ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ শাহরিন আক্তার চাঁদনী

এবার বিশ্বকাপে চোখ বাঘিনীদের

প্রকাশিত: ১১:৪৬, ৬ মার্চ ২০১৯

এবার বিশ্বকাপে চোখ বাঘিনীদের

এ নিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের এএফসি অনূর্ধ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলার বাঘিনী ফুটবলাররা। থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হবে আট দলের চূড়ান্ত লড়াই। এই লড়াইটি আবার ফিফা অনুর্ধ-১৭ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বও বটে। থাইল্যান্ডের এই টুর্নামেন্ট থেকেই সেরা তিনটি দল সরাসরি খেলবে আগামী অনুর্ধ-১৭ বিশ্বকাপে। চতুর্থ দলের সামনেও থাকবে সুযোগ। সেক্ষেত্রে প্লে-অফ খেলতে হবে তাদের। এএফসি অনুর্ধ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত পর্বে, অর্থাৎ সেরা আট দলে নাম লেখানোর পর এখন বাংলাদেশের মেয়েদের সামনেও তৈরি হয়েছে বিশ্বকাপের মঞ্চে জায়গা করে নেয়ার সুবর্ণ সুযোগ। ২০২০ সালের বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার দৌড়ে আছে ভারত ও ফ্রান্স। ফিফার পরবর্তী কাউন্সিলে চূড়ান্ত হবে কোন্ দেশ আয়োজন করে নারী অ-১৭ বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপে খেলবে ১৬ দেশ। যার মধ্যে এশিয়ার তিনটি। বাংলাদেশের মেয়েরা এশিয়ার সেরা ৮-এ থাকলে তিনে চোখ তো রাখতেই পারে। যদিও লক্ষ্যটা কঠিন বাংলাদেশের জন্য। আগামী সেপ্টেম্বরে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হবে এএফসি অ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপ। যেখানে আগেই নাম লিখে রেখেছে গত আসরের চ্যাম্পিয়ন উত্তর কোরিয়া, রানার্সআপ দক্ষিণ কোরিয়া, তৃতীয় স্থানের অধিকারী জাপান এবং স্বাগতিক থাইল্যান্ড। এই চার দলের সঙ্গে যোগ হবে দ্বিতীয় পর্বের সেরা চার দল। এক ম্যাচ হাতে রেখেই ওই পর্বের টিকেট নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ ও চীন। বাকি দু’দলও (‘এ’ গ্রুপের অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস ও ইরানের মধ্যে যেকোন দুই দল) মূলপর্বে উন্নীত হবে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই। বাছাইপর্বে ‘বি’ গ্রুপে খেলেছে বাংলাদেশ। ভেন্যু ছিল মিয়ানমারের মান্দালয়ের থিরি স্টেডিয়াম। নিজেদের প্রথম ম্যাচে ফিলিপিন্সকে ১০-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে শুভসূচনা করে তারা। পরের ম্যাচে স্বাগতিক মিয়ানমারকে ১-০ গোলে হারিয়ে মূলপর্বে নাম লেখায়। বাংলাদেশের মতো মূলপর্বে নাম লেখায় আরেক দল চীন-ও। তারা হারায় মিয়ানমারকে ৫-০ এবং ফিলিপিন্সকে ৭-০ গোলে। মেয়েদের ফুটবলে ধারে-ভারে এগিয়ে থাকা চীনকে হারাতে পারলে মারিয়া-মনিকাদের গড়া হতো নতুন ইতিহাস, কিন্তু চীনের প্রাচীর ভাঙা সম্ভব হয়নি গোলাম রব্বানী ছোটনের শিষ্যাদের। শেষ ম্যাচ টপ ফেভারিট চীনের কাছে ৩-০ গোলে হেরে গ্রুপ রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় লাল-সবুজ বাহিনীকে। রবিবার গ্রুপসেরা হওয়ার লড়াইয়ে নেমেছিল এএফসি অ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত পর্ব নিশ্চিত করা দুই দল। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হতে বাংলাদেশের দরকার ছিল জয়, চীনের ড্র, কিন্তু চীন শুরু থেকেই বাংলাদেশকে হারাতে মরিয়া ছিল। চীনের কাছে হারের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় বাংলাদেশের মেয়েদের এএফসি অ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইয়ের দ্বিতীয় পর্বের মিশন। চীনকে হারিয়ে শেষটা রাঙানোর স্বপ্ন ছিল, তা আর পূরণ হলো না। তবে আসল লক্ষ্যটা ঠিকই পূরণ হয় বাংলাদেশের মেয়েদের। দ্বিতীয় ম্যাচে মিয়ানমারকে হারিয়ে লাল-সবুজ জার্সিধারী মেয়েরা জায়গা করে নেয় এশিয়ার সর্বোচ্চ মঞ্চে। ‘বি’ গ্রুপে চীনই ছিল টপ ফেবারিট। বাংলাদেশের জন্য এ প্রতিপক্ষ একেবারেই নতুন। আগে বাংলাদেশের মেয়েরা কোন পর্যায়ের ফুটবলেই চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলেনি। তবে ২০১৭ সালে থাইল্যান্ডে যাওয়ার আগে অ-১৬ দল চীন সফর করে চারটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছিল ছোটনের শিষ্যারা। যার দুটি ছিল দেশটির অ-১৪ দলের বিরুদ্ধে, দুটি প্রাদেশিক দলের বিরুদ্ধে। ওই চার ম্যাচের দুটি জিতেছিল বাংলাদেশ এবং একটি হেরে একটি ড্র করেছিল। চীনের ওই অ-১৪ দলের কয়েকজন ফুটবলার ছিল এবারের অ-১৬ দলে। চীনের বিরুদ্ধে জিতলে বাংলার মেয়েদের ফুটবলে নতুন এক ইতিহাসই রচিত হতো। মিয়ানমারকে হারিয়ে এএফসি অ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত পর্বে ওঠায় কিশোরী ফুটবলারদের অভিনন্দন জানিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। এএফসি অ-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ বাছাইপর্বে (রাউন্ড-২) খেলতে মিয়ানমার যায় বাংলাদেশ অ-১৬ জাতীয় নারী ফুটবল দল। তবে দায়িত্বজ্ঞানহীন কা- ঘটিয়ে রহস্যজনকভাবে দলের সঙ্গে সেখানে যাননি দলের ম্যানেজার আমিরুল ইসলাম বাবু! জানা যায়, তিনি তখন দেশেই ছিলেন। অসুস্থ নয়, সুস্থভাবেই ব্যস্ত ছিলেন নিজের ব্যবসা ও মোহামেডান ক্লাবের ম্যানেজারি নিয়ে! তার মানে দেশ বা জাতীয় দলের চেয়েও তার কাছে ক্লাব বা ব্যক্তিগত কাজই বড়! এর আগেও তিনি এমন কা- করেছেন। নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ছেড়ে ব্যস্ত ছিলেন অন্য কাজে। তবে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) এজন্য তাকে আগেও যেমন সতর্ক করেনি বা শাস্তি দেয়নি, তেমনি এবারও করবে কি না, সন্দেহ আছে! ‘প্রচারের কাঙাল’ এই বাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছেÑ তিনি নিজের চেহারা ও ছবি মিডিয়ায় দেখাতে অসাধু পন্থা অবলম্বন করেন। যুদ্ধে জিততে গেলে কেবল সৈন্যই নয়, চাই অস্ত্র, গোলাবারুদ, রসদ, আত্মবিশ্বাস আর যোগ্য সেনাপতির সঠিক দিক-নির্দেশনা। বাংলাদেশ জাতীয় অ-১৬ নারী ফুটবল দল হচ্ছে সেই সৈন্যদল, যাদের সেনাপতি হচ্ছেন দ্রোনাচার্য্য গোলাম রব্বানী ছোটন। তার হাতে রয়েছে অস্ত্রের ভা-ার। আছে রূপনা চাকমার মতো মেধাবী গোলরক্ষক, যে কিনা পথম দুই ম্যাচে কোন গোল হজম করেনি, ওই ম্যাচগুলোতে প্রতিপক্ষের বেশকিছু আক্রমণ নস্যাৎ করে দেয় স্বীয় দক্ষতায়। আছে আঁখি খাতুনের মতো দীর্ঘদেহী স্টপার, যে কিনা প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের রুখে দেবার পাশাপাশি লম্বা ফ্রি এবং কর্নার থেকে হেডে বল জাতে পাঠাতে পারে। আছে আনাই মগিনির মতো অফুরন্ত দমের রাইটব্যাক, যে কি না লম্বা থ্রো করার পাশাপাশি প্রায়ই আক্রমণে উঠে যায় এবং দলের প্রয়োজনে নিমিষেই আবার নিজ পজিশনে ফিরে যেতে পারে। আছে নাজমা খাতুন ও নিলুফা ইয়াসমীন নীলার মতো ডিফেন্ডার, যারা প্রতিপক্ষের বল কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি সতীর্থদের নিখুঁত পাস দিতে পারে। আছে মনিকা চাকমার মতো এ্যাটাকিং মিডফিল্ডার, যে কি না দারুণ স্কিল দিয়ে দ্রুত আক্রমণে ওঠে, বা পায়ে চমৎকার বাঁক খাওয়ানো কর্নার নিতে পারে, গোল করে ও গোল করাতে পারে। আছে মারিয়া মান্দার মতো সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার, যে কি না মাঝমাঠ থেকে পুরো খেলাটা নিয়ন্ত্রণ করে, পুরো দলকে খেলায় এবং প্রতিপক্ষের ডি-বক্সের অনেক বাইরে থেকে আচমকা দূরপাল্লার শট নিয়ে গোল করতে পারে। আছে শামসুন্নাহার সিনিয়র, যে কিনা ডিফেন্স এবং ফরোয়ার্ড, দুই পজিশনেই খেলতে পারে। আছে আনুচিং মগিনি, তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহার জুনিয়রের মতো পরিশ্রমী, গতিশীল এবং সুযোগসন্ধানী ফরোয়ার্ড। এছাড়া রিজার্ভ বেঞ্চের ঋতুপর্ণা চাকমা, কি না প্রচ- গতিশীল ফরোয়ার্ড। বাংলাদেশ দলের মিয়ানমার-মিশন সফল হবার পেছনে যে ক’জন ফুটবলারের অবদান ছিল, তাদের অন্যতম মনিকা চাকমা। বাবা-মায়ের চোখ রাঙানি আর বকুনির ভয়ে ফুটবল খেলতো লুকিয়ে লুকিয়ে। খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীচরের বিন্দু কুমার আর রবি মালার ৫ মেয়ের সবার ছোট সেই মনিকা চাকমা এখন বাংলাদেশের ফুটবলের বড় সম্পদ। এ কিশোরীর এক কর্নার কিকে বাংলাদেশ পৌঁছে যায় এএফসি অ-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত পর্বে। মনিকাদের পরিবারের আর কারুর সম্পৃক্ততা নেই ফুটবলে। কৃষক বাবা বিন্দু কুমার আর গৃহিণী মা রবি মালা কিছুতেই চাইতেন না তার কোন মেয়ে ফুটবল নিয়ে মাঠে ছোটাছুটি করুক। সেই বাধা উপেক্ষা করে বিকেলে ফুটবল নিয়ে মাঠে নামতো পরিবারের ছোট মেয়ে মনিকা। মনিকা ২০১১ সালে বঙ্গমাতা প্রাথমিক বিদ্যালয় টুর্নামেন্টে ফুটবল খেলেছিল ময়মনসিংহের হয়ে। দুই বছর পর খেলে নিজ স্কুলের জার্সি গায়ে। বঙ্গমাতা টুর্নামেন্ট থেকে উঠে আসা সেই মনিকাই এখন দেশের নারী ফুটবলের অন্যতম বড় মুখ। খেতে ফসল ফলানো বিন্দুর মেয়ে ফুটবলের ফুল ফুটিয়ে যাচ্ছে লাল-সবুজ জার্সি গায়ে। ফুটবল মাঠ রাঙাচ্ছে বাবা-মায়ের চোখ রাঙানি খাওয়া সেই মেয়েটি। সংবাদ সম্মেলনে ফিলিপিন্স কোচ বলেছেন, ‘বাংলাদেশ খুবই গতিময় একটি দল। এ দলের বেশ কজন প্রতিভাবান খেলোয়াড় আছে। যেমন মনিকা চাকমা, অধিনায়ক মারিয়া মান্দা এবং গোলরক্ষক রূপনা চাকমা।’ দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে টানা দ্বিতীয়বারের মতো এএফসি অ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। অন্যদিকে, মূলপর্বে খেলা তো দূরের কথাÑ বাছাইপর্বের প্রথম পর্বের বাধাই পেরোতে পারেনি ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য তিনটি দেশ নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান! এর আগে গত বছর সেপ্টেম্বরে ঘরের মাঠে প্রথম পর্বে বাহরাইন, লেবানন, আরব আমিরাত ও ভিয়েতনামের সঙ্গে বাছাইপর্বের ‘এফ’ গ্রুপে ছিল বাংলাদেশ। যেখানে চার ম্যাচে মোট ২৭ গোল করে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাছাইপর্বের দ্বিতীয় রাউন্ডের টিকেট নিশ্চিত করেছিল স্বাগতিকরা। একই রাউন্ডে লাওস, হংকং, মঙ্গোলিয়া আর পাকিস্তানের সঙ্গে গ্রুপ ‘বি’তে ছিল ভারত। মঙ্গোলিয়ায় অনুষ্ঠিত বাছাইপর্বে চার ম্যাচে দুই জয়, এক ড্র ও এক হার নিয়ে গ্রুপ রানার্সআপ হয় তারা। রানার্সআপ হলেও দ্বিতীয় পর্বে খেলার সুযোগ ছিল। ছয় গ্রুপ থেকে দুটি সেরা রানার্সআপই সেই সুযোগ পেত। কিন্তু ভারত তা হতে পারেনি। চার ম্যাচে কোন গোল না করে ২০ গোল হজম করে গ্রুপের তলানিতে থেকে বাছাইপর্ব শেষ করে একই গ্রুপে থাকা পাকিস্তান। বাংলাদেশ দল ॥ খেলোয়াড় : মাহমুদা আক্তার, রূপনা চাকমা, ইয়াসমীন আক্তার, আঁখি খাতুন, নাজমা, আনাই মগিনি, নিলুফা ইয়ামীন নীলা, ঋতুপর্ণা চাকমা, মারিয়া মান্দা, মনিকা চাকমা, মনি আক্তার, লাবণী আক্তার, সোহাগী কিসকু, ইলামনি, সুলতানা, আনুচিং মগিনি, নওশন জাহান, রেহেনা আক্তার, শাহেদা আক্তার রিপা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন ও রোজিনা আক্তার। কোচ : গোলাম রব্বানী ছোটন, সহকারী কোচ : মাহবুবুর রহমান লিটু, মাহমুদা আক্তার, মিডিয়া ম্যানেজার : আহসান আহমেদ অমিত, ফিজিওথেরাপিস্ট : সাদিয়া শারমিন।
×