ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গৌতম পাণ্ডে

আত্মপ্রত্যয়ী সুরস্রষ্টা ॥ ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১২:০২, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

আত্মপ্রত্যয়ী সুরস্রষ্টা ॥ ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলাম

ঢাকার জার্মান কালচারাল ইনস্টিটিউটে ১৯৯১ সালের ২৭ নবেম্বর বাঁশরী আয়োজিত প্রখ্যাত বংশীবাদক ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলামের একক বাঁশিবাদন অনুষ্ঠানে সঙ্গীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক বলেছিলেন-‘শিল্পী বাংলাদেশে বিশেষ নেই। এ কারণেই সকল পারফর্মারকে আমরা শিল্পী নামে ভূষিত করি। বাদক কিংবা গায়ক মাত্রই শিল্পী নয়। আজিজুল ইসলাম শিল্পী। যাকে সাঙ্গীতিক পরিভাষায় বলা হয় আতায়ী। এটা কোন নিন্দার কথা নয়। তিনি কেবল শিল্পী নয়, সাধক। কারণ এই শিল্পী অর্থের জন্য নয়, প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, প্রতিযোগিতার জন্য নয়, কেবল মাত্র সঙ্গীতকে ভালবেসে সঙ্গীতে জীবন সমর্পণ করেছেন। আমি কিভাবে আমার কৃতজ্ঞতা জানাব জানি না। কারণ উনি আমাদের দেন-আমরা ওঁকে কিছুই দিই না। এই শূন্যতার মাঝখানে যে ব্যবধান এটা প্রাণান্তকর। শিল্পীকে সত্যিকার সম্মান দেয়া দরকার। তাকে বলা দরকার যে আমরা পারি বা না পারি, আপনার সৃষ্টিতে আমরা পরিপূর্ণ।’ এক সময়ে সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিক ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলাম। অথই সমুদ্র। চারিদিকে পানি আর পানি। কবে ডাঙ্গার সন্ধান পাওয়া যাবে তার নিশ্চয়তা নেই। নিঃসঙ্গতা আঁকড়ে ধরে এই জাহাজিকে। এক বন্দর থেকে মাল নিয়ে আরেক বন্দরে খালাস করাই ছিল কাজ। জাহাজ বন্দর ত্যাগ করলেই নিঃসঙ্গতা যেন আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরে। নোঙর যখনই তুলে ফেলা হয়, তথনই হাতে চলে আসে পরম বন্ধু বাঁশি। সমুদ্রের ঢেউ আর নিঃসঙ্গতার মাঝে পরম বন্ধু বাঁশের বাঁশি তাকে দেখায় শিল্পের ঠিকানা। সাগরের বুকে নিঃসঙ্গ প্রহরগুলো কাটাতেন বাঁশি বাজানোর রেওয়াজ করে। বাঁশির সুরে সখ্য সমুদ্রের বিশাল ঢেউ আর পাখির সঙ্গে। সে সময় স্বর্গীয় পান্নালাল ঘোষের বাজানো রেকর্ড এবং অন্যান্য বিখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীদের রেকর্ডগুলো ছিল তার নিত্যসঙ্গী। এরপর প্রায় ৫০ বছরেরও অধিক শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সাধনায় নিবেদিত শিল্পী আজিজুল ইসলামের হাতেখড়ি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আর্য সঙ্গীত সমিতির শিক্ষক প্রিয়দা রঞ্জন সেনগুপ্তের কাছে মাত্র ১৬ বছর বয়সে। তারপর ওস্তাদ বেলায়েত আলী খানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বিশ্ববিখ্যাত সরদবাদক ওস্তাদ বাহাদুর খানের শিষ্যত্ব নেন। পরে স্বর্গীয় প-িত পান্নালাল ঘোষের ঘনিষ্ঠ শিষ্য প-িত দেবেন্দ্র মুদ্রেশ্বর ও প-িত ভিজি কার্নাডের কাছে তালিম নেন। সময়টা ছিল ১৯৭৩ সাল। আজিজুল ইসলাম অবসর নিয়েছেন জাহাজ থেকে। এখন অবারিত সময় বাঁশি চর্চা করার। বিভিন্ন সময়ে ওস্তাদ বেলায়েত আলী খান, সরদবাদক ওস্তাদ বাহাদুর খান, প-িত দেবেন্দ্র মুদ্রেশ্বর ও ভিজি কার্নাডের কাছে শেখার সুযোগ হয় তার। ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একজন শীর্ষস্থানীয় শাস্ত্রীয় ধারার বংশীবাদক হিসেবে পরিচিত গড়ে ওঠে অবসরপ্রাপ্ত এই নাবিকের। ওস্তাদ আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রকৃতিগতভাবেই বাঁশি বাজানোর প্রতি আকৃষ্ট হই। বাঁশির সুর সব সময় আমার মনকে দোলা দেয়। বলা যায়, বাঁশি এখন আমার কাছে নেশার মতো। সময় পেলেই বসে পড়ি বাঁশি হাতে। বাঁশি নিয়ে মজার স্মৃতির কথা জানতে চাইলে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত এ শিল্পী বলেন, বাঁশি নিয়ে এ সময় আমার দুটি মজার স্মৃতি মনে পড়ছে। এক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বরলিপি তৈরিকারী ড. শৈলজা রঞ্জন মজুমদার একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমার বাঁশি বাজানো শুনতে চেয়েছিলেন। বাজানো শেষে তিনি আমার প্রশংসা করেছিলেন যা আমাকে বেশ আলোড়িত করেছিল। দুই, সঙ্গীতজ্ঞ প্রয়াত ওয়াহিদুল হক একটি অনুষ্ঠানে আমার বাঁশি শুনে অনেক প্রশংসা করেছিলেন। স্মরণীয় হয়ে থাকবে এসব স্মৃতি। যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন বাঁশি হাতে শ্রোতাকে মাতিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর ওস্তাদ ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলাম।
×