ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিরল কীর্তিতে আরও ওপরে তামিম

প্রকাশিত: ০৯:৫৬, ১১ মার্চ ২০১৯

 বিরল কীর্তিতে আরও ওপরে তামিম

মোঃ মামুন রশীদ ॥ ওয়ানডে সিরিজে ব্যর্থতা কাটাতেই হয়তো আদাজল খেয়ে নেমেছিলেন বাঁহাতি ওপেনার তামিম ইকবাল। নিউজিল্যান্ড পেসারদের কাছে বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা যেভাবে নাজেহাল হচ্ছিলেন সেখানে বাদ ছিলেন না তামিমও। কিন্তু কিউই পেসারদের ওপর হিংস্র হয়ে উঠেছেন টেস্ট সিরিজ শুরুর পর থেকেই। আগ্রাসী মনোভাবের ব্যাটিংয়ে তিনি টানা তৃতীয় ইনিংসেও ঝড়োগতির অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন। হ্যামিল্টনে প্রথম ইনিংসে ১২৮ বলে ১২৬, দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৬ বলে ৭৪ করার পর এবার ওয়েলিংটন টেস্টের প্রথম ইনিংসে তিনি করেছেন ১১৪ বলে ৭৪ রান। বিদেশের মাটিতে টানা তিন অর্ধশতক হাঁকানোর দ্বিতীয় ঘটনা এটি তার। আর কোন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান যা দ্বিতীয়বার করতে পারেননি। এই তিন ইনিংসে তাকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন তরুণ ওপেনার সাদমান ইসলাম অনিক। টানা ৩ ইনিংসে উদ্বোধনী জুটিতে এসেছে ৫৭, ৮৮ ও ৭৫ রানের জুটি। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট ইতিহাসে ১৯ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার পর যা কোন সফরকারী দল সবেমাত্র ঘটাল দ্বিতীয়বার। টানা ৩ ফিফটিতে বিদেশের মাটিতে এখন বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক ১২ অর্ধশতক ও সর্বাধিক ১৮৪৭ রানের রেকর্ডও গড়েছেন তামিম। পেছনে ফেলেছেন যথাক্রমে ১২ ফিফটি করা হাবিবুল বাশার ও ১৭৭৪ রান করা মুশফিকুর রহীমকে। ২০১০ সালে অন্য এক তামিমের আবির্ভাব দেখেছিল বিশ্ব ক্রিকেটে। সেবার ইংল্যান্ড সফরে টানা তিনটি অর্ধশতাধিক রানের ইনিংস খেলেছিলেন যার মধ্যে টানা দুটিকে সেঞ্চুরিতে পরিণত করেছিলেন তিনি। সবমিলিয়ে সেবার তার টানা ৫ ইনিংসে অর্ধশতাধিক রানের যে রেকর্ড হয়েছিল সেটি এখনও বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে রেকর্ড। এবারও তামিম নিউজিল্যান্ড সফরে সেভাবেই শুরু করেছেন। হ্যামিল্টন টেস্টে তিনি ব্যাটিং কৌশল পাল্টিয়ে দারুণ সফল হয়েছেন। মূলত আক্রমণাত্মক মেজাজের ব্যাটসম্যান তামিম দিনের শুরুতে ব্যাট চালাতে বেশ স্বস্তিবোধ করেন। আর কিউই পেসারদের দৌরাত্ম্য অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ার কারণে তাদের ওপর চড়াও হওয়ার ফর্মূলা নিয়ে নেমেছিলেন তিনি। আর তাই ১২৮ বলে ১২৬ রানের বিধ্বংসী একটি ইনিংস খেলেন তিনি। দ্বিতীয় ইনিংসে আবার ঝলসে উঠে ৮৬ বলে ৭৪ রান করেন। ওয়েলিংটন টেস্টে টানা দু’দিন বৃষ্টির কারণে খেলা হয়নি। যেন টগবগিয়ে ফুঁসছিলেন তামিম। শুধু ড্রেসিংরুমে বসেই থাকেননি, এই সময়ে পরিকল্পনাটা যেমন করেছেন তেমনি প্রতিপক্ষ বোলারদের বোঝার জন্য বেশ ভালভাবেই পর্যালোচনা করেছেন তা তৃতীয়দিন বল মাঠে গড়ানোর পরই টের পাওয়া গেছে। শুরু থেকেই আবার চড়াও হয়েছেন তিনি। ফলে আরেকটি দ্রুতগতির অর্ধশতক। ভেজা মাঠ, আর্দ্র আবহাওয়া আর বাড়তি বাতাসের মাঠ ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভে ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদি, নেইল ওয়াগনার ও ম্যাট হেনরিদের পেস, সুইং ঠেকাতে একেবারেই বেপরোয়া প্রকৃতি দেখিয়ে সফল হয়েছেন তামিম। ১১ বছরে দীর্ঘ টেস্ট অভিজ্ঞতাটাও হয়তো এখন তামিমের ব্যাটিংয়ে বড় প্রভাব রাখছে। তাই আরেকবার টানা তিন ইনিংসে অর্ধশতক হাঁকালেন। ২০১০ সালে ইংল্যান্ড সফরে লর্ডস টেস্টের দুই ইনিংসে ৫৫, ১০৩ করার পর ম্যানচেস্টারে প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ১০৮। বিদেশের মাটিতে টেস্টে টানা তিন ইনিংসে অর্ধশতাধিক রানের ইনিংস প্রথম খেলেছিলেন হাবিবুল বাশার ২০০৩ সালে পাকিস্তানে। সেবার আগস্টে করাচী টেস্টে ৭১, ১০৮ করার পর দ্বিতীয় টেস্টে পেশোয়ারে প্রথম ইনিংসে হাঁকিয়েছিলেন ৯৭ রানের ইনিংস। সেটার পুনরাবৃত্তি ২০১০ সালে তামিম করার পর সৌম্য সরকার ২০১৭ সালের মার্চে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে গল টেস্টে ৭১ ও ৫৩ রান করে কলম্বোয় দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৬১ রান। বিদেশের মাটিতে টানা তিন অর্ধশতাধিক রানের ইনিংসে বাংলাদেশের পক্ষে এ তিনটিই ছিল। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো সেই ঘটনার জন্ম দিয়েছেন তামিম। আর এতে তাকে দারুণভাবে সঙ্গ দিয়েছেন প্রথমবার তার ওপেনিং সঙ্গী হওয়া তরুণ বাঁহাতি সাদমান। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে তাই টানা তিন ইনিংসে ওপেনিং জুটিতে অর্ধশতাধিক রান করার বিরল কীর্তি গড়েছেন দু’জন। ১৯৯৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার কার্স্টেন ও গিবস টানা তিন অর্ধশতকের বেশি রানের জুটি গড়েছিলেন ওপেনিংয়ে (৭৬, ১২৭ ও ৭৩)। এর আগে কিংবা পরে আর কোন সফরকারী দলের ওপেনিং জুটি টানা তিনটি অর্ধশতাধিক রান করতে পারেনি। ১৯ বছর পর একই কীর্তি গড়লেন তামিম-সাদমান। বাংলাদেশের উদ্বোধনী জুটিতে টানা তিন ইনিংসে অর্ধশত জুটি এসেছে এবারের আগে আর দুইবার। অবধারিতভাবেই যেন সেই দুইবারও জুটিতে ছিলেন তামিম। বিস্ময়করভাবে ওই দুইবারও ছিল দেশের বাইরে। প্রথমবার ২০১০ সালের ইংল্যান্ড সফরে। তামিম ও ইমরুল কায়েসের জুটিতে লর্ডসে এসেছিল ৮৮ ও ১৮৫ রান। ওল্ডট্র্যাফোর্ড টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১২৬। ২০১৭ সালে এই কীর্তিতে তামিরের সঙ্গী ছিলেন সৌম্য। গল টেস্টে দুই ইনিংসে বাংলাদেশ পায় ১১৮ ও ৬৭ রানের জুটি। পরের টেস্টে পি সারা ওভালে প্রথম ইনিংসে ৯৫। অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে সর্বাধিক রান, সেঞ্চুরি ও হাফ সেঞ্চুরির মালিক তামিম। শুধু দেশের মাটিতে রান করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্য সবাইকে পেছনে ফেলেছেন বেশ আগেই। দেশের মাটিতে তিনি ৩৪ টেস্টে করেছেন ২৪৭৬ রান। আর বিদেশের মাটিতে তারচেয়ে এগিয়ে ছিলেন মুশফিকুর রহীম ২৭ টেস্টে ১৭৭৪ রান করে। তবে নিউজিল্যান্ডে ইনজুরির কারণে দুই টেস্টেই অনুপস্থিত মুশফিক। সিরিজের আগে বিদেশের মাটিতে ২২ টেস্টে তামিমের রান ছিল ১৫৭৩। আগের টেস্টে সেটিকে তিনি ১৭৭৩ রানে উন্নীত করেছিলেন। এবার মাত্র ২ রান করেই মুশফিককে পেছনে ফেলেন তামিম। এখন ২৪ টেস্টে ৪৬ ইনিংস ব্যাট করে তামিমের বিদেশের মাটিতে রান ১৮৪৭। হাঁকিয়েছেন ৪ সেঞ্চুরি, ১২ হাফ সেঞ্চুরি। আগের ম্যাচে বিদেশের মাটিতে সর্বাধিক ১১ অর্ধশতক হাঁকানো হাবিবুলকে ছুঁয়েছিলেন। এবার ওয়েলিংটনের অর্ধশতকে তাকেও পেছনে ফেলেছেন তামিম। বিদেশের মাটিতে এখন সর্বাধিক রান ও অর্ধশতকের মালিক এ বাঁহাতি ওপেনার। সাধারণত দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া- এই চারটি দেশে অধিকাংশ সফরকারী দলের ব্যাটসম্যানরা বেশ সমস্যায় পড়েন। সেখানে এই চারটি দেশে এখন ব্যাটিং গড়টাও অসাধারণ হয়ে গেছে তামিমের। এখন তার এই চার দেশে টেস্টে ব্যাটিং গড় ৪৫.৫৯। ক্রমেই যেন অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে যাচ্ছেন ২৯ বছর বয়সী এ বাঁহাতি ওপেনার।
×