ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে বিটি বেগুন চাষে অভূতপূর্ব সাড়া ॥ চল্লিশ শতাংশ ফলন বৃদ্ধি

প্রকাশিত: ১১:৩৫, ৭ মার্চ ২০১৯

দেশে বিটি বেগুন চাষে অভূতপূর্ব সাড়া ॥ চল্লিশ শতাংশ ফলন বৃদ্ধি

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ পরিবেশবাদীদের শঙ্কা থাকলেও দেশে বায়ো প্রযুক্তির বিটি বেগুন চাষে কৃষকের মধ্যে অভূতপূর্ব সাড়া পড়েছে। এই বেগুন চাষে শুধু কীটনাশকেরই এক তৃতীয়াংশ হ্রাস পায়নি, বিটি বেগুনের ফলন বেড়েছে ৪০ শতাংশ। হেক্টর প্রতি কৃষকের নিট মুনাফা হচ্ছে ৩০ হাজার টাকা। বিটি বেগুন চাষের ওপর এক গবেষণা ফল তুলে ধরে ইন্টারন্যাশনাল ফুট পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশ প্রধান ড. আখতার আহমেদ বলেন, ‘পোকার আক্রমণ না থাকায় ক্রেতাদের কাছে এই বেগুনের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। ফলে তারা প্রচলিত বেগুনের চেয়ে বিটি বেগুনে বেশি মুনাফা করছে। সার্বিকভাবে বেগুন চাষে কৃষকের আয় ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি হেক্টরে বিটি বেগুন চাষ করে কৃষক এখন ৩০ হাজার টাকা মুনাফা করছে।’ বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই) আয়োজিত ওয়ার্কশপে বাংলাদেশে বিটি বেগুন চাষের প্রভাব তুলে ধরা হয়। এই কর্মশালা উদ্বোধন করতে গিয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়লেও কৃষকরা উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে উদ্ভাবিত বিটি বেগুন কৃষক ভোক্তা সবাই গ্রহণ করেছে। বেগুনের উৎপাদন ভাল এবং বেশ লাভজনক। কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত নতুন নতুন জাত নিয়ে বিরোধিতা করছে। তারা কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়া কথা বলছে। এসব ফসলে কোন ক্ষতিকর কিছু নেই। আমাদের কৃষকরা এসব উন্নত জাতের স্বত্ব হারাবে যে কথা বলা হচ্ছে তাও ঠিক নয়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা খাদ্য চাহিদা মিটানো ও ভবিষ্যত খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলায় নতুন নতুন উন্নত জাত উদ্ভাবন করতে হবে। নতুন জাত যেন পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর না হয় সেদিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আমরা আরও ভাল ভাল টেকনোলজি সম্পৃক্ত করব, সমালোচনা থাকবে এরই মধ্যে কাজ করে যেতে হবে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের পথে।’ পুষ্টিকর খাদ্য প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, পুষ্টিকর খাদ্য বাজার থেকে কেনার সামর্থ্য নেই, এ জন্য কৃষিজ পণ্যের বাজারজাত অপরিহার্য। অনেক ফসল চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হলে রফতানি করা যায়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘খাদ্যে ভেজাল রোধে আমাদের আরও কঠোর হওয়া উচিত ছিল। খাদ্য ভেজাল রোধে আর কোন ছাড় দেয়া হবে না। ভেজাল রোধে ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে একটি ও বিভাগীয় শহরে একটি করে ল্যাব স্থাপন করা হবে যাতে দ্রুত ভেজাল শনাক্ত করা যায়।’ কৃষিমন্ত্রী বলেন, আধুনিক জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে সরকার জিএমওসহ কৃষি রূপান্তর ও হাইব্রিড জাত নিয়ে এসেছে। কৃষির টেকসই উন্নয়নের জন্য কৃষি রূপান্তর, কৃষি বহুমুখীকরণ, বাজারজাতকরণ এবং ভ্যালু এ্যাড ও ভ্যালু চেন অপরিহার্য। বাংলাদেশের কৃষি এখন বাণিজ্যিক কৃষি। জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যের উৎপাদন জরুরী। হালনাগাদ কৃষি নীতিতে বায়োটেকনোলজি গবেষণা ও উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি কৃষিতে নারীর ক্ষমতায়নেরও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কৃষি আজ আর শুধু কৃষকের একার চিন্তার বিষয় নয়। কৃষির প্রশ্নে সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারক যেমন কাজ করছেন, তেমনি সক্রিয় অবদান রাখছে বেসরকারী খাতও। বিজ্ঞান ও গবেষণা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক চিন্তা। বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমাদের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর এজন্য কৃষি গবেষণার কোন বিকল্প নেই। কৃষিপণ্য রফতানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের দেশে অনেক ফসলের উদ্বৃত্ত উৎপাদন হচ্ছে। আমাদের চাহিদার চেয়ে ৩০ লাখ টন আলু বেশি উৎপন্ন হয়, যার মাত্র ১ লাখ টন রফতানি করা যাচ্ছে। বাকি উদ্বৃত্তাংশ উৎপাদন খরচ উঠাতে পারছে না কৃষক। মাথাপছিু আয় বৃদ্ধিতে কৃষির বিপ্লবের কোন বিকল্প নেই। আইএফপিআরআইয়ের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটিটিভ আখতার আহমেদ কৃষি নীতি বিষয়ক কর্মশালা প্রসঙ্গে বলেন, কৃষির বায়ো প্রযুক্তি সম্পর্কে সংশয় দূর করা এবং দেশের পুষ্টি অবস্থার উন্নয়নে কৃষির ভূমিকা নিয়ে দুটি গবেষণা করা হয়েছে। প্রথম গবেষণায় বায়ো প্রযুক্তির বিটি বেগুন আবাদ অবস্থা এ্যাসেসমেন্ট করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় গবেষণায় কৃষি পুষ্টি ও জেন্ডার লিংকেজ প্রকল্পের প্রভাব নির্ণয় করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বেগুন চাষে সবচেয়ে বেশি কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। বিটি বেগুনের আবাদ শুরুর পর এই কীটনাশকের ব্যবহার অনেক কমে এসেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে ফলন এবং কৃষকের মুনাফা। দেশে প্রচলিত বেগুনের এক তৃতীয়াংশই নষ্ট হয়ে যায় ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণে। ড. আখতার আহমেদ বলেন, পোকার আক্রমণ না থাকায় ক্রেতাদের কাছে এই বেগুনের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। ফলে তারা প্রচলিত বেগুনের চেয়ে বিটি বেগুনে বেশি মুনাফা করছে। সার্বিকভাবে বেগুন চাষে কৃষকের আয় ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি হেক্টরে বিটি বেগুন চাষ করে কৃষক এখন ৩০ হাজার টাকা মুনাফা করছে। প্রচলিত বেগুন চাষে ৭০ শতাংশ কৃষকই মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। কিন্তু বিটি বেগুন চাষের ক্ষেত্রে এই সমস্যা অতি নগণ্য। এর কারণ হচ্ছে প্রচলিত বেগুন চাষে যেখানে ৫০ থেকে ৬০ বার কীটনাশক স্প্রে করতে হয়, সেখানে বিটি বেগুন চাষে এই কীটনাশক স্প্রে ১৫-১৬ বারে নেমে এসেছে। তিনি বলেন, মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক স্প্রের কারণে কৃষক তার নিজের উৎপাদিত প্রচলিত বেগুন কখনও খায় না। তারা জানে তাদের উৎপাদিত প্রচলিত বেগুনে বিষ থাকে। তাই তারা এ বেগুন উৎপাদন করে শুধু বাজারে বিক্রির জন্য। জীবন রক্ষাকারী এবং খরচ সাশ্রয়ী হওয়ায় বিটি বেগুন চাষের প্রতি কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে। এ্যাঞ্জেল প্রকল্প প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে পুষ্টি গ্রহণের প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রকল্পের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো কৃষক পরিবারে নারী-পুরুষের মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাস পেয়েছে এবং কৃষকের আয় বেড়েছে। এতে পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর প্রাধান্য বাড়ছে এবং নারীরা কৃষি জমিসহ সম্পদেরও মালিক হচ্ছেন। অতিরিক্ত সচিব ড. আবদুর রৌফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষি সচিব মোঃ নাসিরুজ্জামান, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এর মহাপরিচালক ড. আবুল কালাম আজাদ। আরও উপস্থিত ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মীর নুরুল ইসলাম, ইউএসএআইডির ভারপ্রাপ্ত মিশন ডিরেক্টর জিনাহ সালাহী এবং আইএফপিআরআইয়ের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটিটিভ আখতার আহমেদ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর গবেষণা প্রতিবেদন দুটির ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আখতার আহমেদ গবেষণার সংক্ষিপ্ত ফল তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ইতিবাচক প্রভাবের কারণে সরকার সারাদেশে এই প্রকল্প সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রথম পর্যায়ে দেশের ১২০টি উপজেলায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এ প্রসঙ্গে কৃষি পলিসি সাপোর্ট ইউনিটের সাবেক ডেপুটি গবেষণা পরিচালক মাসুমা ইউনূস বলেন, সম্প্রসারিত প্রকল্পে একই পরিবারে স্বামী-স্ত্রী উভয়কে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। তবে যাদের স্বামী না স্ত্রী নেই তাদের ক্ষেত্রে অন্য নারী বা পুরুষদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
×