ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শঙ্খধ্বনি, মন্ত্রপাঠ আর খোল-করতালের শব্দ এখন শুধুই স্মৃতি...

প্রকাশিত: ১১:০৩, ৭ মার্চ ২০১৯

শঙ্খধ্বনি, মন্ত্রপাঠ আর খোল-করতালের শব্দ এখন শুধুই স্মৃতি...

বিশ্বজিৎ মনি ॥ ঐতিহ্যে ঘেরা উত্তর জনপদের ভারত সীমান্ত ঘেঁষা বরেন্দ্রভূমির নাম নওগাঁ জেলা। আবাদ উদ্বৃত্ত এলাকা বলে খ্যাত নওগাঁ জেলায় রয়েছে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার (সোমপুর বিহার)। শুধু পাহাড়পুরই নয় এ জেলায় রয়েছে ঐতিহ্যে ভরা অনেক ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা। তারই একটি অংশ বলিহার রাজবাড়ি। এই রাজবাড়িতে এখন নেই সেই রাজা আর সেই রাজার রাজ্যও। কিন্তু এখনও কথা বলে এই রাজ্যের রাজা ও জমিদারের সময়কার বটবৃক্ষ আর তৈরি করা নানা স্থাপনা। কালের সাক্ষী হয়ে রাজার শাসন আমলের স্মৃতি মাথায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী বলিহার রাজবাড়িটির ধ্বংসাবশেষ। এখনও রাজবাড়িতে আছে দেবালয়। সেখানে হয় না আর নিয়মিত পূজা অর্চনা। দেবালয়ে দেবতার সন্তুষ্টিতে দেবদাসীদের নৃত্যাঞ্জলি, শঙ্খধ্বনি, পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ, ধূপের ধোঁয়া আর খোল-করতালের শব্দ থেমে গেছে বহু আগে। রাজবাড়িটি এখনও আকৃষ্ট করে পর্যটকদের। নওগাঁ জেলা সদরের বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলেই চারদিক থেকে বাসের স্টাফদের যাত্রী ডাকার চিৎকার আর চেঁচামিচি কানে আসবে। সেখানে মান্দাগামী বাসে চেপে নামতে হবে নওগাঁ-রাজশাহী আঞ্চলিক মহাসড়কের বাবলাতলির মোড়ে। ১৫ কিলোমিটার দূরত্বের রাস্তায় ৩৫মিনিটে পৌঁছা যায়। বাস থেকে নেমেই সামনে বলিহার কলেজ ভবন। পাশ দিয়ে সরু এবড়োথেবড়ো পাকা রাস্তা চলে গেছে বলিহার রাজবাড়িতে। তা, সব মিলিয়ে আধা মাইল। হেঁটে অথবা ভ্যানগাড়িতে যাওয়া যায়। রাস্তার দু’ধারে আকাশমনি গাছের অপরূপ দৃশ্য। সামনে বিশাল দুটি দীঘি পড়তেই বোঝা যায় সামনেই রাজপ্রাসাদ। প্রাচীন বড় বড় কয়েকটি তেঁতুল আর বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে প্রাসাদে প্রবেশের আগেই। রাজবাড়ির সামনেই বলিহার বাজার। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের এক সনদবলে নওগাঁর বলিহারের এক জমিদার জায়গীর লাভ করেন। জমিদারগণের মধ্যে জমিদার রাজেন্দ্রনাথ ১৮২৩ সালে বলিহারে একটি রাজ-রাজেশ্বরী দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মন্দিরে রাজেশ্বরী দেবীর অপরূপা পিতলের মূর্তি স্থাপন করেন। বলিহারের ৯ চাকার রথ এতদ অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল। প্রাসাদের কিছুটা দূরেই ছিল বিশাল বাগান। বাগানে এখনও কিছু রাজার শাসন আমলে লাগানো গাছ রয়েছে। তবে, বাগানবাড়িটির সামনের পুকুরঘাটের একটি ছাদ এখনও দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে বসত নিয়মিত জলসা। কলকাতা থেকে আনা হতো নর্তকী। বলিহারের রাজাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। রাজা কৃষ্ণেন্দ্র নাথ রায় বাহাদুর একজন লেখক ছিলেন। তার লেখা গ্রন্থের মধ্যে কৃষ্ণেন্দ্র গ্রন্থাবলী ১ম ও ২য় খ- অন্যতম। দেশ বিভাগের সময় এবং জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে অন্যসব রাজার মতো বলিহারের রাজার উত্তরাধিকারী বিমলেন্দু রায় চলে যান ভারতে। এরপর প্রাসাদটি রাজপরিবারের অন্য কর্মচারীরা দেখভাল করতে থাকেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এবং পরবর্তীতে লুট হয়ে যায় রাজবাড়ির ঐতিহ্যবাহী মহামূল্যবান নিদর্শন, আসবাবপত্র, জানালা-দরজাসহ বিভিন্ন সামগ্রী। দর্শনীয় প্রাসাদটির কয়েকটি ভবন বর্তমানে কোন রকমে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। কথিত আছে বলিহারের জমিদারিতে ৩৩০টি দীঘি ও পুকুর ছিল। এখনও অনেক দীঘি ও পুকুর রয়েছে। এসব দীঘি ও পুকুরের নাম খুবই শ্রুতিমধুর। যেমন মালাহার,সীতাহার,বলিহার, অন্তাহার এমন নানান নামেই ছিল দীঘি ও পুকুর পরিচিতি। সৌখিন রাজাদের ছিল মিনিচিড়িয়াখানা। সেখানে ছিল বাঘ, ভাল্লুক, বানর, হরিণসহ নানা প্রজাতির পশু এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। মোগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহ বারো ভুঁইয়াদের দমন করতে এদেশে আসেন। তিনি তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে এক পর্যায়ে বলিহার পৌঁছেন। দীর্ঘপথ অতিক্রম করায় সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। বিশ্রামের জন্য ও মানসিংহের প্রেরিত গুপ্তচরের মাধ্যমে বারো ভূঁইয়াদের খবর জানার জন্য যাত্রা বিরতি করেন সেনাপতি মানসিংহ। ওই সময় চলছিল বরেন্দ্র অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুম। মানসিংহ সৈন্যবাহিনী দিয়ে ৩৩০টি দীঘি ও পুকুর খনন করেন। নওগাঁ সদর উপজেলার বলিহার ইউনিয়নে ঐতিহাসিক বলিহার রাজবাড়িটি অবস্থিত। রাজবাড়ির একটি ভবন স্থানীয় একটি স্কুলের পাঠদান কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নতুন স্কুল ভবন নির্মিত হওয়ায় রাজবাড়ির ভবনটি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। রাজভবনটি ৩য় তলা। ভবনের ছাদ থেকে বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টি মেলানো যায়। প্রাসাদ কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত বিশাল দেবালয়টি স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পূজা অর্চনা করেন। দেবালয়ের ভেতরে অনেক কক্ষ আছে। প্রাসাদের সিংহ দুয়ার এখনও অনেকটাই শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাসাদের পেছনের মালিপাড়ায় বিশাল আকারের পাশাপাশি ২টি শিবলিঙ্গ আছে। সেখানে পূজা হয়। প্রাসাদের ভবনগুলো ছিল একটির থেকে অন্যটি কিছুটা দূরে। প্রাসাদ চত্বরের মাঝে ছিল আটচালা। বিভিন্ন পার্বণের দিনে অনুষ্ঠিত হতো নাটক, যাত্রা, কবিগান, কীর্তনসহ কত অনুষ্ঠান! আটচালার নিকটতম ভবনের সিঁড়িগুলো ব্যবহৃত হতো গ্যালারি হিসেবে। মূল প্রাসাদের সামনে সতেজ দুটি গাছ আছে। নাম নাগলিঙ্গম। বর্ষা মৌসুমে গাছটিতে ফুল ফোটে।
×