ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মেয়র নির্বাচনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু কম ভোটার উপস্থিতি

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ২ মার্চ ২০১৯

 মেয়র নির্বাচনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু কম ভোটার উপস্থিতি

শাহীন রহমান ॥ ঢাকা উত্তরের মেয়র উনি-র্বাচনের ১৩৩ নম্বর ভোটকেন্দ্র ছিল মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজারের বেশি। বৃহস্পতিবার ভোটের দিনে সর্বসাকল্যে ওই কেন্দ্রে ভোট দেন মাত্র ৪৪ জন। সারাদিন কর্মকর্তারা ভোটারের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ভোটারের দেখা মেলেনি। মেয়র পদে উপ-নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হলেও দিনভর আলোচনার কেন্দ্রেবিন্দু কম ভোটার উপস্থিতি। ভোটের পর থেকে ভোটারের কম উপস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। খোদ সিইসি এই নির্বাচনে কম ভোটার উপস্থিতির জন্য দায়ী করেছেন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াকে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে নানা পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক এই নির্বাচনে কম উপস্থিতির জন্য বিএনপি ভোটে না আসার পাশাপাশি আর চারটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, ভোটারদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনে ভোটার কম উপস্থিতির কয়েকটি দিক বেরিয়ে এসেছে। অন্যতম কারণ ছিল বিএনপি নির্বাচনে না আসা। বিষয়টি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও স্বীকার করেছেন। এ ছাড়াও প্রার্থীদের সরব প্রচারণা লক্ষ্য করা যায়নি। মিছিল মিটিং মাইকিং কোথাও ছিল না। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম অনেকটাই নিশ্চিত ছিলেন, তিনি মেয়র হতে চলেছেন। যে কারণে প্রার্থী থেকে শুরু করে কর্মী সমর্থকদের মধ্যে নির্বাচনী প্রচার কোথাও সরব হতে দেখা যায়নি। নির্বাচনে আতিকুলসহ ৫ মেয়র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে শক্ত কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। ৫ প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিলেও ভোটের ময়দানে তাদের কখনও দেখা যায়নি। কারও কাছে ভোট প্রার্থনা করেনি। ফলে আতিকুল ছাড়া অন্য প্রার্থী কারা ছিল ভোটারদের জানা ছিল না বললেই চলে। প্রার্থীর সম্পর্কে না জানার কারণে অনেকে ভোট কেন্দ্রে হাজির হননি। আবার আওয়ামী লীগের প্রার্থীর মতো ভোটাররাও নিশ্চিত ছিল যে নির্বাচনে আতিকুল ইসলাম জয়ী হচ্ছেন। ফলে ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে যাওয়ার কোন প্রয়োজন তারা দেখেননি। তারা বলছেন, তিনি তো এমনিতেই মেয়র হচ্ছেন। ভোট দিয়ে লাভ কি হবে। এমনকি আওয়ামী নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে সরব উপস্থিতি দেখা যায়নি। পাশাপাশি ভোটের দিনের বৈরী হাওয়ার কারণে ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তবে সরেজমিনে সব কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়া পরিস্থিতি ভাল হলেও ভোটাররা ভোট কেন্দ্র অভিমুখী হয়নি। এ ছাড়া বিশ্লেষণে উঠে এসেছে মেয়র পদের এই উপ-নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মেয়াদ মাত্র ১ বছরের জন্য। আগামী ১ বছরের মধ্যে আবার সিটি নির্বাচন দিতে হবে। মেয়াদ কম হওয়ার কারণেই মূলত ভোটারদের মধ্যে এই নির্বাচন নিয়ে কোন আগ্রহ ছিল না। নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে শুরু থেকেই এই নির্বাচনের পরিবেশ ছিল একেবারেই নিরুত্তাপ। ২৩ জানুয়ারি তফসিল ঘোষণার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ কম লক্ষ্য করা গেছে। মূলত বিএনপি অংশ না নেয়ায় ভোটারদের মধ্যে এই নির্বাচন নিয়ে বাড়তি আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি ঘটলেও এবং গত পাঁচ বছরে সংসদে দলটির অংশগ্রহণ না থাকলেও এখনও ভোটার ও জনগণের মধ্যে দলটির প্রভাব ব্যাপক। তৃণমূল থেকে দলটির এখনও শক্ত সংগঠন রয়েছে। দেশের রাজনীতি এখনও মূলত আওয়ামী লীগ বিএনপি এই দুই ধারায় বিভক্ত। ফলে বিগত ৫ বছরে জাতীয় পার্টি সংসদের বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করলে দলটির তৃণমূলে শক্ত কোন ভিত্তি নেই। গত ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে ভরাডুবির পর থেকে বিএনপির সিটি নির্বাচন এবং উপজেলায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলটি সিটি নির্বাচন বর্জন করে প্রার্থী দেয়া থেকে বিরত থাকে। মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর গত বছর ৯ জানুয়ারি ঢকার উত্তর সিটিতে উপ-নির্বাচনের জন্য তফসিল ঘোষণা করা হয়। তখন বিএনপি তাবিথ এম আউয়ালকে দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়। পাশাপাশি তখন আওয়ামী লীগ আতিকুল ইসলামকেই প্রার্থী হিসেবে বেছে নেয়। তখন এই নির্বাচন নিয়ে জনগণের ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। আদালতের আদেশের কারণে গত বছর নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। এক বছর পরে নির্বাচনের বাধা কাটলেও বিএনপি না আসায় মূলত জনগণের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে কোন আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়নি। এর পাশাপাশি বিশ্লেষণে দেখা গেছে নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকেই প্রার্থীদের সরব উপস্থিতি ছিল না। ৫ জন প্রার্থী মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে নির্বাচনে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী শাফিন আহমেদ। রাজনীতিবিদ হিসেবে জনগণ আগে কখনও দেখেনি তাকে। মূলত সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তিনি জনগণের কাছে পরিচিত। হঠাৎ রাজনৈতিক অঙ্গনে আগমন এবং মেয়র প্রার্থী হিসেবে জনগণের মধ্যে প্রভাব সৃষ্টি করেনি। প্রচার প্রচারণায় পিছিয়ে ছিলেন তিনি। গোটা নির্বাচনী এলাকায় কোথাও কোথাও তার পোস্টার দেখা গেলেও মাইকিং, মিছিল, মিটিং এবং ভোট চাইতেও দেখা যায়নি। মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী আতিকুল ইসলামের পোস্টার নির্বাচনী এলাকা জুড়ে দেখা গেলেও তার পক্ষে কর্মী সমর্থকদের ভোট চাইতে দেখা যায়নি। অন্য প্রার্থীর মতো আতিকুল ইসলামের পক্ষে কোন মিছিল মিটিং চোখে পড়েনি। কোথাও মাইকিং হতে দেখা যায়নি। তবে নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিনে আতিকুলের পক্ষে কোথাও কোথাও মিছিল হলেও তা উল্লেখ করার মতো ছিল না। তবে আতিকুল ইসলাম তার প্রার্থিতার পক্ষে বেশ কিছু সেমিনার সিম্পোজিয়ামে অংশ নিয়েছেন। এর বাইরে নির্বাচনী এলাকার কোথাও কোথাও লিফলেট বিতরণ করেছেন। এটুকুই। এর বাইরে অন্য তিন প্রার্থী কারা জনগণ সে সম্পর্কে একেবারেই ওয়াকিবহল ছিল না। প্রার্থী সম্পর্কে না জানার কারণেও ভোটারদের মধ্যে এই নির্বাচন নিয়ে কোন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়নি। নির্বাচনের দিন বিভিন্ন কেন্দ্র সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখ গেছে ভোটারদের পাশাপাশি দলের নেতাকর্মীরা সরব ছিল না। প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে সামনে দলের দুএকজন কর্মীকে ভোটার স্লিপ টেবিলে বসে থাকতে দেখা গেছে। এর বাইরে কোন কেন্দ্রেই কর্মী সমর্থকদের ব্যাপক উপস্থিতি চোখে পড়েনি। ভোট সকাল ৮টায় শুরু হলেও অনেক কেন্দ্রে আতিকুল ইসলামের এজেন্টদের সঠিক সময়ে কেন্দ্রে হাজির হতে দেখা যায়নি। ভোটের দিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। কোথাও কোথাও বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ফলে সকাল থেকেই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ঘর থেকে বের হয়নি। সকালে ভোট কেন্দ্রে উপস্থিতি এ কারণে কম ছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণেই ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে আবহাওয়ার পরিবেশ ভাল হয়ে যায়। কিন্তু ভোটার উপস্থিতি সে অনুযায়ী সন্তোষজনক ছিল না। ভোটের দিন ভোটার উপস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। উত্তরায় নিজ কেন্দ্র ভোট দিয়ে স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা এর দায় নিতে অস্বীকার করেন। বলেন, কেন্দ্রে ভোটার হাজির করা কমিশনের কাজ নয়। এটির দায়িত্ব প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলের। তিনি অবশ্য বলেন সব দল না আসায় ভোটার উপস্থিতি বাড়েনি। শুক্রবার জাতীয় ভোটার দিবসের র‌্যালিতে অংশ নিয়ে এ বিষয়ে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে। তিনি ভোটার উপস্থিতি কমের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ঢাকা সিটি নির্বাচনে ভোটার কম হয়েছে। কারণ, এই নির্বাচনের মেয়াদ কম, বিএনপি অংশ নেয়নি। এ ছাড়া বৈরী আবহাওয়ার কারণেও ভোটারা ভোট দিতে আসেননি উল্লেখ করেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার জন্য পাঁচটি কারণের কথা উল্লেখ করেন। ভোটার উপস্থিতির কারণ বলতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ভোটের দিন ছুটি ছিল। অনেক ভোটার বাড়ি চলে গেছেন। বড় একটি দল অংশ নেয়নি। দিনের শুরু থেকে বৃষ্টির বাগড়া ছিল। তা ছাড়া এটা একটি উপ-নির্বাচন। সব মিলিয়ে ভোটারদের উপস্থিতি কম ছিল। শুক্রবার রাজধানীর ধানম-িতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের এ কথা বলেন। বৃহস্পতিবার ঢাকা উত্তর সিটি মেয়র পদে উপ-নির্বাচনে আতিকুল ইসলাম মেয়র হিসেবে বেসরকারীভাবে জয়লাভ করেছেন। এই নির্বাচনে তিনি ভোট পেয়েছেন ৮ লাখ ৩৯ হাজার ৩০২ ভোট। অপর দিকে প্রতিদ্বন্দ্বী শাফিন আহমেদ ভোট পেয়েছেন মাত্র ৫২ হাজার ৪২৯ ভোট। রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল কাশেম জানিয়েছে, এই নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ৩১.০৫ শতাংশ। অথচ ঢাকা উত্তর সিটিতে ভোটারদের সংখ্যা রয়েছে ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৬২১ জন। অবশ্য ৩১ পার্সেন্টহারে ভোট পড়াকে বিএনপি সন্দেহের চোখে দেখছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচন (ডিএনসিসি) জনগণ প্রত্যাখ্যান করে ভোটের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে। তার অভিযোগ, ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনে যে ৩১ শতাংশ ভোট পড়েছে বলা হচ্ছে, সেটাও সরকার ‘সিস্টেমের’ মাধ্যমে সম্পন্ন করেছে উল্লেখ করেন।
×