ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অরণ্যে অগ্নিশিখা ফোটে বসন্তে লম্বা মঞ্জরি

প্রকাশিত: ১১:০৮, ১২ মার্চ ২০১৯

অরণ্যে অগ্নিশিখা ফোটে বসন্তে লম্বা মঞ্জরি

শেখ আব্দুল আওয়াল ॥ শীতের শীর্ণতা কাটিয়ে নতুন প্রাণ এবং নব উদ্দীপনা নিয়ে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। বাংলার শেষ ঋতু বসন্ত। এ সময় বাংলার প্রকৃতি পত্রপুষ্পে সুশোভিত হয়ে ওঠে। বনে বনে ফুলের সমারোহ, আর দূর থেকে ভেসে আসে কোকিলের কুহুতান। পত্রহীন গাছে গজায় নতুন পাতা। পত্রপল্লবে শোভিত বৃক্ষশাখে ফুটে বিচিত্র ফুলের বাহার, আম্রশাখে মুকুল দোল খায়। ঋতু প্রকৃতি সাজায় রাজকীয় চাকচিক্যে। এ সময় অশোক, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া ফুলের বর্ণিল ছটায় প্রকৃতির বুকে রঙ্গের ছোঁয়া লাগে। জানা-অজানা ফুলের সুবাসে আকাশ-বাতাস মুখর হয়ে ওঠে। কবি বলেন ‘মহুয়া মালা গলে কে তুমি এলে/নয়ন ভুলানো রূপে কে তুমি এলে”। এভাবেই বাংলার রূপের নায়ক বসন্ত প্রকৃতিকে রূপ-রসে ভরিয়ে তোলে। পলাশ ফুলের নাম জানে না এমন লোক যেমন কম আছে তেমনি পলাশ ফুল চেনে না বা দেখেনি এমন লোকের সংখ্যাই বেশি। পলাশের আরেক নাম কিংশুক। ইংরেজী নাম ফ্লেম অব দ্যা ফরেস্ট, বৈজ্ঞানিক নাম বুটিয়ামনোস্পার্মা। চমৎকার এই ফুল সম্পর্কে উদ্ভিদবীদ দ্বিজেন শর্মা ‘ফুলগুলি যেন কথা’ বইতে লিখেছেনÑমাঝারি আকারের পত্রমোচী দেশী গাছ। ৩টি পত্র নিয়ে যৌগিকপত্র। ফুল ফুটে বসন্তে । ৭.৫-১০ সেঃমিঃ শিম ফুলের মতো। গাঢ় কমলা, লম্বা মঞ্জরিতে ঘনবদ্ধ থাকে। সারাগাছ ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। বীজ থেকে সহজেই চারা জন্মায়, বাড়েও দ্রুত। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা খান বাহাদুর ইসমাইল রোডের ব্রহ্মপুত্র নদের কূলঘেঁষে গফরগাঁও সরকারী কলেজ। কলেজের ইংরেজী বিভাগের সাবেক শিক্ষক অনুপ সাদি ২০০৮সালের মাঝামাঝি ঢাকা বৃক্ষমেলা থেকে ৩০০ টাকায় ক্রয় করে সরকারী কলেজ মাঠে লাগিয়েছিলেন পলাশ ফুলের দুটি চারা। সেটিতে এসেছে বসন্তরাঙ্গা রূপ ও যৌবন। আগন্তুক, পথচারীরা আসা- যাওয়ার সময় একবার হলেও তাকিয়ে দেখে এই ফুলের দিকে। পলাশ ফুলের কাছে গিয়ে কথা হয় কলেজে কর্মরত খোকন আহম্মেদের (৫০) সঙ্গে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি কি ফুলের গাছ জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, সাদি স্যার লাগিয়েছিলেন দুটি চারা। বিগত দিনে এ রকম সুন্দর ফুলগাছ আমি দেখিনি। পলাশ ফুলে বসে শালিক, বউ কথা কও, কোকিলসহ বিভিন্ন পাখি লাফালাফি করে। মূলত বসন্তকালে গাছগুলো যখন তাদের পাতা হারিয়ে দৃষ্টিকটুতায় আক্রান্ত হয় তখনি প্রকৃতি তার আপন লীলায় মত্ত হয়ে দৃষ্টিকটু গাছে উজ্জ্বল লাল বা গাঢ় কমলা রঙ্গের ফুল ফুটিয়ে গাছের আদর বাড়িয়ে দেয়। পাতাহীন গাছের ডালে যত্রতত্র ফুটতে দেখা যায় পলাশকে। তাই তো বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর পলাশকে দেখে লিখেছেন, “রাঙ্গা হাসি রাশি-রাশি অশোকে পলাশে, রাঙ্গা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত আকাশে, নবীন পাতায় লাগে রাঙ্গা হিল্লোল।” পলাশের বিচি থেকে দেশীয় ভেষজ ওষুধ তৈরি করা হয়। এক সময় পলাশ গাছের শিকড় দিয়ে মুজবুত দড়ি তৈরি করা হতো। সেই সঙ্গে পলাশের পাতা দিয়ে তৈরি হতো থালা। কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্নস্থানে এই পলাশ পাতার ছোট বাটিতে ফুচকা বা পানি পুরি বিক্রি করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডঃ মোঃ জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, পলাশ ফুলের গাছ গোড়ায় বাকল ফাটা হলেও আঁকাবাঁকা শাখা-প্রশাখা। বাকল মসৃণ, বোঁটায় তিনটি করে পাতা থাকে। ফাগুনে গাছের পাতা ঝড়ে যায় তখনি আসে গাছে কুড়ি। আর কুড়ি থেকে ফুটে সারা গাছে কমলা-লাল রঙ্গের ফুল। তখন সেই অগ্নিকান্তি রূপ দেখে মনে হয় আগুন লেগেছে। পলাশ ফুল ছোট ২ থেকে ৪ সেঃ মিঃ লম্বা হয়। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও পশ্চিম ইন্দোনেশিয়ার একটি প্রজাতি। তিনি বলেন পলাশ, কাঞ্চন, শিমুল বসন্তের প্রতীক। ভালবাসার প্রতীক, বসন্তের পাখিদের আকর্ষণীয় করে তোলে, মানুষকে প্রশান্তি দেয়। এটা রঙের এক বিচিত্র আল্পনা। এ রকম বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি বাংলার বাইরে আর কোথাও পাওয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন পলাশ গাছ এবং ফুলের বিভিন্ন ঔষধি গুণ রয়েছে যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী। নজরুল গীতিতে হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল, এনে দে এনে দে, নইলে রাঁধবোনা, বাঁধবোনা চুল। রক্তলাল আগুনের শিখার মতো জ্বলজ্বল করছে পলাশ ফুলগুলো। ডালে বসে আছে শালিক পাখি। হঠাৎ কানে এলো কোকিলের ডাক। আগুন লেগেছে বনে বনে। কথাগুলো কানে এলে তক্ষুণি পাগল হয়ে উঠে মন পলাশকে দেখার জন্য । আর সেজন্যই বোধকরি ফুলপ্রেমীরা বাংলার পলাশকে ডেকেছেন অরণ্যে অগ্নিশিখা। পলাশ শুধু একালে নয় সুপ্রাচীনকালেও ছিল সমান আদরণীয়। মহাভারতের সভাপূর্বে ইন্দ্রপ্রস্থ নগরের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে, সেখানে উদ্যান আর কৃত্রিম জলাধারের পাশেও ছিল পলাশ বৃক্ষের মাতামাতি। এমনকি ২ হাজারের বেশি বছর আগে লেখা কালীদাসের সংস্কৃত নাটক শকুন্তলায় বর্ণিত প্রমোদ উদ্যানে পলাশের উপস্থিতি। বাংলাদেশে এক ঋতু চলে না যেতেই রূপের ডালি নিয়ে হাজির হয় আরেক ঋতু।
×