ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিমানবন্দরে ঘোষণা ছাড়া অস্ত্র নিয়ে ঢুকলেই গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৯:৫৩, ১০ মার্চ ২০১৯

 বিমানবন্দরে ঘোষণা ছাড়া অস্ত্র নিয়ে ঢুকলেই গ্রেফতার

আজাদ সুলায়মান ॥ ঘোষণা ছাড়া বিমানবন্দরে অস্ত্র নিয়ে ঢুকলেই গ্রেফতার করা হবে সেই যাত্রীকে। তিনি যত বড় সেলিব্রেটি আর ক্ষমতাবানই হন, পার পাবেন না কোন অজুহাতে। অস্ত্র নিয়ে পর পর দুটো অপ্রীতিকর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিভিল এভিয়েশন। একই সঙ্গে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়াও দেশের সব বিমানবন্দরে নেয়া হয়েছে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যাত্রীর কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ বহনে আইকাও গাইড অনুসরণের বিন্দুুমাত্র ত্রুটি পাওয়া গেলে কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মীদের বিরুদ্ধেও নেয়া হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। শনিবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কনফারেন্সে মন্ত্রণালয় ও বেবিচকের উচ্চ পর্যায়ের কর্তাদের দীর্ঘ বৈঠকে এ ধরনের কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ বিষয়ে সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল নাইম হাসান জনকণ্ঠকে বলেছেন, কাউকে আর মিথ্যাচার করারও সুযোগ দেয়া হবে না। দেশের স্বার্থে আমাদের আরও কঠোর হতে হচ্ছে। জানা গেছে, বেলা দশটায় শাহজালালের কনফারেন্স রুমে বেবিচক মন্ত্রণালয়ের সচিব মুহিবুল হক, চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল নাইম হাসান, মেম্বার (অপস) মোস্তাফিজুর রহমান, মেম্বার সিকিউরিটির শাহ মোঃ ইমদাদুল হক, পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ আল ফারুক ও এভসেক পরিচালক উইং কমান্ডার নূরে আলম সিদ্দিকসহ উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জরুরী বৈঠকে বসেন। প্রায় চার ঘণ্টার এই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে শাহজালালসহ দেশের সব বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৈঠকে অংশ নেয়া এক কর্তা জনকণ্ঠকে জানান, নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রতিটি ইস্যু নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। কিভাবে নিরাপত্তা ফাঁকি দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তথাকথিত সেলিব্রেটি ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গের দেহ ও লাগেজ তল্লাশির সময় বিরক্তবোধ করলে তাদেরকে হ্যান্ডল করার কৌশল, হ্যান্ডব্যাগে খেলনা পিস্তল পাওয়া গেলেও সেটা রেখে দেয়া, জনবল বাড়ানো, প্রয়োজনে যেখানে লোকবলের ঘাটতি আছে সেখানে জরুরীভিত্তিতে পূরণ করা ছাড়াও অন্যান্য ইস্যু নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। এ সময় বেবিচক থেকে জানানো হয়, এখনও নিরাপত্তার প্রতিটি পয়েন্টে জনবলের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এসব শোনার পর সচিব মুহিবুল হক নূতন অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী দ্রুত প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ স¤পন্ন করার নির্দেশ দেন। তিনি স্ক্যানার মেশিন ঠিকমতো কাজ করে কিনা এজন্য প্রতিদিন নিয়মিত ক্যালিব্রেশন করে নিশ্চিত হওয়ার পরামর্শ দেন। বৈঠকে ইলিয়াস কাঞ্চনের মতো দায়িত্ববান ও সেলিব্রেটি কিভাবে অস্ত্র ঘোষণা দিতে ভুলে যান, সেটা নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করা হয়। এ সময় সবাই মতামত দেন, যিনি সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র থাকার কথা ভুলে যান,তার কাছে তো অস্ত্র থাকাও নিরাপদ নয়। ওই ধরনের আত্মভোলা মানুষের তো ওই অস্ত্র নিয়ে আরও বড় ধরনের বিপদের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ইলিয়াসের পর শুক্রবার মানবাধিকার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান পরিচয় দানকারী খন্দকার মামুন আলীর শরীর তল্লাশি করে যখন অস্ত্র ধরেছে নিরাপত্তাকর্মীরা তখন তিনি সরি বলে ক্ষমা চান। মুচলেকা দিয়ে পার পান। এক্ষেত্রে তাদের একটু সম্মান দেখানোটা সমীচীন হয়েছে নাকি সঙ্গে সঙ্গে এরেস্ট করা উচিত ছিল, এমন প্রশ্নও রাখেন এক কর্তা। তখন উপস্থিত সবাই একব্যাক্যে মন্তব্য করেন, ইলিয়াস কাঞ্চনকে তাৎক্ষণিক গ্রেফতার করে লাইসেন্স বাতিল করা হলে পরদিন আর মামুন আকতার এমন সাহস পেত না। কাজেই আর ভদ্রতা ও নমনীয়তা নয়, কঠোর হতে হবে শতভাগ। যা হয় হোক, যত সেলিব্রেটিই বা ক্ষমতাবান হোক ছাড় দেয়া হবে না কাউকে। বৈঠক চলা অবস্থায় এক প্রভাবশালী কর্মকর্তাকে ফোন করে এক সেনা কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, তিনি অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে লম্বা লাইনে আটকা পড়েছেন। একই সময় আরও দুই প্রভাবশালী সচিব ফোন করে খেদোক্তি করেন; তাকে কেন লাইনে দাঁড়িয়ে সাধারণ যাত্রীর মতো জুতো-মোজা খুলতে হবে। এসব অভিযোগ শুনে এক বেবিচক কর্তা বলেন-বেশ বিনীতভাবে জানান, নিরাপত্তার স্বার্থেই কিছু নিয়ম সবাইকে মানতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে করার কিছুই নেই। আর ছাড় দেবে না সিভিল এভিয়েশন। বেবিচক সূত্র জানিয়েছে- সামরিক, বেসামরিক বিভিন্ন বাহিনীর চৌকস সদস্যদের নিয়ে গঠিত এভসেকে কত জনবল ঘাটতি আছে তা দু/এক দিনের মধ্যেই পূরণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত এভসেক নিরাপত্তাকর্মীদের প্রয়োজনে আরও প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে দিয়ে ডিউটি করানোর পরামর্শ দেয়া হয়। তখন এভসেক সদস্যরা বলেন, কোন ধরনের বিশেষ ভাতাদি ছাড়াই সর্বক্ষণিক অমানুষিক পরিশ্রম করেন। অথচ তাদের জন্য শাহজালালে স্বল্পমূল্যে লাঞ্চ করা বা চা-বিস্কুট পর্যন্ত খাওয়ার সুযোগ নেই। এতে অবিলম্বে তাদের জন্য স্টাফ ক্যান্টিন চালু করার মতামত দেয়া হয়। এদিকে শনিবার আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে প্রতিটি যাত্রীর দেহ তল্লাশি ও লাগেজ-ব্যাগেজ স্ক্যানিং করার ক্ষেত্রে খুবই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। সকাল সাতটায় অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের সামনে গিয়ে দেখা যায় গেট থেকে লম্বা লাইন বাইরে গিয়ে ঠেকেছে। যাত্রীদের পায়ের গোড়ালি থেকে গলা পর্যন্ত দেহ তল্লাশি করতে দেখা যায়। অনেক যাত্রীর ফ্লাইট মিস করার অজুহাতে তাড়াতাড়ি তল্লাশি করার অনুরোধ জানালেও তা আমলে নেয়া হয়নি। শতভাগ নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলতে যা বোঝায়, এদিন যাত্রীরা তাই প্রত্যক্ষ করেছে। তল্লাশির এক পর্যায়ে বেলা দশটার সময় এক যাত্রীর লাগেজে পাওয়া যায় একটি পিস্তল। নিরাপত্তাকর্মীরা তখন জানতে চায়, কেন এটা ঘোষণা দেয়া হয়নি। ওই যাত্রী তখন কিছুটা রসিকতাসুরেই বলে ওঠেন- আসল পিস্তলে ঘোষণা লাগে, নকলে লাগে না। এতে নিরাপত্তাকর্মী কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। অবশ্য খেলনা পিস্তল হলেও সেটা নিয়ে যেতে দেয়া হবে না বলে জানানো হয়। বাধ্য হয়েই পিস্তলটি রেখে যেতে হয়েছে যাত্রীকে। এ সময় প্রভাবশালী এক সংসদ সদস্যের ছেলে দুটো শটগান ও একটি পিস্তল নিয়ে বিমানবন্দরে হাজির হন। তিনি যথারীতি টার্মিনালের মেইন গেটে প্রবেশের আগেই চিৎকার করে ঘোষণা দেন, আমার কাছে অস্ত্র আছে। তল্লাশির আগেই আপনারা নিয়ে নিন। তার চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন বেশ কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। ওই যাত্রী নিরাপত্তা কর্মীর কাছে অস্ত্রগুলো রেখে সরাসরি চলে যান ভিআইপি লাউঞ্জে। সেখানে বসে তিনি তার কাছে ফরম নিয়ে যেতে আদেশ করলে তাকে বলা হয় ‘এখন খুব কড়াকড়ি চলছে। আপনাকে কাউন্টারে গিয়ে ফরম পূরণ করে দিতে হবে। এর পর তিনি বাধ্য হন কাউন্টারে গিয়ে ফরম পূরণে।’ এদিকে সচিব এম মহিবুল হক বলেছেন, যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করুন। যারা দেশের ভাবমূর্তির চিন্তা না করে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করবেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×