ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘কেন আমি ৭৫ বছরে মরতে চাই’

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ১০ মার্চ ২০১৯

‘কেন আমি ৭৫ বছরে  মরতে চাই’

কথাটা আমার নয়। সবাই বলে, বাঁচতে চাই অথচ এই ভদ্রলোক ৭৫ বছর বয়সেই যেন মরে, সেই ইচ্ছেই পোষণ করেছেন। ভদ্রলোক হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল থেকে এমডি করেছেন। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড থেকে বায়োকেমিস্ট্রিতে এমএস করেছেন। বর্তমানে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল হেল্থ এবং ইথিক্স বিভাগের প্রধান। এই অধ্যাপকের নাম ইজিকিয়েল ইমানুয়েল। বুঝতেই পারছেন, ভদ্রলোক যেনতেন লোক নন। আমার এক বন্ধু কলিগের কাছ থেকে লেখাটি পেয়েই ১৫ পৃষ্ঠাব্যাপী লেখাটি পড়ে ফেললাম। বন্ধুটি জানে জীবন-মৃত্যু নিয়ে লেখা আমার পছন্দ। সেই জন্যই পূর্ব-পশ্চিমে অনেক আগে লিখেছিলাম ‘আ হা রে জীবন- পরিসংখ্যান সম্ভাবনামাত্র’। এবং ড. ইমানুয়েলের লেখাটি আমার দারুণ ভাল লেগেছে। একই চিন্তাধারার মানুষ হলে যা হয়। আমি সপ্তাহে অন্তত একদিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাফেটেরিয়াতে কলিগদের সঙ্গে লাঞ্চে যাই। অনেকেই এসে আমাকে অভিনন্দন জানায় লোকাল পত্রিকা ‘দি ডিসপাস’-এ আমার লেখা পড়ে ওদের ভাললাগাটা জানাতে। কেননা একই চিন্তাধারার মানুষ প্রশংসাই করতে চায়। সম্প্রতি, আমার একটি লেখার টাইটেল ছিল, ‘In fact, there were leaders in the world with the characteristics of a prophet.’ বুঝতেই পারছেন, পাঠকবৃন্দ, কোথায় হাত দিয়েছি! সম্পাদকের সঙ্গে বেশ কয়েকবার ইমেইল চালাচালি করে শেষ পর্যন্ত লেখাটি ছাপা হলো। যা হোক, এক ভদ্রলোক সুদূর পোর্টল্যান্ড, মেইন স্টেট থেকে সঙ্গে সঙ্গে ইমেইল করে ধন্যবাদ জানাল। টেকনোলজির বদৌলতে ভদ্রলোক মিসিসিপির পত্রিকার লেখাটি পড়েছেন। আবার আর এক ভদ্রলোক অনলাইনে অধার্মিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সে যাই হোক, যা বলছিলাম, ড. ইমানুয়েল একটি গ্রাফ (গ্রাফটি দেখুন) দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, পরিবার, কমিউনিটি, সোসাইটি, দেশ বা বিশ্বজুড়ে যা কিছু কনট্রিবিউট করার, তার জন্য ৭৫ বছরই যথেষ্ট। বাকি জীবনটা তেমন কোন কাজে আসে না। বরং নিজের কষ্ট এবং অন্য অনেকের কষ্ট বাড়িয়ে দেয়া হয়। গ্রাফ বয়স অনুযায়ী উৎপাদনশীলতা অর্থাৎ আমাদের জীবদ্দশায়, কর্মক্ষমতা ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্র ৩টি বিশেষ সময়ে আসে। এক. প্রথম যৌবনে (২৫ বছর)। যেমন সঙ্গীত বিশারদ এ আর রহমানের কথাই ধরুন। অন্য আরও অনেক সৃজনশীল লোকজন যৌবনের প্রারম্ভেই বাজিমাত করে। দুই. মধ্য যৌবনে (৪০ বছর)। বেশির ভাগ নোবেল লরিয়েটদের কাজ মধ্য যৌবনই সূচনা হয়ে থাকে। নোবেল প্রাইজটা পায় অনেক পরে। এবং তিন. ষাটোর্ধ বয়সে (৬০ বছর)। কেনটাকি ফ্রাইড চিকেন কার না ভাললাগে? কর্নেল স্যান্ডারস্ বৃদ্ধ বয়সেই তা ব্যাপকভাবে চালু করেন। তাছাড়া অনেকেই আগে শুরু করলেও ষাটের দিকে আরও ক্রিয়েটিভিটি দেখিয়েছেন। পিকাশো, ফিলিপ রথ, কিংবা আলেক্সজান্ডার ফ্লেমিং। কিন্তু পঁচাত্তরোর্ধ্ব বয়সে কেউ কি কিছু নিজের স্বকিয়তায় কোন কিছু সমাজকে দিতে পেরেছে? সুতরাং কেনই বা বাঁচব? বরং পরিবার তথা সমাজের রোঝা হয়ে বেঁচে থাকা হবে তখন। পাঠকবৃন্দ, পুরো লেখাটা পড়তে হলে গুগুলে সার্চ করুন, ‘Why I hope to die at ৭৫.’ বিশ্বে এখনও জাপানের গড় আয়ু ৮৬.৮ তারপর সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং আরও অনেক নিচে যুক্তরাষ্ট্রের গড় আয়ু। পুরুষের ৭৯ আর মহিলাদের আরও কয়েক বছর বেশি। তবে বৃদ্ধ বয়সটায় এই যুক্তরাষ্ট্রে বেশির ভাগ লোকজন ওষুধের উপর নির্ভরশীল। গুগুল থেকে জানলাম, বর্তমানে বাংলাদেশের গড় আয়ু ৭২ বছর। বাংলাদেশের উন্নয়ন যেমন ঘটেছে এবং ঘটছে, তেমনি গড় আয়ুও বেড়েছে বৈকি! আমি বুঝি না, বাংলাদেশ যখন দেশ হিসেবে এখন খুবই সফল, তখন কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী সরকারের প্রশংসার পরিবর্তে খালি খালি খুৎ বের করে? খুৎ তো থাকবেই। কোন সরকার আসলে এর চেয়ে ভাল হতো? পেট্রোলবোমা দিয়ে যারা মানুষ মারে, বিরোধীদের সভা-সমাবেশে যারা বোমা মেরে ম্যাসাকার করে, যারা ক্ষমতায় থাকতে দুর্নীতি করার পর সই-স্বাক্ষর রেখে যায়, যাতে বিচার বিভাগ অনায়াসে প্রমাণ পেয়ে যায়, তারা উন্নয়ন করবে? অরুন্ধতী রায়, শহীদুল আলমের আমিও ভক্ত। কিন্তু কুচক্রী মহলের চক্রান্তে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে মেরে ফেলতে গিয়ে কানটাই স্তব্ধ করে দিয়েছে, কাজেই আপনাদের কথাগুলো শুনবেই বা কি করে? গণতন্ত্র মানেই তো অধিকাংশ লোকের ভোট নিয়ে কাজ করা। বর্তমান সরকার কি তা করছে না? পাকিস্তানের আমরা ভক্ত নই। কিন্তু একজন ইমরান খান হতে দোষ নেই। একজন কেজরিওয়াল হলে দোষ কোথায়? ক্ষমতার সিঁড়ি বাইতে হলে ত্যাগ তিতিক্ষার দরকার আছে। অপেক্ষারও দরকার আছে। ৭৫ বছর বয়স নিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম। সুতরাং পাঠকবৃন্দ, ভেবে দেখুন ৭৫-এর কাছাকাছি লোকজন কি দেশ ও জাতির জন্য ততটা কনট্রিবিউটিং হবে? শেখ হাসিনা সঠিক কথাটিই বলেছেন, এই টার্মই শেষ। হয়ত সেই কারণেই নতুন মন্ত্রিসভায় পুরনোদের বাদ দিয়ে নতুনদের সংযোজন করেছেন। ড. ইমানুয়েল কিন্তু খাঁটি কথাটিই বলেছেন। তবে বাংলাদেশে এই বিষয়টা নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে, তাহলো ড. ইমানুয়েলের কথামতো ৬০ বছরেও যখন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা যায় তখন সেই বয়সটায় রিটায়ারমেন্ট করিয়ে দেয়ার কোন মানেই হয় না। অন্ততপক্ষে রিটায়ারমেন্ট বয়স ৬৫ বছর করা উচিত। গত ৭ বছর আগে বাংলাদেশে গিয়ে দেখি আমার সব বন্ধুরা রিটায়ার্ড। আর আমি এখনও দিব্যি কাজ করে যাচ্ছি। সুতরাং, বাংলাদেশে অবসরে যাওয়ার সময়টা বৃদ্ধি করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি। আমাদের ২০০৬ সালের মডেলের একটি টয়োটা মিনি ভ্যান আছে। এখনও বেশ চলমান গাড়ি। এবং মাইলেজ হয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার মাইল। কিন্তু প্রায়ই এই শব্দ কিংবা কাঁপুনি, অথবা দরজার গ্লাসটা হঠাৎ ভেতরে ঢুকে গেল, আর উঠানো যাচ্ছে না। মানুষের মতো গাড়ির ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। আবার চলতে থাকে। আমি প্রায়ই ভাবি বয়সের ভারে গাড়িতেও ঝং ধরে। কলকব্জা বিকল হতে শুরু করে। তবে হার্টসম ইঞ্জিনটি এখনও টেকসই আছে, নিয়মমাফিক তেল পরিবর্তন করি, কুলেন্ট ঢালি, ধোয়া-মোছা করি, টায়ার পরিবর্তন করি, এমনিভাবে এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। অবাক হলেও সত্যি, গাড়িটা চালাতে গিয়ে আমার নিজের বয়সটার কথাও মনে পড়ে। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস আসে। [email protected]
×