন্ন কারণে কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে কারও কারও কিডনি হঠাৎ করে অকেজো হয়ে যায়। বাংলাদেশে ডায়রিয়া, অতিরিক্ত বমি, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, বিভিন্ন রকম ইনফেকশন, ম্যালেরিয়া, প্রসবকালীন জটিলতা, সাংঘাতিক ধরনের নেফ্রাইটিস, বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও কিডনির পাথরের কারণে হঠাৎ করেও কিডনি অকেজো হয়ে যায়। এ ধরনের কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়ার ভাল দিক হচ্ছে, এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ করা যায়। সময় মতো সঠিক চিকিৎসা করলে অনেকের কিডনি পুনরায় স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরে পায়। এ দেশে প্রতিবছর প্রায় ২৫ হাজার লোকের কিডনি বিভিন্ন কারণে অকেজো হয়ে যায়। সঠিক চিকিৎসা করলে প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ রোগীর কিডনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। হঠাৎ করে কিডনি অকেজো হওয়াকে প্রতিরোধ করতে হলে বিশুদ্ধ খাবার ও পানি পান করতে হবে। রক্তক্ষরণ হলে সঙ্গে সঙ্গে রক্ত দিতে হবে। ইনফেকশন হলে তার সঠিক সময়ে চিকিৎসা করতে হবে। তিনি আরও জানান, প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে কিডনি প্রতিস্থাপন খুবই ব্যয়বহুল। প্রাইভেট হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতেই প্রায় ৩ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেলে কিডনি প্রতিস্থাপনের আগ পর্যন্ত রোগীকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। প্রতি সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করতে হয়। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে প্রতি ডায়ালাইসিসের খরচ ৮শ’ টাকা হলেও প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে লাগে ৩ হাজার টাকা থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, নিজেরা কিডনি দেয়ার পরও সিঙ্গাপুরে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা, থাইল্যান্ডে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং ভারতে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা লাগে সংযোজনের জন্য। অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম জানান, কিডনি প্রতিস্থাপনের দু’দিন আগে থেকে পরবর্তী সারাজীবন ধরে রোগীকে নিউরাল ও সেলসেপ্ট নামে দু’টি ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। ওই দু’টি ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। কিডনি প্রতিস্থাপন ভালভাবে সম্পন্ন হলেও ওই দু’টি ওষুধ নিয়মিত না খেলে রোগীর মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়ে। আর প্রতিটি নিউরাল (১০০এমজি) দাম ১৫০ টাকা এবং প্রতিটি সেলসেপ্টের দাম ১১০ টাকা। এছাড়া কিডনি ভালভাবে মিল না হলে সাইমুলেট নামে দু’টি ইনজেকশন দিতে হয়। এই প্রতিটি ইনজেকশনের দাম পড়ে দেড় লাখ টাকা। সারাজীবন ব্যবহার করতে হওয়ার কারণে ওই দু’টি ওষুধ নিয়মিত খেতে পারে না অনেক দরিদ্র পরিবার। তাই ওই দু’টি ওষুধের ওপর থেকে আমদানি কর উঠিয়ে দিলে কিডনি প্রতিস্থাপন করা অনেক রোগী উপকৃত হবে। বিশেষজ্ঞরা যা বলেন ॥ কিডনিরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে প্রয়োজনের মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। কিডনি দানে আইনী জটিলতা এবং আগ্রহী ব্যক্তির স্বল্পতার কারণে তা প্রতিস্থাপন অনেকাংশে আটকে আছে। ১৯৮২ সালে দেশে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপিত হলেও নিয়মিতভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয় ১৯৮৮ সাল থেকে। এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০৫টি কিডনি প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার হয়েছে, এর মধ্যে শিশুদের ১১টি। ২৯ বছরের হিসাবে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর মাত্র ১৭টি বা প্রতি দুই মাসে তিনটি কিডনি প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। কিডনিরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম এ ওহাব দেশে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু দেশে কিডনিদাতার সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠেছে। কিডনি দাতা ও গ্রহীতার ওষুধের মূল্যহ্রাস এবং মস্তিষ্কের মৃত্যুর (ব্রেইন ডেথ) পর তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসুস্থ ব্যক্তির দেহে সংযোজন করার সুযোগ রেখে আইন তৈরি করা দরকার। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ রফিকুল আলম বলেন, টাকা দিয়েও কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিডনি দেয়ার পর ফলোআপ চিকিৎসা ও বিভিন্ন কারণে নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন জীবিত কিডনিদাতারা। পাশাপাশি রয়েছে কিডনি সার্জনের সঙ্কট। আইনী জটিলতাসহ নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার কারণে কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রমে অংশ নিতে চান না সার্জনরা। বিশিষ্ট কিডনি শল্যচিকিৎসক অধ্যাপক এম এ সালাম বলেন, স্পেন ও নেদারল্যান্ডসে মৃত ব্যক্তির শরীরের মালিক রাষ্ট্র। মৃত ব্যক্তির কিডনি বা অন্য অঙ্গ তারা প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে। এ দেশেও এমন কিছু করা উচিত, যেন মৃত ব্যক্তির শরীরের কয়েকটি অঙ্গ প্রয়োজনে অন্যের শরীরে স্থাপন করা যায়।
×