ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মাসুদ রানা

গণহত্যা ১৯৭১ ॥ খুলনার রংপুর

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ৭ মার্চ ২০১৯

গণহত্যা ১৯৭১ ॥ খুলনার রংপুর

খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার একটি গ্রাম রংপুর। রংপুর গ্রামের পাশর্^বর্তী একটি গ্রাম বসেরাবাদ। গ্রামটি ডুমুরিয়া উপজেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও ফুলতলা উপজেলা সীমানার ঠিক পাশে অবস্থিত। এপ্রিল মাসের প্রথম থেকে ফুলতলা উপজেলার কতিপয় দুর্বৃত্ত বসেরাবাদ গ্রামে এসে ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করছিল। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে বন্দুক ও বোমার ভয় দেখিয়ে মূল হোতা লখাই ডাকাতসহ কিছু দুর্বৃত্ত বসেরাবাদ গ্রামের কয়েকটি বাড়ি দখল করে নেয়। এলাকাবাসী তাদের গ্রামকে রক্ষা করার জন্য সংঘবদ্ধভাবে দুর্বৃত্তদের উপরে আক্রমণ করলে গণ-পিটুনিতে ৪-৫ জনকে হত্যা করে। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে রংপুর গ্রামের কিছু গ্রামবাসী সহযোগিতা করেছিল। লখাই ডাকাত ছিল পাকিস্তানী বাহিনীর অন্যতম সহযোগী। পাকিস্তানী সহযোগীকে হত্যা করার প্রতিবাদে ১৫ এপ্রিল, পহেলা বৈশাখ পাকিস্তানী সৈন্যরা দুটি গাড়ি করে রংপুর গ্রামের পাশর্^বর্তী শলুয়াবাজারের কাছে এসে নামে। এরপর পাকিস্তানী সেনারা শলুয়াবাজারের উত্তর দিকের বিলের ভিতর দিয়ে হেঁটে কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে রংপুর গ্রামে প্রবেশ করে। পাকিস্তানী সেনারা আলাদা আলাদাভাবে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি আক্রমণ করতে থাকে। একটি গ্রুপ গ্রামে প্রবেশের মুখে ভোণ্ডাল মণ্ডল নামে একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীকে গুলি করে হত্যা করে। অন্য একটি দল কালীবাটী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রফুল্ল কুমার বিশ^াসকে খোঁজ করতে থাকে। প্রফুল্ল কুমার বিশ^াস ঐ দিন সকালে নিজ বাড়িতেই ছিলেন। পাকিস্তানী সেনাদের বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে তার পরিচয় দেন। তিনি ইংরেজী ভাল জানতেন বলে পাকিস্তানী সেনাদের বুঝানোর চেষ্টা করেন রংপুর গ্রামের মানুষ শান্তিপ্রিয় এবং শান্তিশৃঙ্খলা ভঙ্গের এমন কোন কাজে তারা নিযুক্ত নেই। কিন্তু পাকিস্তানী সেনারা তার কথায় কোন কর্ণপাত না করে তাকে পাশর্^বর্তী খালের পাশে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। ইন্দুভূষণ বিশ^াস ও তার স্ত্রী উর্মিলা বিশ্বাস ‘ভগবতীপূজা’ করছিলেন। পাকিস্তানী সেনাদের প্রফুল্ল কুমার বিশ^াসের বাড়ি আক্রমণ করতে দেখে পূজা ছেড়ে তাদের সন্তানদের নিয়ে ঘরের মধ্যে আশ্রয় নেন। তাঁদের বাড়িটি ছিল পাকা দালানের এজন্য প্রতিবেশী অনেকে তাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রফুল্ল কুমার বিশ^াসকে হত্যা করার পরে এই গ্রুপটি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ইন্দুভূষণ বিশ^াসের বাড়িতে হামলা চালায়। পাকিস্তানী সেনারা ইন্দু ভূষণ বিশ্বাসের ঘরের দরজা লাথি মেরে ভেঙ্গে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। পাকিস্তানী সেনারা ঘরের দরজা ভাঙ্গার পূর্বেই ঘরের মধ্যে আশ্রয় নেয়া মহিলা ও শিশুদের ঘরের পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে বের করে দেয়। পাকিস্তানী সেনারা ঘরের মধ্য থেকে ইন্দুভূষণ বিশ্বাস ও তার স্ত্রী উর্মিলা বিশ্বাসসহ কয়েকজনকে ধরে পাশর্^বর্তী জোতদার বাড়ি সংলগ্ন বিলে নিয়ে যায়। পাকিস্তানী সেনাদের আর একটি দল জোতদার বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে কয়েকজনকে আটক করে। অন্য গ্রুপ গ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রামবাসীকে আটক করে জোতদারবাড়ির পাশে বিলে নিয়ে যায়। আটককৃতদের মধ্যে ১২ বছরের একটি ছেলেও ছিল। পাকিস্তানী সেনারা তাকে ছেড়ে দেয়। পাকিস্তানী সেনারা আটককৃত আনুমানিক ৩০জনকে বিলের পাশে মাঠে উপুড় করে শুইয়ে বেয়নেট চার্জ করে। বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে অনেকে আর্তনাদ করতে থাকেন, কেউ কেউ পালানোর চেষ্টা করেন। যারা পালানোর চেষ্টা করেন তাদের পাকিস্তানী সেনারা গুলি করে হত্যা করে। ঘণ্টাখানেকের উপরে তাদের উপরে নির্যাতন চলতে থাকে। নাহার বিশ্বাস ও রতন বিশ্বাস মোটরসাইকেলে করে শলুয়াবাজারের দিকে যাওয়ার সময় পাকিস্তানী বাহিনী তাদের ধরে রাইফেলের বাট দিয়ে অত্যাচার করে কাঁটাবনের মধ্যে ফেলে দেয়। গণহত্যা শেষে পাকিস্তানী বাহিনী ঐ দু’জনকে আহত অবস্থায় ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তাদের লাশ পাওয়া যায়নি। রংপুর গণহত্যার শহীদের সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। কারণ, ঐদিন বহিরাগত অনেকে গণহত্যার শিকার হয়েছিল। এ সম্পর্কে বিস্তারিত রয়েছে ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ জাদুঘর ট্রাস্ট প্রকাশিত দিব্যদ্যুতি সরকারের গবেষণাগ্রন্থ ‘রংপুর গণহত্যা’ নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালায়। লেখক : কর্মকর্তা, গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র, খুলনা
×