ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিরা গণহত্যা শুরু করে ১ মার্চ থেকেই ॥ মুনতাসীর মামুন

প্রকাশিত: ১০:০০, ১০ মার্চ ২০১৯

 পাকিরা গণহত্যা শুরু করে ১  মার্চ থেকেই ॥ মুনতাসীর মামুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য গণহত্যা উল্লেখ করে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেছেন, ১ মার্চ থেকেই পাকিস্তানীরা গণহত্যা শুরু করে দিয়েছিল। একাত্তরে ৩০ লাখ নয়, তারও অনেক বেশি মানুষ হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষিতের সংখ্যা ২ লাখ বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাটি হবে ৫ লাখের বেশি। শনিবার এশিয়াটিক সোসাইটি আয়োজিত একক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। ‘গণহত্যার রাজনীতি’ বিষয়ে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা বক্তৃতা করেন তিনি। লিখিত বক্তৃতা সামনে রাখলেও পুরো বিষয়টি আরও সহজ করে তুলে ধরার চেষ্টা করেন তিনি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ড. এ আর মল্লিক ও আরএন মল্লিক মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ফান্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ আবদুল্লাহ জামাল ও সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম। ভূমিকা পর্বে মুনতাসীর মামুন বলেন, চার দশক ধরে ইতিহাসের চর্চা করছি, স্বীকার করতে লজ্জা নেই, খুবই কম জানি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে খ- খ- চিত্র আমাদের মনে। সামগ্রিক কোন চিত্র আমরা পাইনি। এবং আমাদের রাজনীতিতে সেটা অবিঘাত হেনেছে। সেভাবেই বিষয়টিকে দেখানোর চেষ্টা করেছি। তিনি বলেন, প্রত্যেক গণহত্যার একটি রাজনীতি আছে। আমি একে অপরাজনীতি বলি। বাংলাদেশেও অপরাজনীতি হয়েছে। এখনও হচ্ছে। ১৯৭৫ পরবর্তী এ দেশের সামরিক শাসকরা গণহত্যার বিষয়টি ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। তারা গণহত্যার চেয়ে বিজয়ের বিষয়টি বেশি সামনে এনেছে। এর সুবিধা হলো আলবদর, আলশামসদের রাজনীতিতে নিয়ে আসা। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিটাকে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যখন আমরা গণহত্যাকে উপেক্ষা করি তখন আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করি। মুনতাসীর মামুন বলেন, মার্চ আমাদের যৌবন। তাই আজ জীবনের অপরাহ্ণে, মার্চ এলেই স্মৃতিরা হানা দেয়। বাংলাদেশের অনেক মাইলফলক ঘটনা ঘটেছে মার্চে। আমাদের প্রজন্মের যৌবনকালে সবচেয়ে বড় ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ, যার সূচনা সেই মার্চে। পাকিস্তানীরা পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালিয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, নিয়াজীর টাইপ করা একটি দলিল আমরা পেয়েছি। পাকিস্তানী জেনারেল সেখানে লিখেছেন, ‘দেয়ার মাস্ট বি মোর কিলিং, মোর মোপিং আপ এ্যান্ড মোর হুইচ হান্টিং।’ এবং একটি জায়গায় সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ৭৫ ভাগ বাঙালী সিভিল অফিসার, ডাক্তার, প্রফেসরকে শেষ করে দিতে হবে। এবং কারফিউয়ের মধ্যেই শেষ করতে হবে। বুদ্ধিজীবী হত্যাও এই পরিকল্পনার মধ্যে ছিল। এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, একাত্তরের গণহত্যা কোন আকস্মিক ব্যাপার ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ বলা হলেও মুনতাসীর মামুনের গবেষণা থেকে জানা যায়- সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি ছিল। একইভাবে ধর্ষিতের সংখ্যা ২ লাখ বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা তারও বেশি বলে মত দেন তিনি। প্রমাণ হিসেবে বলেন, ১৯৭১ সালে বিদেশী গণমাধ্যমের তরফে আমরা জেনেছিলাম, সে সময় ৬ থেকে ৭ লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছে। ধর্ষিতদের চিকিৎসার দায়িত্ব পালন করা ডাঃ ডেভিসও সে সংখ্যা ৪ লাখের মতো বলে উল্লেখ করেছেন। আমার গবেষণায় তা ৫ লাখের ওপর। হাইকোর্টের এক রায়েও তা উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। নাতিদীর্ঘ বক্তৃতায় নারী ধর্ষণের কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রত্যেকটি যুদ্ধে নারী ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবচেয়ে বেশি। মুক্তিযুদ্ধও এর ব্যতিক্রম নয়। নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই বাঙালী মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে আটকে রেখেছে। সৈন্যদের বাঙ্কারগুলোতে এসব মেয়েকে সারাক্ষণই নগ্ন অবস্থায় রাখা হতো। মুনতাসীর মামুন বলেন, ১৯৭২ সালে আমরা সেকুল্যার রাষ্ট্র পেলাম। সেখানে অন্যতম প্রধান চাওয়া ছিল, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ ও স্বাধীনতা বিরোধীদের পরিত্যাগ করা। কিন্তু ১৯৭৫ পরবর্তী নষ্ট রাজনীতি সেগুলোকে ফিরিয়ে আনে। ইতিহাসটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান ১৯৪৭ সাল ফিরিয়ে এনেছিলেন। অস্ত্র ও অর্থের সাহায্যে এই ন্যারেটিভ চাপিয়ে দিলেন। বলা হলো, ধর্ম প্রধান, রাষ্ট্র হবে ধর্মীয়। এই রাষ্ট্র হবে মুসলমানদের, রাজাকার আর আলবদররা কেন পরিত্যাজ্য হবে? পৃথিবীতে বাংলাদেশই বোধহয় একমাত্র দেশ যেখানে পরাজিতদের ক্ষমতায় আনা হয়েছিল। রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের এমপি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি বানানো হয়েছিল। যারা গণহত্যাকে সমর্থন করে তাদের পরিত্যাগ করার আহ্বান জানান তিনি।
×