ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বরেন্দ্র অঞ্চলের ঐতিহ্য ‘ভীমের পান্টি’ হারিয়ে যাচ্ছে অযত্নে

প্রকাশিত: ১০:১৫, ১৪ মার্চ ২০১৯

বরেন্দ্র অঞ্চলের ঐতিহ্য ‘ভীমের পান্টি’ হারিয়ে যাচ্ছে অযত্নে

ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ উত্তরের নওগাঁ জেলার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো অযত্ন আর অবহেলায় দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে। বিলুপ্তপ্রায় নিদর্শনের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখতে সরকারের আশু উদ্যোগ গ্রহণ জরুরী হয়ে পড়েছে। এই জেলার কয়েকটি ঐতিহাসিক নিদর্শনের মধ্যে ‘ভীমের পান্টি’ একটি। এছাড়া নওগাঁয় রয়েছে জগদ্দল বিহার, আলতাদীঘি, মাহিসন্তোষ, আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান শালবন, কুসুম্বা মসজিদ ও দিব্যক জয়স্তম্ভ। প্রায় দু’শ’ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক ‘ভীমের পান্টি’ অযত্ন আর অবহেলায় দিন দিন ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাচ্ছে। নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার একেবারে পূর্বপ্রান্তে জয়পুরহাট জেলার সীমানা ঘেঁষে জাহানপুর ইউনিয়নের মুকুন্দপুর-হরগৌরী এলাকায় একটি মাঝারি আকারের ঢিবি রয়েছে। এই ঢিবির বেড় ১৭০ মিটার এবং উচ্চতা ১০ মিটার। সেখানে ছোট-বড় ১৪টি বিভিন্ন আকারের পুকুর আছে। ধামইরহাট-জয়পুরহাট সড়কের মঙ্গলবাড়ী বাজার থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে মুকুন্দপুর গ্রামে হরগৌরী মন্দির তথা ‘ভীমের পান্টি’ অবস্থিত। মঙ্গলবাড়ী থেকে পাকা রাস্তাযোগে কাজীপাড়া যাওয়ার পথে ‘ভীমের পান্টি’ পাওয়া যাবে। পাকা রাস্তা থেকে মাত্র ৪শ’ মিটার ইট বিছানো ও মেঠোপথ দিয়ে যেতে হয় সেখানে। পুকুরগুলোর মধ্যে একটি পুকুর ‘অমৃতকু-’ ও অপরটি ‘কোদাল ধোয়া’ নামে পরিচিত। এগুলোর মধ্যে পুকুরের পশ্চিমপাড়ে অবস্থিত একটি ঢিবিতে কী রয়েছে তা আজও জানা সম্ভব হয়নি। তবে এর সর্বত্র ইটপাটকেল ও খোয়া কুচির ছড়াছড়িসহ কোথাও কোথাও কাদায় গাঁথা ইটের গাঁথুনির পলেস্তারাবিহীন চিহ্ন দেখা যায়। জানা গেছে, প্রায় ২শ’ বছর আগে বীরেশ্বর ব্রহ্মচারী নামে এক সাধক এ ঢিবিতে একটি কালো পাথরে উৎকীর্ণ মাঝারি আকারের মূর্তি পেয়েছিলেন। তাই তিনি ওই ঢিবির ওপর ছোট আকারের চারটি মন্দির নির্মাণ করে মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সময় ঢিবির ওপর উত্তর-পশ্চিম কোণে ২ দশমিক ৩৯ মিটার ও ৯১ সেন্টিমিটার পরিসরের এক কোঠাবিশিষ্ট একটি পূর্বমুখী স্থাপনা ছিল। ১৯৭৮ সালে ওই ঢিবি থেকে একটি চোকলাতলা কালো পাথরের উমা-মহেশ্বর মূর্তি উদ্ধার করে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়। ওই ঢিবির দক্ষিণে ৫৮ সেন্টিমিটার দূরত্বে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা অনুরূপ আরও একটি ভাঙ্গা দেয়াল রয়েছে, যার উচ্চতা ১ দশমিক ২২ মিটার। এগুলোকেই বীরেশ্বর ব্রহ্মচারী স্মৃতিবিজড়িত নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা যায়। বর্তমানে এগুলোর নিদর্শন নিশ্চিহ্ন করে সেখানে নতুন মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। ঢিবির পাদদেশ থেকে দক্ষিণ দিকে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি শুরু। দূরে একটি উঁচু পাড়ওয়ালা পুকুরও রয়েছে। তবে এ প্রত্নস্থলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হলো একখন্ড কালো পাথরের থাম- যার নাম ‘ভীমের পান্টি’, যা ঢিবি থেকে মাত্র ৮১ মিটার দক্ষিণে ফসলি জমির মাঝে সামান্য হেলে সম্পূর্ণ অরক্ষিতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘ভীমের পান্টি’ আবার কেউ কেউ কৈবর্ত্য রাজা ভীমের লাঠি বা গদা বলেও দাবি করেন। দেখতে অনেকটা প্রলম্বিত মোচার মতো। এই থামের গা অত্যন্ত মসৃণ। পাদমূলে এর বেড় ১ দশমিক ৮০ মিটার। বর্তমান উচ্চতা ৩ দশমিক ৭৯ মিটার। অতীতে এর ওপর একটি বিষ্ণুর বাহন অর্ধনর ও অর্ধপাখির মূর্তি বসানো ছিল। কিন্তু বজ্রপাতের আঘাতে সেটি নিশ্চিহ্ন হওয়াসহ থামের মূল অংশের একটি ফালি ধসে গেছে। তবে অক্ষত থাকা অংশের ৫৬ দশমিক ৭ সেন্টিমিটার ও ৪৯ দশমিক ৩ সেন্টিমিটার পরিমাপের একটি চতুষ্কোণাকার থামের উপরের অংশে আজও ২৮ পঙক্তির একটি সংস্কৃত উক্তি উকীর্ণ রয়েছে। থামটি বরেন্দ্রর পাল রাজা নারায়ণ পালের মন্ত্রী ভটুগুরুভ (৮৯৬-৯৫০) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এতে ওই রাজবংশসহ মিশ্র বংশপঞ্জি বর্ণিত রয়েছে। এটি দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসে। মঙ্গলবাড়ী সাহিত্য আড্ডা সংগঠনের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভীমের পান্টি’ বরেন্দ্র অঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। প্রাচীন নিদর্শনটি সংরক্ষণ করা খুবই জরুরী। মুকুন্দপুর গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি বিশ্বনাথ সিংহ বলেন, এখানে কালীমন্দির, শিব মন্দির, হরগৌরী মন্দির এবং ‘ভীমের পান্টি’ থাকায় হাজার হাজার পুণ্যার্থীর আগমন ঘটে। তাছাড়া প্রতিবছর বিশেষ করে মাঘী পূর্ণিমা ও বেশাখের শেষ সপ্তাহে ১ দিনের জন্য মেলা বসে। মেলায় হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। কিন্তু মাত্র ৪শ’ মিটার মেঠোপথ থাকায় কষ্ট করে মানুষজনকে আসতে হয় এখানে। মন্দির ও ‘ভীমের পান্টি’ সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি বিজয় চন্দ্র মন্ডল বলেন, হিন্দুদের জন্য এটি একটি তীর্থস্থান। কিন্তু এখানে পাকা রাস্তা নেই, বিদ্যুত নেই এবং লোকজনের থাকার কোন সুব্যবস্থা না থাকায় পুণ্যার্থীদের অনেক ভোগান্তি হয়।
×