ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপদ নিরাপত্তা

প্রকাশিত: ০৯:০৪, ৮ মার্চ ২০১৯

নিরাপদ নিরাপত্তা

নাছোড়বান্দা ওরা। ওদের কাছে জীবনের চেয়ে বাণিজ্য ও মুনাফাই বড়। চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ওদের বিবেকবোধ, চেতনাকে নাড়া দেয়নি। আগুন এসে গোগ্রাসে গিলে ফেলার কোন ঘটনাই ওদের মনে তোলে না আলোড়ন। ওরা তাই অনমনীয়; এমনকি একগুঁয়ে হয়ে পড়েছে। কোনভাবেই বিপজ্জনক রাসায়নিকসহ অন্যান্য দ্রব্য সরিয়ে নেবে না। নিরাপত্তাহীনতাকে ‘থোড়াই কেয়ার’ করার প্রবণতা ওদের তীব্র। আগুনে পোড়া লাশের মিছিল দেশের ১৬ কোটির বেশি মানুষের হৃদয়কে ব্যথাতুর করলেও মনে হয় ওদের ‘পাষাণ’ হৃদয়ে ঘা দিতে পারেনি। ওরা গোঁ ধরে বসে আছে। এসব সরাবে না। পুড়ুক গুদাম, পুড়ুক মানুষ, ছাইয়ে পরিণত হোক সবকিছু, তবুও তারা এক ইঞ্চিও নড়বে না। সরাবে না বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থ। এই আচরণ ভয়াবহ বলা যায় এক বাক্যে। আইন লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর পুরান ঢাকায় অবাধে অবৈধ রাসায়নিকের ব্যবসা চলছে। অবৈধভাবে রাসায়নিক ব্যবহার, সংরক্ষণ, বিপণন ও সরবরাহ সবই চলছে চোখের সামনে। রাসায়নিক আমদানি করার লাইসেন্স প্রাপ্তি ও বিপজ্জনক রাসায়নিকসহ নানা দাহ্য পদার্থের ব্যবহার, বিপণন ও সরবরাহের বিধান থাকলেও তা তোয়াক্কা না করেই পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি পরিবেশে অবৈধভাবে একচেটিয়া ব্যবসা করছে। আইন ও শাস্তির বিধান যতটুকুই আছে তা আছে কাগজে-কলমে। বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই বললেই চলে। ফলে পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যে যেভাবে পারছে অবাধে বিপজ্জনক রাসায়নিকের ব্যবসা করছে। রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি, সংরক্ষণ ও ব্যবহার আইন অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি বিধি লঙ্ঘন করে রাসায়নিক আমদানি, পরিবহন, মজুদ, বিতরণ, উৎপাদন, শোধন, মিশ্রণ বা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহার কিংবা বিতরণের স্থান বা পরিবহনরত যানের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত ব্যক্তি লাইসেন্সের কোন শর্ত লঙ্ঘন করলে, এসব কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি যদি ধারা ১৩-এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তাকে ওই স্থানে বা ক্ষেত্রমতে যানে কোন রাসায়নিক পরিদর্শনের সময় বা ওই পরিদর্শনে যুক্তিসঙ্গত সহযোগিতা প্রদানে অস্বীকার বা অবহেলা করেন, অথবা রাসায়নিকের নমুনা সংগ্রহ করতে অসহযোগিতা করেন এবং ধারা ২৪-এর অধীন কোন দুর্ঘটনার সংবাদ প্রদানে ব্যর্থ হন, তাহলে ওই ব্যক্তি অনধিক ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক দশ হাজার টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। পাশাপাশি বিস্ফোরক দ্রব্য যেমন পটাশিয়াম, সালফার, গানপাউডার জাতীয় কোন পদার্থ বেআইনীভাবে ব্যবহার করলে তার জন্য ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ অন্যান্য ধারাতে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে আট শতাধিক রাসায়নিকের মধ্যে ২০-২৫টি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন রাসায়নিকের ক্ষেত্রে শুধু এসব আইন কার্যকর রয়েছে। অথচ চকবাজার অগ্নিকা-ে পারফিউমসহ বিভিন্ন প্রসাধনীর ‘ক্যান’ বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ছড়িয়েছে। স্মরণ করা যায়, ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকা-ের পর আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করেন। কেরানীগঞ্জে রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। বলা হয়েছিল, সেখানে না গেলে ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স নবায়ন করা হবে না। নির্দেশনা মেনে দুই শ’ ব্যবসায়ী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় গুদাম স্থানান্তর করেন। তবে গুদামগুলো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় না গড়ে বিভিন্ন খোলা ও নিরাপদ স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে স্থাপন করা হয়। পরে সেসব স্থানে গুদামের আশপাশে বসতবাড়ি, দোকান, বাজার গড়ে ওঠে। ফলে ব্যবসায়ীরা কেরানীগঞ্জে গিয়েও নিরাপদে নেই। অবশ্য দেশে সম্পূর্ণ নিরাপদ আবাসন ও রাসায়নিক অবকাঠামো নীতিমালা নেই। বোমার সঙ্গে পুরান ঢাকার মানুষ আর কতকাল বাসবাস করবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের সদিচ্ছা থাকলেও পুরান ঢাকার রাসায়নিক কারবার সরানো সহজ নয় সে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বারবার। রাসায়নিক গুদাম ও কারখানাগুলোতে পানি, বিদ্যুত এবং গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে বাধা আসছে, বিক্ষোভ হচ্ছে। ওরা নাছোড়বান্দা হয়ে গেছে বলে সরতে চায় না। আসলে ওদের বোঝানো দরকার যে, এই ভয়াবহ অবস্থার অবসান প্রয়োজন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিয়মনীতি অনুধাবনের পথ করে দেয়ার বিকল্প নেই। নিমতলী ও চকবাজারের পুনরাবৃত্তি কেউই দেখতে চায় না। সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে অবশ্যই কঠোর হতে হবে।
×