ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জেলা সদরে ‘আইসিইউ’ ‘সিসিইউ’ স্থাপন লাল ফিতায় বন্দী

প্রকাশিত: ১০:৫২, ৭ মার্চ ২০১৯

জেলা সদরে ‘আইসিইউ’ ‘সিসিইউ’ স্থাপন লাল ফিতায় বন্দী

বিকাশ দত্ত ॥ দেশের জেলা সদরের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) ও করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) স্থাপন লালফিতায় বন্দী। দেশের সব জেলা সদরের ৩০ বেডের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) ও করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) স্থাপনে হাইকোর্ট নির্দেশনা দিয়েছে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে কমিটি গঠন করার পাশাপাশি মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে তিনটি কার্যক্রম গ্রহণের যে নির্দেশ দিয়েছিল তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। এ প্রসঙ্গে রিটকারী আইনজীবী ও সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ড. বশির আহম্মেদ বলেন, জনস্বার্থে প্রোবোন মোকদ্দমা হাইকোর্টের নির্দেশনাক্রমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেশের সব জেলা সদরে আইসিইউ স্থাপনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ও মূল্য তালিকা বেসরকারী ক্লিনিক, হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মূল্যতালিকা পুনর্নির্ধারণের (’৮২’র পর থেকে রিভিউ হয়নি) সেই প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ৬০ দিনের মধ্যে পুনর্নির্ধারণ করে অর্ডিন্যান্স জারি করবে। এই সিদ্ধান্তের পরে আজ পর্যন্ত এই অগ্রগতিও আলোর মুখ দেখেনি। হাইকোর্টের বার বার নির্দেশনার পর এখনও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যার জন্য হাইকোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করছে। এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। সে বিষয়ে আদেশের জন্য আজ বৃহস্পতিবার দিন ধার্য রয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ১ আগস্ট যুগ্ম সচিব মোঃ সাইফুল্লাহিল আযমের স্বাক্ষরিত মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটিতে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের যুগ্ম সচিবকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। কিন্তু আজ অবধি সেই কমিটি কোন অগ্রগতি হাইকোর্টে দাখিল করেনি। একই দিন (২০১৮ সালের ১ আগস্ট) যুগ্ম সচিব মোঃ সাইফুল্লাহিল আযমের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে দেশের সব জেলা সদরে সরকারী হাসপাতালে ৩০ বেডের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) ও করোনারি কেয়ার ইউনিটি (সিসিইউ) স্থাপনের পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। এ ছাড়া গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর উপ-সচিব মোস্তাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকে তিনটি বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। তাও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। সকল বেসরকারী ক্লিনিক, হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্য তালিকার সেকশন ১৫ অনুয়ায়ী প্রতিবছর সময়ে সময়ে সংশোধন করার কথা থাকলেও ১৯৮২ সালের পর তা করা হয়নি। হিউম্যান রাইটস ল’ইয়ার্স এ্যান্ড সিকিউরিং এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশ (প্রোবোনো ল’ইয়ার্স) হাইকোর্টে রিট দায়ের করে। রিট দায়েরের পর আদালত দেশের সকল বেসরকারী ক্লিনিক, হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্য তালিকা নির্ধারণ ও সে তালিকা প্রদর্শনের নির্দেশ বাস্তবায়নের বিষয়ে কতটা অগ্রগতি হয়েছে সে বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটিকে ওই প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে আদেশের জন্য আজ বুধবার দিন ধার্য আছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মোঃ খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন রিটকারীর আইনজীবী সুপ্রীমকোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক ড. বশির আহমেদ। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এর আগে হাইকোর্ট তার আদেশে স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্যতালিকার বিষয়ে প্রতিবেদন চেয়েছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে আদালতে কোন প্রতিবেদন দাখিল হয়নি। তাই বিষয়টি আদালতকে অবহিত করলে আদালত পুনরায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন। তিনি আরও বলেন, জনস্বার্থে প্রোবোন মোকদ্দমা মুমূর্ষু রোগীদের মফঃস্বলে হার্ট এ্যাটাক বা স্ট্রোক করলে ঢাকায় আনতে ৭০ ভাগ রোগী রাস্তাতেই মারা যায়। আর বিত্তবানেরা এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে রোগীকে ঢাকায় নিয়ে আসে। আমার রিট মোকদ্দমায় হাইকোর্টের নির্দেশনাক্রমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেশের সব জেলা সদরে আইসিইউ স্থাপনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ও মূল্য তালিকা বেসরকারী ক্লিনিক, হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মূল্যতালিকা পুনর্নির্ধারণের (’৮২’র পর থেকে রিভিউ হয়নি) সেই প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ৬০ দিনের মধ্যে পুনর্নির্ধারণ করে অর্ডিন্যান্স জারি করবে। ১১ সেপ্টেম্বর এই সিদ্ধান্তের পরে আজ পর্যন্ত এই অগ্রগতিরও আলোর মুখ দেখেনি। হাইকোর্টের বার বার নির্দেশনার পর এখনও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যার জন্য হাইকোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করছে। রিট দায়েরের পর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কার্যক্রম গ্রহণ করে। সেখানে বলা হয়, (১) হাইকোর্টের নির্দেশনা মতে সকল বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন প্যাথলজি পরীক্ষার ফি, সেবার মূল্য তালিকা এবং চিকিৎসা ফি (মূল্যতালিকা) প্রকাশ্য (উন্মুক্ত) স্থানে ২০১৮ সালের ৯ আগস্ট তারিখের মধ্যে গ্রহণ করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরকে অনুরোধ করা হয়েছে। (২) মেডিক্যাল প্রাকটিস এ্যান্ড ক্লিনিকস এ্যান্ড ল্যাবরেটরিস (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ অনুয়ায়ী নীতিমালা তৈরি জরার জন্য যুগ্মসচিব (বেসরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অধিশাখা) কে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। এবং কমিটিকে ৬০ দিনের মধ্যে অর্ডিন্যান্স প্রণয়ন করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। (৩) দেশের সব জেলা সদরে সরকারী হাসপাতালে ৩০ বেডের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) ও করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) স্থাপনের বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উন্নয়ন অনুবিভাগ ও মহাপরিচালক স্বাস্থ্য অধিদফতরকে অনুরোধ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ১৬ আগস্ট মন্ত্রণালয় আরেক চিঠিতে বলে, মেডিক্যাল প্র্যাকটিস এ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস এ্যান্ড ল্যাবেরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২ অনুয়ায়ী নীতিমালা তৈরির জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত অর্ডিন্যান্স ৬০ দিনের মধ্যে প্রণয়নের জন্য এ মন্ত্রণালয়ের আইন অধিশাখা হতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এমতাবস্থায় মেডিক্যাল প্র্যাকটিস এ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস এ্যান্ড ল্যাবেরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২ অনুয়ায়ী নীতিমালা আগামী ৬০ দিনের মধ্যে প্রণয়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। এর আগে ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই দেশের সকল বেসরকারী ক্লিনিক, হাসপাতাল, ল্যাবেরেটরি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্য তালিকা আইন অনুসারে প্রদর্শনের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। ১৫ দিনের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলকে ওই আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। হিউম্যান রাইটস ল’ইয়ার্স এ্যান্ড সিকিউরিং এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশের পক্ষে কোষাধ্যক্ষ মোঃ শাহ আলম রিটটি দায়ের করেন। রিটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে বিবাদী করা হয়। রিট আবেদনে দ্য মেডিক্যাল প্র্যাকটিস এ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস এ্যান্ড ল্যাবেরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২-এর ১৪ ধারা কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারির আবেদন জানানো হয়। এই ধারায় বলা আছে, ‘ডিজি হেলথ অথবা তার মনোনীত কোন কর্মকর্তার লিখিত অভিযোগ ছাড়া কোন আদালত এ অধ্যাদেশের অধীন কোন অপরাধ আমলে নিতে পারবেন না।’ এ ছাড়াও দেশের সব জেলা সদরের হাসপাতালে ৩০টি আইসিইউ বা সিসিইউ বেড স্থাপন করার কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়েও রুল জারি করে হাইকোর্ট। এর পাশাপাশি অনুমোদিত এবং অনুমোদনহীন প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরীক্ষা এবং এ সব পরীক্ষার মূল্য তালিকা কেন প্রদর্শন করা হবে না এবং বেসরকারী ক্লিনিকগুলো যাচাই-বাছাই করে কেন লাইসেন্স দেয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চায় আদালত। রিট আবেদনে ৩০ দিনের মধ্যে সব অনুমোদিত এবং অনুমোদনহীন প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের যন্ত্রপাতিসহ তালিকা দাখিল, সব জেলা সদরের হাসপাতালে ৩০ বেডের আইসিইউ/সিসিইউ স্থাপন, মেয়াদহীন ওষুধ ব্যবহারে প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিএসটিআই অনুমোদিত ওষুধ ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে প্রোবোনার রিটকারী আইনজীবী ও সুপ্রীমকোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক ড. বশির আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেন, মুমূর্ষু রোগীদের আর্তনাদে চিকিৎসা সেবার সঠিক মূল্য তালিকা নির্ধারণ ও জেলা সদরে আইসিইউ ও সিসিইউ স্থাপন করলে প্রতিদিন প্রতিঘণ্টায় কিছু লোক মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেত। আমি মনে করি বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আইসিইউ ও সিসিইউ স্থাপনে এই টাকা বরাদ্দ দিতে কোন কুণ্ঠা বোধ করবেন না। অচিরেই প্রশাসনিক শত জটিলতার পরেও এই কার্যক্রম সফল হবে বলে আমি আশাবাদ ব্যাক্ত করছি।
×