ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ৭ মার্চ ২০১৯

অগ্নিঝরা মার্চ

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিকেলে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষাধিক লোকের অভূতপূর্ব সমাবেশে ভাষণ দেন। ২৬ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বেলা সোয়া তিনটায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাস্থলে এসে উপস্থিত হন। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি ও কালো কোট পরিহিত শেখ মুজিব মঞ্চে এসে দাঁড়ালে বীর জনতা করতালি ও ‘জয়বাংলা’ সেøাগানের মধ্যদিয়ে তাকে অভিনন্দন জানান। বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু আহ্বান জানালেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি- তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশা আল্লাহ।’ বক্তৃতাকালে জনতার কণ্ঠে উচ্চারিত সেøাগান হচ্ছিল, ‘জাগো জাগো- বাঙালি জাগো,’ ‘পাঞ্জাব না বাংলা- বাংলা বাংলা,’ ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা,’ ‘তোমার নেতা আমার নেতা- শেখ মুজিব, শেখ মুজিব,’ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো- বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রিলে না করার প্রতিবাদে বেতারে কর্মরত বাঙালী কর্মচারীরা কাজ বর্জন করেন এবং বিকেল থেকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সব অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ রিলে করা হবে- এ ঘোষণার পর সারা বাংলায় শ্রোতারা অধীর আগ্রহে রেডিও সেট নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। শেষ মুহূর্তে সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়ার প্রতিবাদে বেতার কেন্দ্রটি অচল হয়ে পড়ে। তখন কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। গভীর রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ প্রচারের অনুমতি দিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দিয়ে ঢাকা বেতার কেন্দ্র পুনরায় চালু হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর পরই ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব) আসগর খান সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং অনতিবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ শাসন করার অধিকার আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। রাতে বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান প্রসঙ্গে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। সংবাদপত্রে প্রদত্ত বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণের জবাবে বলেন, ১ মার্চ আকস্মিকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আকস্মিক ও অবাঞ্ছিতভাবে স্থগিত ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত নিরস্ত্র বেসামরিক বাঙালীদের ওপর ব্যাপকভাবে গুলি চালানো হয়েছে। গত সপ্তাহে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা শহীদ হয়েছেন। এই শহীদদের ‘ধ্বংসকারী শক্তি’ আখ্যাদান নিঃসন্দেহে সত্যের অপলাপ। প্রকৃতপক্ষে তারাই ধ্বংসকারী যারা বাংলাদেশের বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির জন্য দায়ী। ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স মাঠে পূর্বঘোষিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করেন দশ লক্ষাধিক মানুষের বিশাল সমাবেশে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ছিল মূলত বাঙালীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শাশ্বত প্রেরণার উৎস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি অহিংস, আসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচী দেন, যা বাংলাদেশের সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হতে থাকে। তিনি বেসামরিক প্রশাসন চালু করার জন্য ৩৫টি বিধি জারি করেন। ৭ মার্চ থেকে পূর্ব বাংলা মূলত তার নির্দেশেই চলতে থাকে। সেদিন থেকে ৩২ নম্বর ধানম-ির বাড়িটি ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের সব আশা আকাক্সক্ষার উৎস। মানুষ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকত সেখান থেকে কি নির্দেশ আসে? বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর মিছিলে মিছিলে পুরো চট্টগ্রামের সব রাস্তা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হতে থাকে চারপাশ। চট্টগ্রামবাসী বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত অধ্যায়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। ডাঃ মাহফুজুর রহমান, ডাঃ গোফরানুল হক, জাকারিয়া চৌধুরী, রাখাল চন্দ্র বণিক, আবদুল্লাহ-আল-হারুন, সাবের আহমেদ আজগরীর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে শুরু হয় অস্ত্রের প্রশিক্ষণ। ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পর এ দেশ যে স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে এগোচ্ছিল তা স্পষ্ট হয়ে যায় ৭ মার্চ। পাকিস্তানের শোষণ, নির্যাতন আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাতি স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ হয়েছিল। এ দেশের তরুণ-তরুণী, আবালবৃদ্ধবনিতা সেদিন এই একটি কণ্ঠের মন্ত্রমুগ্ধে আবিষ্ট হয়ে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য যার যার মতো করে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। পূর্বাপর এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ভাষণটি যদি মিলিয়ে দেখি, তাহলে দেখা যায় কী নিখুঁতভাবে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ সাজিয়ে ছিলেন। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে দশটি অধ্যায় চিহ্নিত করা যায়! ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ -২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনা ও বাঙালীর অধিকার অস্বীকারের ইতিহাস। ১৯৭০ এর নির্বাচনের গণরায় বানচালে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার পাকিস্তানী ষড়যন্ত্র। পাকিস্তানের নয়া চক্রান্ত ১০ মার্চের গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান। বঙ্গবন্ধুর পাল্টা প্রস্তাব সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফেরত যাওয়া, হত্যার তদন্ত, জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। সর্বাত্মক অসহযোগ- হরতালের ঘোষণা। প্রয়োজনে সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক। পূর্ববাংলা পরিচালনার রাজনৈতিক কর্তৃত্বভার গ্রহণ। পূর্ব থেকে পশ্চিমে অর্থ চালান বন্ধ ও পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ বিছিন্ন করা। সশস্ত্র প্রতিরোধের আহ্বান ও জাতীয় মুক্তি, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার নির্দেশ। মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা। এই ভাষণের ফলাফলে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, কী অপূর্বভাবে তিনি স্বশাসন এবং স্বাধীনতা, গণআন্দোলন, নির্বাচন ও সশস্ত্র সংগ্রামের সমন্বয় সাধন করেছেন। একটি ভাষণ একটি জাতিকে স্বাধীনতা পেতে কিভাবে দাঁড় করিয়ে দিলো, পৃথিবীর ইতিহাসে তা অবিস্মরণীয়।
×