ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: ১০:৫২, ৭ মার্চ ২০১৯

প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না আওয়ামী লীগ

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা দল-মত নির্বিশেষে সকলের সহযোগিতা কামনা করে বলেছেন, আওয়ামী লীগ প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। আমরা সাম্য, ভ্রাতৃত্ব এবং ঐক্যে বিশ্বাসী। এজন্য আমরা বিভিন্ন সময় জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছি। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে আমরা ক্ষুধা-দারিদ্র্য নিরক্ষরতার অভিশাপমুক্ত বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। এজন্য আমি দল-মত নির্বিশেষে সকলের সহযোগিতা চাই। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে টেবিলে উত্থাপিত প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামানের প্রশ্নের লিখিত জবাবে তিনি এ আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকারের দৃষ্টিতে দেশের সকল নাগরিক সমান। সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ সবসময়ই জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তির ওপর আস্থাশীল। একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য সকল নাগরিকের অংশগ্রহণ জরুরী। আমরা ব্যক্তি হিসেবে বিভিন্ন দল/সংগঠন করতে পারি, আমাদের মতের ভিন্নতাও থাকতে পারে। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় প্রতিপক্ষ দলকে নিঃশেষ করার অপচেষ্টা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আওয়ামী লীগ এবং এর দলের নেতাকর্মীগণ এ ধরনের বৈরী আচরণের শিকার হয়েছেন বারবার। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের দুঃশাসনের কথা তুলে ধরে সংসদ নেতা বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের পরদিন থেকেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং সমর্থকগণ চরম নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবেও বারবার হামলার শিকার হয়েছি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আমার এবং আমাদের দলের নেতাকর্মীদের ওপর ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। আমার দলের ২২ নেতাকর্মীসহ সেদিন মোট ২৪ জন নিহত এবং ৫ শতাধিক মানুষ আহত হয়েছিলেন। যারা বেঁচে আছেন শরীরে স্পিøন্টার নিয়ে দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। শেখ হাসিনা বলেন, গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ের পর আমরা টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছি। আমাদের দৃষ্টিতে দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিক সমান। আমরা সবার জন্য কাজ করব। গত ২৫ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে আমি বলেছিলাম, এখন আমাদের প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের ঐক্যের যোগসূত্র হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাম্য ও ন্যায়বিচার এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে আমরা দেশের সকল নিবন্ধিত দলের সঙ্গে সংলাপ করেছি। সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা সংসদকে সকল কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছি। সংসদে বিরোধীদলের সদস্যদের সমন্বয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিসহ বিভিন্ন কমিটি গঠন করেছি। সমৃদ্ধির পথে হাঁটছে বাংলাদেশ ॥ সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এম আবদুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, দেশী-বিদেশী নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে উন্নয়ন, অগ্রগতি আর সমৃদ্ধির পথে হাঁটছে আমাদের আজকের বাংলাদেশ। ৪২ বছর স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকায় থাকার পর গত বছরের ১৭ মার্চ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হওয়ার স্বীকৃতি পেয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ, যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার ইতিহাস। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের দুর্নীতি-দুঃশাসনের চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই দেশের অগ্রযাত্রা থমকে দাঁড়ায়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। আবার দুর্নীতিতে নিপতিত হয় দেশ। হাওয়া ভবনের নামে তারেক জিয়া চালাতে থাকে লুটপাট। অর্থনৈতিক উন্নয়ন সূচকের প্রায় সবই বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়তে থাকে। ২০০৮ সালে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে আবার দেশের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। বিগত ১০ বছর ধরে এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এমন পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছি যে, পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প নিজেদের অর্থায়নে বাস্তবায়ন করছি। পদ্মা সেতুসহ আমরা ১০টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। এছাড়া আমার নিজস্ব চিন্তাপ্রসূত ১০টি বিশেষ উদ্যোগও বাস্তবায়ন করছি, যা ‘শেখ হাসিনার ১০ বিশেষ উদ্যোগ’ নামে পরিচিত। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের জনকল্যাণমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের কারণে বাংলাদেশের এই উন্নয়ন এবং অদম্য অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়েছে। আশির দশকের তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ কাটিয়ে বাংলাদেশ আজ উন্নয়ন বিস্ময় হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত উন্মোচিত হচ্ছে নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার। সরকারপ্রধান বলেন, দ্রুততম সময়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের রূপরেখা বাস্তবায়নে আমাদের সরকারের সক্ষমতা ইতোমধ্যে প্রমাণ হয়েছে। এটি শুধু আমাদের দাবি নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত সত্য। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রযাত্রা এখন বিশ্বের রোল মডেল। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সমৃদ্ধ ও উন্নত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় দুঃখী ও অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই আওয়ামী লীগ সরকারের মূল লক্ষ্য। আর এ লক্ষ্য পূরণে নিরলসভাবে কাজ করতে আমি ও আমার সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। হোটেল-রেস্তরাঁ গ্রেডিং পদ্ধতির আওতায় ॥ সরকারী দলের সংসদ সদস্য শহীদুজ্জামান সরকারের প্রশ্নের লিখিত জবাবে প্রধানমন্ত্রী মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভেজাল ও দূষণমুক্ত নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে আইন প্রণয়নসহ নানামুখী পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে বলেন, দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪টি ও ৬টি মেট্রোপলিটন এলাকায় ৭টিসহ মোট ৭১টি বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত গঠন করা হয়েছে। মামলা পরিচালনার জন্য প্রতিটি আদালতে একজন করে পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জানান, সরকারী, বেসরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার আওতায় মোট ৫০টি খাদ্য পরীক্ষাগারের একটি ল্যাব ডাইরেক্টরি প্রণয়ন করা হয়েছে। খাদ্যে ভেজাল নিরূপণ এবং পরীক্ষার জন্য ১০টি ল্যাবরেটরি ও ২৩৪টি টেস্ট প্যারামিটারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ঢাকার মতিঝিল, দিলকুশা, গুলিস্তান, পল্টন, সচিবালয় এলাকায় অবস্থিত হোটেল রেস্তরাঁসমূহ গ্রেডিং পদ্ধতির (এ+, এ, বি, ও সি) আওতায় আনার কাজ চলছে। গত ২০ জানুয়ারি ৫৭টি হোটেল রেস্তরাঁ এ+ (গ্রিন) ও এ (ব্লু) স্টিকার প্রদান করা হয়েছে। সংসদ নেতা জানান, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩-এর আওতায় অপরাধ আমলে নিয়ে নিয়মিতভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৫ হাজার ৯৬টি মামলা দায়ের করে ৩ কোটি ৮৩ লাখ ২৮ হাজার ৮৪০ টাকা অর্থদ- ও ২৫৬ ব্যক্তিকে কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে ভেজালবিরোধী অভিযান আরও জোরদার করা হচ্ছে। খাদ্যের মান ফিরে না আসা পর্যন্ত ভেজালবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে। এক লাখ ৩৩ হাজার পরিবারকে ঘর নির্মাণ ॥ সরকারী দলের সংসদ সদস্য ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, দেশের স্বল্প আয়ের মানুষ এবং মধ্যবিত্তদের আবাসনের সমস্যা সমাধান করা বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার। এ জন্য আমরা জাতীয় গৃহায়ণ নীতিমালা-২০১৭ প্রণয়ন করেছি। যেখানে সকল নাগরিকের বিশেষ করে নি¤œ ও মধ্যবিত্ত আয়ের জনগণের বাসস্থান নিশ্চিত করার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশনা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘যার জমি আছে ঘর নেই’ এমন ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯৫৩টি পরিবারকে তার নিজ জমিতে ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। ৫/১০ ইউনিট বিশিষ্ট পাকা, সেমি-পাকা ও সিআইসিট ব্যারাক হাউস নির্মাণ করে ১ লাখ ৫০ হাজার ৬২৩টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এছাড়াও পার্বত্যাঞ্চলের উপজাতিদের জন্য ৩৮টি, রাখাইনদের জন্য ২০টি এবং রাঙ্গামাটি উপজেলাধীন লংগদুতে ক্ষতিগ্রস্ত ১৭৬টি পরিবারকে বিশেষ ডিজাইনের ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১ কোটি কর্মসংস্থান ॥ সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দেশের যুব সমাজের বেকারত্ব দূর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর ও সংস্থার মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। উল্লিখিত প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হবে। তিনি জানান, ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছি। এ সকল অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থাপিত শিল্প কারখানায় ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আমাদের বিনিয়োগবান্ধব নীতির জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে যা এদেশের মানুষের বেকারত্ব দূরীকরণে ভূমিকা রাখছে। এছাড়া প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গমন করছেন। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি তাঁরা দেশের রেমিটেন্স প্রবাহ শক্তিশালী রাখতেও ভূমিকা রাখছেন।
×