ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মমতাজ লতিফ

সুশিক্ষার জন্য নিতে হবে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম

প্রকাশিত: ১১:৩৭, ১২ মার্চ ২০১৯

সুশিক্ষার জন্য নিতে হবে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম

ভেবেছিলাম, আশা করেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শত্রু খালেদা-তারেক কৃত বহু অপরাধের মধ্যে কয়েকটিতে দ-িত হওয়ার পর এদের নাশকতা ও ষড়যন্ত্রের অপরাজনীতির মূলোৎপাটন হয়েছে। ভেবেছিলাম, বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা, যারা উচ্চ শিক্ষিত, অনেকে মুক্তিযোদ্ধা, তারা হয় বিএনপি ত্যাগ করে নতুন একটি জাতীয়তাবাদী ধারার ইতিবাচক রাজনীতি চর্চার লক্ষ্যে নতুন দল তৈরি করবে অথবা রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করবে। আরেকটি বিকল্প হচ্ছে, ড. বদরুদ্দোজার দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে একটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল গঠন করা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনেতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক ইতিবাচক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে প্রধানত প্রধানমন্ত্রীর বুদ্ধিদীপ্ত মেধাবী দূরদৃষ্টিপূর্ণ সুফলদায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে। এটা তো সর্বজনমান্য সত্য যে, ২০১০-এ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অধীনে মহাজোট সরকার নির্বাচনে জয়ী হয়ে জাতির কাছে প্রদত্ত নির্বাচনী ওয়াদা পূরণের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের অসম্পন্ন কাজ। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, দীর্ঘকাল ধরে যা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল, সেই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের প্রধান প্রধান অপরাধীকে সর্বোচ্চ দ-ে দ-িত করে জাতির বড় একটি কলঙ্ক মোচনের কাজ করেছে। সেই সঙ্গে জাতিকে প্রথম সুশাসন প্রতিষ্ঠার নজিরও উপহার দেয়। এর চেয়ে বড় সুশাসনের নজির আর কি হতে পারে? বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনটি প্রণয়ন করেছিলেন, আশ্চর্য এই যে, ৭৩ থেকে ২০১০-এ দীর্ঘ ৩৭ বছর পর তাঁর কন্যার হাত দিয়ে আইনটি বাস্তবায়িত হয়! এভাবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ তার জন্মের শত্রুদের প্রাপ্য দ-ে দ-িত করে দেশের রাজনীতি থেকে একদল অপরাজনীতিক, হত্যাকারী-ধর্ষক, লুটেরাদের বাংলাদেশ বিরোধিতার রাজনীতির মূলোৎপাটনের মাধ্যমে সুরক্ষিত হয়। বর্তমানে এদের এবং জামায়াতের ‘৭১ থেকে আজ পর্যন্ত অর্জিত বিপুল অর্থ-সম্পদ-বিত্ত বাজেয়াপ্ত করার কাজটি বাকি আছে। বাকি আছে জামায়াতের দল হিসেবে যুদ্ধাপরাধের বিচার কাজও। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের শত্রুমুক্ত হওয়ার দ্বিতীয় ধাপ জামায়াতের পরীক্ষিত মিত্র, আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা, মুক্তিযুদ্ধের শত্রু পাকিস্তান ও আইএসের নির্দেশে বাংলাদেশে ষড়যন্ত্র ও নাশকতার অব্যাহত অপরাজনীতির পরিচালক খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের কয়েকটি অপরাধে দ-িত হওয়া, যার কয়েকটি সম্পন্ন হয়েছে। তাছাড়া, বাংলাদেশে জঙ্গী উত্থানের প্রধান প্রশ্রয়দাতা খালেদা-নিজামী-তারেকের দ-িত হওয়ার ফলে রাজনীতির মাঠ অন্তত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিরোধিতার খল রাজনীতিকদের হাত থেকে মুক্তি পেল জাতি। এদের অনুপস্থিতি মহাজোট সরকারকে জঙ্গী নির্মূলে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা সহজসাধ্য করেছে, তা বলাইবাহুল্য। প্রকৃত অর্থে, সংক্ষেপে বলতে গেলে, বাংলাদেশের সুশাসনের সূচনা ঘটে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মৌলবাদী জঙ্গী সন্ত্রাস দমন, বিচার এবং জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ, তা কঠোর হস্তে বাস্তবায়ন এবং হিন্দু-সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে। এবারের নতুন সরকারকে ‘জিরো-টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করতে হবেÑ দুর্নীতির বিরুদ্ধে, নদী-খাল-ভূমি দখলদারের বিরুদ্ধে এবং একই সঙ্গে ষড়যন্ত্র ও নাশকতামূলক অপরাজনীতির বিরুদ্ধে। পাশাপাশি-সরকারকে তরুণ প্রজন্মের জন্য ভাল মানের শিক্ষা প্রদান করার মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থান ও আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে, যা পরিণামে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য হ্রাসে ভূমিকা রাখবে। সত্যি কথা বলতে, গুণগত মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম, শিশু কিশোর, তরুণ-তরুণীরাই দেশকে প্রতিটি ক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাদের শিক্ষার মান- এর সঙ্গে এ সরকার কোনমতেই কমপ্রোমাইজ করতে পারে না। বরং সরকারকে এ লক্ষ্যে শীঘ্রই ক্র্যাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ করতে হবে, যার কোন বিকল্প নেই। নতুন শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে একসঙ্গে আন্দোলনে রাজপথে ছিলাম, সেই ‘ইয়েস উদ্দীন’ এর সব কাজের প্রতিবাদে। আমার পুরনো প্রস্তাবগুলো তাঁকে আবারও সংক্ষেপে জানাই। শিক্ষায় গুণগত মান অর্জনের লক্ষ্যে প্রথমেই একটি বৈপ্লবিক ক্র্যাশ প্রোগ্রাম প্রণয়ন করতে হবে, যাতে শুধু সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-শিক্ষক, তথ্য-প্রযুক্তিবিদ, তরুণ-তরুণী যারা শিক্ষা ক্ষেত্রে নানারকম ধারণা নিয়ে সারাদেশে দরিদ্র, এতিম, স্কুলের বাইরে থাকা নানা কাজ করে নিজেদের ও পরিবারের ব্যয় মেটাতে পড়াশোনার সুযোগ পায় না, তাদের শিক্ষা, বস্ত্র, খাদ্য, বিনোদন দেয়ার হাজার রকমের ছোট ছোট কর্মসূচী পরিচালনা করছে, তাদের সঙ্গে নিয়ে দেশের সব রকম পেশাজীবীদের ঐক্যবদ্ধ একটি আন্দোলন শুরু করতে হবে। সরকারকে ‘জিরো টলারেন্স টু লো কোয়ালিটি এডুকেশন’ অথবা ‘নিরক্ষরতা ও মানহীন শিক্ষা হটাও’ নামের এক জাতীয় আন্দোলন শুরু করতে হবে। অর্থাৎ এ আন্দোলনের মাধ্যমে জাতির মর্মমূলকে নাড়া দিয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব পেশাজীবী এ আন্দোলনে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী অবদান রাখবে। এ আন্দোলনের দুটো লক্ষ্য হবেÑ ১) ক্লাস ফোর থেকে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ২) প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ। এদের বাংলা, ইংরেজী, গণিত, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের বাছাইকৃত পাঠের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে প্রধান কাজ। ধরা যাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়নের ছাত্র-ছাত্রীরা ২৫টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলকে ‘এডপ্ট’ করবে, যাদের বাংলা, ইংরেজী, বিজ্ঞান বিষয়ের কঠিন পাঠগুলোর ওপর পাঠদান করবে। শিক্ষকরা ওই পাঠদান থেকে নিজেদের দক্ষতাকে আরও মজবুত করবে। এ রকম সব সরকারী, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের ছাত্রছাত্রী ২৫টি (২০টি প্রাথমিক, ৫টি মাধ্যমিক)Ñ স্কুলের শিক্ষার্থীদের, সেই সঙ্গে শিক্ষকদের পাঠদান করে শিক্ষার মান উন্নত করবে। যারা গ্র্যাজুয়েট কিন্তু কোন চাকরিতে নেই, তাদের থেকে বাছাই করে বাংলা, ইংরেজী, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নে পাঠ দিতে সক্ষম এমন তরুণ-তরুণীদের ওরিয়েন্টশন দিয়ে এক বছরের ক্র্যাশ প্রোগ্রামে নিয়োগ করা দরকার। এমন কি, জাতীয় এ কর্মসূচীতে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং মাধমিক স্কুলের আগ্রহী, ওই বিষয়ে দক্ষ শিক্ষকরাও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের স্ব-স্ব বিষয়ে পাঠদান করতে পারেন। একটি জাতীয় সমন্বয় কমিটি পুরো কার্যক্রমটি বাস্তবায়ন করবে, এর উপযোগী কৌশল প্রণয়ন করবে এবং কার্যক্রমটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য মনিটরিং করবে। তাছাড়া, প্রত্যেক জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শাখা- মান-সম্মত শিক্ষা আন্দোলন কমিটি গঠন করে তৃণমূলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে বাংলা, ইংরেজী, গণিত, পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন-এ শিক্ষার্থীদের স্পেশাল পাঠদান কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন মনিটর করার ব্যবস্থা করতে হবে। উল্লেখ্য, পনেরো-বিশ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার মানোন্নত করার লক্ষ্যে ভারত থেকে প্রায় বিশ হাজার গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়েছিল। এ উদাহরণটি আমরাও ব্যবহার করতে পারি, যদি আমাদের যোগ্য গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষকের ঘাটতি হয়। তবে সেই ক্ষেত্রে আমরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মতোই শিক্ষক এনে আমাদের একটি প্রজন্মের ভাষা, গণিত ও বিজ্ঞানের ভিত মজবুত করতে পারি। এতে কোন সমস্যা নেই। আমাদের গার্মেন্টসহ অনেক কর্পোরেট অফিসে ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ের অধিকাংশ পদে দক্ষ ভারতীয়, কিছু শ্রীলঙ্কান চাকরি করছে, যেহেতু ম্যানেজমেন্টে দক্ষ বাংলাদেশী কর্মকর্তার অভাব রয়েছে। এ সঙ্গে শিক্ষা প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলতে চাই। প্রথমত:, দ্বিতীয়ত:, তৃতীয়ত: মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরের বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানের মানসম্মত শিক্ষা জাতির শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান করুণ অবস্থাকে রূপান্তরিত করে দেবে। কেননা, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষক যেমন মাধ্যমিক স্তর পাস করেই আসে, তেমনি উচ্চশিক্ষার বুনিয়াদও ভাল মানের মাধ্যমিক শিক্ষাই গড়ে দেয়। উপরন্তু, নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেও বুঝতে পারি, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার ভাষা ও গণিতের দুর্বলতা মাধ্যমিক স্তরে পূরণ করে নেয়া সম্ভব হয়, যদি মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী যথোপযুক্ত শিক্ষা পেয়ে তার শিক্ষার ঘাটতি পূরণের সুযোগ লাভ করে। তবে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় যেহেতু শিশু ভাষা ও গণিতের মৌলিক দক্ষতাগুলো শেখে, তাই সেই শিক্ষার মানও ভাল হলে যে কোন শিক্ষার্থী মাধ্যমিকের শিক্ষাও ভালভাবে শুরু করতে পারে। তবে মাধ্যমিকে ভাষা, গণিত ও বিজ্ঞানের জ্ঞান ও দক্ষতা উচ্চমানের হওয়ায় এ স্তরে প্রায় সব শিক্ষার্থীকে শিক্ষক বা টিউটরের সাহায্য নিয়ে শিক্ষার এ পর্যায়টি মানসম্মতভাবে শেষ করতে দেখা যায়। এর অর্থ ভাল মানের মাধ্যমিক শিক্ষা সব শিক্ষার্থীকে তাদের কাক্সিক্ষত মানের উচ্চশিক্ষা গ্রহণকে সহজসাধ্য করে দেয়। আসলে, বর্তমান সময়টিতে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের পক্ষে শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে। কেননা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতি অনেকগুলো কঠিন বাধা অতিক্রম করে এ সময়টিতে এসে পৌঁছেছে। তাই, এ সময়টিকে হেলায় হারানো সরকার ও জাতির জন্য ক্ষমার অযোগ্য হবে। শিক্ষাকে না বলার, খুনী সন্ত্রাসীদের না বলার, অপরাজনীতি ও দেশপ্রেমহীন নাশকতার রাজনীতিকে না বলার এমন সুবর্ণ সময় কিন্তু আর আসবে না। লেখক : শিক্ষাবিদ
×