ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আরহামের ‘জল ইস্পাতে ঐকতান’

কঠিনেরে ভাষা বৃষ্টির ছন্দ, অপার মুগ্ধতা

প্রকাশিত: ১০:৪২, ৬ মার্চ ২০১৯

কঠিনেরে ভাষা বৃষ্টির ছন্দ, অপার মুগ্ধতা

মোরসালিন মিজান ॥ গত কয়েকদিন ধরে একটু আধটু বৃষ্টি হচ্ছে। হচ্ছে বটে। বর্ষার অনেক বাকি। তবে শিল্পী তার কল্পনায় ভর করে যেখানে খুশি চলে যেতে পারেন। বসন্ত এখন। হলোই বা। নামাতে পারেন শ্রাবণধারা। প্রমাণ চাই? ফোলার রোড ঘুরে আসুন। ঢুঁ মারুন ব্রিটিশ কাউন্সিলে। সেখানে এখন চলছে দারুণ সব ভাস্কর্যের প্রদর্শনী। স্ক্র্যাপ মেটাল ভাস্কর্যের শক্ত গড়ন। কঠিন অভিব্যক্তি। কিন্তু শিল্পীত ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। প্রতিটি ভাস্কর্য একইসঙ্গে জলের ফোয়ারা। কঠিনের বুক চিড়ে বেরিয়ে আসা জল কত কী যে বলে চলেছে! কখনও মনে হচ্ছে কথা, কখনওবা গান। ‘ডুয়েটস ইন মেটাল এন্ড ওয়াটার’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে কথা কবিতা গানের জন্ম দিয়েছেন আরহাম উল হক চৌধুরী। তার গড়া ভাস্কর্যের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ঠা-া ঝিরি ঝিরি হাওয়া এসে গায়ে লাগে। ভেতরটা নরম হয়ে যায়। বহুকাল আগে ফেলে আসা গ্রাম, টিনের চালে শব্দ তোলা বৃষ্টি, ঝিলের শান্ত জলে ভেসে থাকা পদ্ম ফুলÑ সব মনে পড়ে যায়! এবং মনে পড়ে যায় পক্ষাঘাতগ্রস্তদের কথা। ভাস্কর্যের আলোচনায় বিপদগ্রস্ত মানুষের কথা আসছে কেন? কারণ আছে। শিল্পী আরহাম মানবিক মানুষ। পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পাশে থাকার চেষ্টা করেন। সে লক্ষ্যে মাঝে মাঝেই ছুটে যান সাভারের সিআরপিতে। অন্যান্য কাজের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির ওয়ার্কশপে নিয়মিত যাতায়াত করেন তিনি। ওখানে হুইল চেয়ার তৈরি হয়। চেয়ার তৈরির পর পরিত্যক্ত লোহার পাইপ, লোহার পাত, চেইনের বিচ্ছিন্ন অংশ কুড়িয়ে নেন তিনি। ব্যবহার অযোগ্য স্ট্রেচার ট্রলি, ক্রাচ ইত্যাদি সংগ্রহ করেন। পরে নিজের মতো করে এই ধাতুকে ভাঙ্গেন। গড়েন। এভাবে অনিন্দ্য সুন্দর গঠন-নির্মিতি। একইভাবে ভাস্কর বলতে চান, পক্ষাঘাতগ্রস্তদের জীবন আছে। আছে সম্ভাবনা। সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানোর তাগিদ দিয়ে যায় আরহামের ভাস্কর্য। আগেও বহুবার মেটাল মাধ্যমে কাজ করেছেন শিল্পী। করে করে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছেন। মেটালের স্বভাব বুঝেন তিনি। বশে আনতে জানেন। কিন্তু এবার ইস্পাতের সঙ্গে জল যোগ হওয়ায় নতুন মাত্রা পেয়েছে প্রদর্শনীটি। বলার অপেক্ষা রাখে না, ধাতু এবং জল সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। তদুপরি দু’য়ের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক গড়ার প্রয়াস নিয়েছেন শিল্পী। প্রদর্শনীতে বেশ কিছু ফিগারেটিভ কাজ। সরু পাইপকে মোটা রেখার মতো ব্যবহার করা হয়েছে। পাইপ বাঁকা করে, জোড়া দিয়ে, একটির উপরে অন্যটি স্থাপন করে স্বতন্ত্র শিল্পভাষা নির্মাণের চেষ্টা। পাইপের মতো লোহার পাতগুলোকেও শিল্পীর মোটা ব্রাশের টান বলেই মনে হয়। ফিগারগুলো রিয়ালিস্টিক হয়ে ওঠে। ভেতরে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়ে ‘অপেক্ষা’ শিরোনামের ভাস্কর্যটি। সেখানে টিনের চাল চুইয়ে পড়া বৃষ্টির ধারা। অদ্ভুত ছন্দ। খেয়াল করলে দেখা যায়, ঘরের ভেতরে কেউ একজন অপেক্ষা করে আছেন। বাইরের যানজট। গাড়ির হর্ন। সব ভুলিয়ে দেয় এই রিমঝিম শব্দ। অন্যপাশে বটবৃক্ষের নিচে সৌম্য শান্ত চেহারার গৌতম বুদ্ধ বসে আছেন। আগেও শিল্পী এ মহামানবকে ভাস্কর্যে তুলে ধরেছেন। তবে এবার চার দেয়ালে আটকে রাখেননি। খোলা পরিসরে ধ্যানী বুদ্ধকে আরও গভীর চেতনামগ্ন মনে হয়। ‘সংবেদনশীল’ শিরোনামের ফিগারেটিভ কাজটিও খুব নিখুঁত। ফ্রি স্ট্যান্ডিং ভাস্কর্য মুগ্ধ করে রাখে। এরপর বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা। এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা বোধের জন্ম দেয়। কিছু দূর এগিয়ে গেলে আবারও সংযোগ স্থাপিত হয় প্রদর্শনীর সঙ্গে। পেছনের এ অংশে বেশ বড়সরো জায়গা। খোলা চত্বর। আরহাম পরিসরটিকে সুন্দর ব্যবহার করেছেন। এখানে ওখানে স্থাপন করেছেন ভাস্কর্য। একটি কৃত্রিম গোলাকার জলাধারে পদ্মফুল ফুটে আছে। মেটালে গড়া? একদমই তা মনে হয় না। জলের ছটায় পাপড়িগুলো জেগে ওঠেছে যেন। অদূরে তানসেন। তানপুরা বাজিয়ে চলেছেন সুর সাধক। ওপর থেকে পড়তে থাকা জলের ধারা কী সুন্দর সুর তুলে চলেছে, কান পাতলেই যেন মেঘ মাল্লার শোনা যায়! বৃষ্টির মধ্যে সন্তান কোলে হেঁটে যাওয়া মায়ের উপস্থাপনা বিশেষ দৃষ্টি কাড়ে। শুধু হেঁটে যাওয়া নয়, ছাতা মাথায় শিশু সন্তানটিকে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা। এখানে একটা গতি, গতিটা সহজেই দর্শনার্থীদের স্পর্শ করে। এসবের বাইরে ভাস্কর পুরানের বিভিন্ন চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন। মিডুসা, বালক ও সর্পরাজ, নদীমাতার অবতরণ, কল্পতরু ইত্যাদি ভাস্কর্য নানা ব্যঞ্জনা পেয়েছে প্রদর্শনীতে। সব মিলিয়ে উপভোগ্য আয়োজন। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহযোগিতায় আয়োজিত প্রদর্শনী আজ বুধবার শেষ হবে। শেষ দিন যেহেতু, ঢুঁ মেরে আসুন একবার। ভাল লাগবে। চাইলে সংগ্রহ করা যাবে ভাস্কর্য। বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থ শিল্পী দান করবেন সিআরপিতে।
×