ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কাওসার রহমান

অর্থায়নে সুশাসন আনতে পারে ‘জলবায়ু কমিশন’

প্রকাশিত: ১০:২০, ২ মার্চ ২০১৯

অর্থায়নে সুশাসন আনতে পারে ‘জলবায়ু কমিশন’

দেশের পরিবর্তিত উন্নয়ন অগ্রাধিকারের প্রেক্ষাপটে সরকার জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এর আওতাধীন কর্মসূচিগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য নিজস্ব উৎস থেকে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড। পাশাপাশি জলবায়ু অর্থায়নকে সরকারী আর্থিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংযুক্ত করার পথ-নকশা হিসেবে ২০১৪ সালে প্রণয়ন করা হয় বাংলাদেশ ক্লাইমেট ফিসক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক। যা বাজেট বরাদ্দকে জলবায়ু বিষয়ক নীতি-কৌশলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রযাত্রা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস চুক্তি একদিকে যেমন স্বল্প গ্রিনহাউস গ্যাসভিত্তিক দেশগুলোর উন্নয়ন গতিধারা এবং জলবায়ু-স্থিতিশীল বিকাশের দ্বার উন্মুক্ত করেছে, অন্যদিকে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড এবং অন্যান্য বহুপক্ষীয় উৎস থেকে আর্থিক সহায়তা ত্বরান্বিত করে বাংলাদেশের জন্য সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ উভয়ই তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন একটি জটিল প্রক্রিয়া। আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অর্থপ্রাপ্তির প্রক্রিয়াও জটিল। তাই আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলসমূহ থেকে অর্থ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে উচ্চমানসম্পন্ন অর্থিক পদ্ধতি ও উচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অপরিহার্য। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ কয়েকটি উৎস থেকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অর্থ সহায়তা পাচ্ছে এবং সেই অর্থ বিনিয়োগ করছে। এগুলো হচ্ছে- জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বহুপাক্ষিক তহবিলসমূহ, গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড এবং দ্বিপাক্ষিক আর্থিক সহায়তা। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বহুপাক্ষিক তহবিলসমূহের মধ্যে রয়েছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর তহবিল (এলডিসিএফ), গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল ফ্যাসিলিটি ট্রাস্ট ফান্ড (ক্লাইমেট চেঞ্জ ফোকাল এরিয়া), বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেসিলিয়ান্স ফান্ড (বিসিএসআরএফ) এবং গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ)। বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেসিলিয়ান্স ফান্ডটি ২০০৮ সালে গঠন করা হয়েছিল দ্বিপাক্ষিক সহায়তার ভিত্তিতে। বিশ্বব্যাংক ছিল এই ফান্ডের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে। এই ফান্ডটি এখন বন্ধ হয়ে আছে। এই তহবিলে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৯ কোটি ডলার পাওয়া গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব জাতীয় পার্টির প্রতিনিধি আসায় উদ্যোগের অভাবে এই তহবিলটি স্থবির হয়ে পড়ে। সেই অবস্থা এখনও বিরাজমান। তবে এই তহবিলের প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলে সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণসহ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাকি ফান্ডগুলো থেকে বাংলাদেশ খুব একটা সাহায়তা পাচ্ছে না। মূলত প্রকল্প প্রণয়নে দক্ষতার অভাব এবং অর্থ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মানদণ্ডের বিচারে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে না পারার কারণে এসব ফান্ড থেকে অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে জলবায়ু স্থিতিশীল বিকাশের পথে দেশের সাফল্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড হচ্ছে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু অর্থায়নের সবচেয়ে বড় উৎস, যা জাতিসংঘের আঞ্চলিক গ্রুপে প্রতিনিধিত্বকারী উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ হতে সমান সংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত ২৪ সদস্যের একটি বোর্ড দ্বারা পরিচালিত। বাংলাদেশের পক্ষে জিসিএফ এ প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা হচ্ছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), যা ‘জাতীয় নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ’ (এনডিএ) নামে পরিচিত। এনডিএ জাতীয় প্রাধিকারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কৌশলগত নজরদারির কাজ করে, অংশীজনদের সমাবেশ আয়োজন করে, জিসিএফ হতে অর্থায়নের উদ্দেশ্যে প্রকল্প বা কর্মসূচী নির্বাচন করে এবং জিসিএফ হতে অর্থ প্রাপ্তির লক্ষ্যে দেশেকে প্রস্তুত করার বিষয়ে নেতৃত্ব প্রদান করে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ২০১৪ সালের নবেম্বর মাসে বাংলাদেশর এনডিএ মনোনীত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ইডকল এবং পিকেএসএফ এনআইয়ে হিসেবে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করেছে। ২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের ৮৫.৪২ মিলিয়ন ডলারের তিনটি প্রকল্প জিসিএফ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ জিসিএফের এনডিএ হলেও জলবায়ু পরিবর্তন এবং তা অর্থায়নের সঙ্গে সরকারী ও বেসরকারী অংশীজন, সামাজিক সংগঠন, বেসরকারী সংগঠন, উন্নয়ন সহযাগীরা সংশ্লিষ্ট। এ কারণে প্রয়োজন সর্বোত্তম সমন্বয়। কাজেই, জিসিএফে আভিগম্যতা কেবল একটি অর্থায়ন সংশ্লিষ্ট বিষয় নয়, বরং জিসিএফের এনডিএ হিসেবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের নতুন ভূমিকা ও দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে পালনের ক্ষেত্রে যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন, সর্বোত্তম সমন্বয়, সক্ষমতা বৃদ্ধি, কতিপয় ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রভৃতি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, বিদেশী দাতাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত উন্নয়ন সহায়তা (ওডিএ) কার্যক্রম সরকারী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। যেমন- বৈদেশিক সহায়তা এবং আইএনজিওর উন্নয়ন সহায়তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ দেখভাল করে থাকে। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রাপ্ত সহায়তা বা আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলসমূহ (এলডিসিএফ, জিইএফ, পিপিসিআর এবং জিসিএফ) থেকে প্রাপ্ত তহবিলের দায়িত্ব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ওপর ন্যস্ত। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রকল্প এবং কর্মসূচিগুলোর জন্য প্রাপ্ত অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কতটা সম্পর্কিত তা স্পষ্ট নয়। রাজস্ব বাজেট বরাদ্দ ও বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা : ২০১৭ সালে অর্থ বিভাগ ৬টি মন্ত্রণালয়ের আয়-ব্যয়ের ভিত্তিতে প্রথমবারের মতো ‘জলবায়ু সুরক্ষা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বাজেট প্রতিবেদন ২০১৭-১৮’ প্রকাশের পর এ অর্থবছরে (২০১৮-১৯) ২০টি মন্ত্রণালয়ের ওপর দ্বিতীয় প্রতিবেদন (টেকসই উন্নয়নে জলবায়ু অর্থায়ন) প্রকাশ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার প্রয়োজনীয় জাতীয় নীতিমালা, আইন, প্রবিধান এবং অর্থায়ন প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিভিন্ন উৎস থেকে জাতীয় বাজেটের প্রায় ৬ থেকে ৭ শতাংশ (প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার) জলবায়ু অভিযোজনে ব্যয় করছে। আর এই অর্থের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আসছে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে (জলবায়ু বাজেট, ২০১৮-১৯, পৃঃ ৮)। সরকার জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কার্যক্রমে ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে এ পর্যন্ত ৭০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ করেছে। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও ১৮ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড : বিসিসিএসপি ২০০৯-এ বর্ণিত কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (সিসিটিএফ) গঠন করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ি উন্নত দেশের অর্থ প্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা না করে নিজস্ব অর্থায়নে এ ধরলে তহবিল গঠন বিশ্বে প্রথম, যা আন্তর্জাতিক পরিম-লে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এই তহবিলকে আইনী ভিত্তি দিতে জাতীয় সংসদের ‘জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন ২০১০’ পাস করা হয় এবং এর আওতায় বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত জাতীয় বাজেট থেকে এই তহবিলে মোট ৩২শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ২০১০ সাল থেকে সরকার এই ট্রাস্ট ফান্ডের আওতায় বিসিসিএসএপির অগ্রাধিকারধারী প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন শুরু করেছেন এবং ফেব্রুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত মোট ৫৬০টি সরকারী-বেসরকারী প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন করেছেন। এতসব উদ্যোগ সত্ত্বেও জলবায়ু অর্থায়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণের পথে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বিদ্যমান বাস্তবতায় বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থের সমন্বিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে এবং বাংলাদেশে জলবায়ু অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মানকে প্রত্যাশিত মাত্রায় উপনীত করতে জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশে জলবায়ু সুশাসন বৃদ্ধিতে জাতীয় সংসদ প্রণীত ‘জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট (বিসিসিটি) আইন ২০১০’ এর আওতায় প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট (বিসিটিএফ)-এর গঠন কাঠামোতে সর্বাগ্রে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। বর্তমানে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। আর অর্থ, কৃষি, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পররাষ্ট্র, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়; পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়; নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়; স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়: স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী; মন্ত্রিপরিষদ সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিকল্পনা কমিশনের (কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ) সদস্য এবং সরকার কর্তৃক মনোনীত জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে দু’জন বিশেষজ্ঞ এই ট্রাস্টের সদস্য হিসেবে রয়েছেন। চলবে... লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×