ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ডিম বিতর্ক ॥ খাবেন, নাকি খাবেন না?

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ডিম বিতর্ক ॥ খাবেন, নাকি খাবেন না?

প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার পালিত হয় ‘বিশ্ব ডিম দিবস’। ভিয়েনায় ১৯৯৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল এগ কমিশন (আইইসি) কর্তৃক অনুষ্ঠিত একটি বিশেষ সম্মেলনে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী জাতি গঠন, সর্বোপরি ডিমের গুণাগুণ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতি বছর এ দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রতিবারই একটি করে প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে। যেমন- ‘সুস্থ সবল জাতি চাই, সব বয়সেই ডিম খাই’, ‘সুস্থ যদি থাকতে চান, প্রতিদিন ডিম খান’, ‘জীবনের জন্য আমিষ’ ইত্যাদি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই ২২ বছর ধরেই মানুষের মাঝে ডিমের গুণাগুণ, ডিম উৎপাদনের সমস্যা ও সম্ভাবনা এবং দেহের পুষ্টি চাহিদা পূরণে প্রতিদিন ডিম খাওয়া উচিত, এই বিষয়ে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছর বিশ্ব ডিম দিবস পালিত হয়ে আসছে। একজন মানুষের সুস্থভাবে জীবন যাপনের জন্য বছরে কমপক্ষে ১০৪টি ডিম খাওয়া উচিত। কিন্তু বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বাংলাদেশের মানুষের বছরে গড় ডিম খাওয়ার পরিমাণ মাত্র ৪৫ থেকে ৬০টি। কিছু কিছু ভুল ধারণার কারণে আমাদের দেশের মানুষের ডিম খাওয়ার প্রবণতাটাও সন্তোষজনক নয়। আবার, ডিম উৎপাদনে অনেকটা ঘাটতিও রয়েছে নিঃসন্দেহে। ডিম খাওয়া সম্পর্কে ভুল ধারণা প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় বিশেষ করে সকালে নাস্তার সময় সবাই ডিম খেতে পছন্দ করেন। সময় স্বল্পতার জন্য ভাতের সঙ্গে তরকারির বিকল্প হিসেবে ডিম ভাজি বা ভর্তা করেও অনেককে খেতে হয়। তবে অনেকের মাঝেই ডিম নিয়ে এক ধরনের ভুল ধারণা আছে তা হলো, সব বয়সে ডিম খাওয়া যায় না, বিশেষ করে বয়স্করা এবং যারা বিভিন্ন রোগে ভোগেন, তারাও ডিম খেতে চান না অথবা মনে করেন দিনে একটার বেশি ডিম খাওয়া যায় না। আবার অনেক স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ মনে করেন, ডিমের সাদা অংশ খাওয়া ভাল তবে কুসুম খাওয়া উচিত নয়। কিন্তু ডিমের কুসুমটাও যে শরীরের পক্ষে কততা উপকারী, তা অনেকেই জানেন না। আসল সত্য হলো, আন্তর্জাতিক পুষ্টি বিজ্ঞানী এবং ডাক্তারদের মতে, ডিমের সাদা অংশের চেয়ে কুসুমের ক্যালরি বেশি। যে কোন বয়সেই ডিম খাওয়া যায়, এমনকি দিনে কয়েকটি ডিম খেতেও কোন বাধা নেই। সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থ জাতি গঠনে প্রয়োজনীয় পুষ্টির জন্য ডিম হতে পারে খাদ্যের অন্যতম উৎস। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে প্রতিদিন অন্তত একটি করে ডিম খাওয়া উচিত, যা প্রোটিনের চাহিদা মিটাবে। প্রশ্নটা হলো, প্রতিদিন বা নিয়মিত ডিম খাওয়া যাবে কি যাবে না, এ নিয়ে ডাক্তার, রোগী এমনকি সুস্থ মানুষের মাঝেও বিভ্রান্তি বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল এবং এখনও আছে। বিশেষ করে যাদের বয়স একটু বেশি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক বা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন এমন রোগী অথবা যাদের রক্তে কোলেস্টেরল বা অন্যান্য চর্বির পরিমাণ বেশি, তাদেরকে ডিম খেতে নিষেধ বা সম্পূর্ণ বর্জন করতে বলা হয়। অনেকেই এমনকি কিছু কিছু চিকিৎসক আবার ডিমের কুসুম বাদ দিয়ে, শুধু সাদা অংশটুকুই খেতে বলেন। এর কারণ তাদের ধারণা একটাই, তা হলো ডিম খেলে রক্তের কোলেস্টেরল বাড়ে, উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রোক এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। আসলে এতদিনের এই ধারণাটা মোটেই সত্য নয়। ডিম খেলে রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা ততটা বৃদ্ধি পায় না। একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষ দৈনিক গড়ে ৩০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত কোলেস্টেরল গ্রহণ করতে পারেন। আর একটি ডিমে রয়েছে মাত্র ২০০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল। তাই বিশেষজ্ঞগণ এমনকি আমেরিকান হার্ট এ্যাসোসিয়েশন এখন আর তাদের খাদ্যের গাইড লাইনে ডিম খাওয়াকে নিরুৎসাহিত করছেন না। যে কোন ব্যক্তি ডিমের সাদা অংশ খেলে কোন সমস্যা তো হবেই না, এমনকি কুসুমসহ সম্পূর্ণ ডিম খেলেও উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও হৃদরোগের ঝুঁকির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আরেকটি বড় গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে, প্রতি সপ্তাহে ৫-৬টি ডিম খেলে হৃদরোগ, স্ট্রোক বা অন্যান্য ধরনের হৃদরোগের কোন ঝুঁকিই নেই। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে বলা হয়, দিনে ১টি ডিম হার্টের জন্য ক্ষতিকর নয়। সকালের নাস্তায় বরং একটি ডিম কোলেস্টেরল প্রোফাইলের ওপর তেমন কোন প্রভাব ফেলে না, যতটা প্রভাব ফেলে আপনার সকালের নাস্তায় মিষ্টি বা চর্বি জাতীয় খাবার খেলে। ডিমের পুষ্টিগুণ ডিমের মধ্যে আছে পানি, প্রোটিন, চর্বি, ভিটামিন এ ই বি-৬, বি-১২, ফলেট, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, আয়রন, খনিজ পদার্থ যেমন জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানিজ, সেলেনিয়াম ইত্যাদি। বলতে গেলে ডিমে সব ভিটামিনই কমবেশি থাকে, তবে ভিটামিন সি কিন্তু নেই। শরীরের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কোলিন, যা কেবল ডিমেই বেশি পাওয়া যায়, অন্যান্য সহজলভ্য খাদ্যে ততটা পাওয়া যায় না। খাদ্যের এই উপাদানগুলো ডিম খেলে সহজেই পাওয়া যায় এবং দামেও সাশ্রয়ী। ডিমের মধ্যে যে প্রোটিন, ভিটামিন বি-১২, রাইবোফ্ল্যাভিন, ফলেট ও ভিটামিন ডি রয়েছে তা কোলেস্টেরল বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে দেয়। এমনকি অনেকদিন ফ্রিজে সংরক্ষিত বা প্রক্রিয়াজাত মাংস খাওয়ার চেয়ে ডিম ভাল বিকল্প খাদ্য হতে পারে। এছাড়াও আমাদের আমিষের মূল উৎস ডিম, মাছ, দুধ, ডাল এবং যে কোন মাংস যেমন হাঁস, মুরগি, গরু, ভেড়া, মহিষ, খাশি ইত্যাদি। তুলনা করলে দেখা যায়, মাংস এমনকি দুধের দামও বেশি, সে হিসাবে ডিম বেশ সস্তা, প্রোটিনের অন্যতম উৎস। ডিমে সুলভ মূল্যে উচ্চমাত্রার প্রোটিন পাওয়া যায়। হাঁস না মুরগি? লালচে না সাদা? অনেকে হাঁস বা মুরগির ডিম এমনকি সাদা বা লালচে ডিম খাওয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। আসলে সব ধরনের ডিমের পুষ্টিগুণ একই রকম। তবে হাঁসের ডিমে প্রোটিন এবং চর্বির মাত্রা সামান্য বেশি, খেতে কোন মানা নেই। কেউ কেউ আবার কাঁচা ডিম খেতে পছন্দ করেন, এমনকি কাঁচা ডিমের পুষ্টিগুণ বেশি বলে মনে করেন, এ ধারণাটা সত্যি নয়। বরং কাঁচা ডিম খেলে সালমোনেলা জাতীয় ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে। আবার কোয়েলের ডিম খাওয়া নিয়েও অনেকেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেনÑ যা আকারে ছোট। ৫টি কোয়েলের ডিম একটি মুরগির ডিমের সমান। পুষ্টিগুণ কিন্তু একই রকম। আবার একথাও সত্য, ডিম যেভাবেই রান্না হোক না কেন, এর পুষ্টিগুণ প্রায় অবিকৃত থাকে, এমনকি পেটে সহজেই হজম ও সম্পূর্ণ শোষিত হয়। দিনে কয়টি ডিম খাওয়া যাবে? তরুণরা এবং যারা বেশি কায়িক পরিশ্রম করেন তারা নিয়মিত ডিম খেতে পারেন, এমনকি দিনে ২-৩টি ডিম খাওয়াও সম্পূর্ণ নিরাপদ। বয়স্করাও সপ্তাহে ৫-৬টি ডিম খেতে পারবেন। আর যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছেন, তাদের সুস্বাস্থ্যের জন্যও নিয়মিত ডিম খাওয়া উচিত। তবে কিডনি অকেজো বা রেনাল ফেইল্যুরের রোগী ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ডিম খাবেন, কারণ কিডনি ফেইল্যুরে প্রোটিন কম খাওয়া উচিত। কারও কারও বেলায় ডিম খেলে এলার্জি জাতীয় সমস্যা হতে পারে, সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডিম নিয়ে কিছু টিপস ১. ডিম অবশ্যই একটি প্রাকৃতিক পুষ্টিকর খাদ্য, যার মধ্যে খাদ্যের সকল উপাদানই বিদ্যমান। সব বয়সের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ডিম অত্যন্ত কার্যকর। শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি, হাড় গঠনে ও মেধার বিকাশে ডিম খুবই কার্যকর। ২. মহিলাদের শারীরিক চাহিদা পূরণে এবং স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে ডিম অত্যন্ত জরুরী। অন্ত্রের ক্যান্সার প্রতিরোধেও ডিম উপকারী। ৩. ডিমের কুসুমে ‘কোলিন’ থাকে, যা মস্তিষ্কের বিকাশ ত্বরান্বিত করে, এমনকি মনোরোগ এবং আলঝাইমারের মতো রোগ কমাতে সহায়তা করে। ৪. ডিম গর্ভবতী মা ও শিশুর জন্য প্রধানতম প্রোটিন যোগায়। ডিমের প্রোটিন মানুষের মস্তিষ্ক ও মাংসপেশির গঠনে এবং রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। ৫. ডিমে কোলেস্টেরল আছে বটে, কিন্তু তা রক্তের কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে না। বরং রক্তের ভাল কোলেস্টেরল (এইচডিএল) বৃদ্ধি করে। শুধু তাই নয়, ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ ডিম রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড অত্যন্ত কার্যকরভাবে কমায়। ৬. প্রতিদিন কুসুমসহ একটি করে ডিম খেলে হৃদযন্ত্র এবং শরীরের রক্ত সঞ্চালনে কোন ঝুঁকি নেই বরং তা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। ৭. ডিমের কুসুম রক্তকণিকার ক্ষতিগ্রস্ত করা থেকে রক্ষা করে, লোহিত কণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি করে ও মস্তিষ্কে অক্সিজেন বৃদ্ধি করে এবং ব্রেইনের স্ট্রোক কমাতে সহায়তা করে। ৮. ডিমে এন্টিঅক্সিডেন্ট যথেষ্ট পরিমাণে থাকেÑ যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতায় সহায়ক। ৯. ডিমে আছে ভিটামিন ‘এ’, যা দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে, অন্ধত্ব দূরীকরণেও সহায়ক। ডিমের কেরোটিনয়েড, ল্যুটেন, জিয়াজেনথিন বয়সকালে চোখের মেকুলার ডিজেনারেশন হওয়ার আশঙ্কা কমিয়ে দেয়। এটি চোখের ছানি কমাতেও সহায়তা করে। ১০. ডিমের কুসুমে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘কে’ আছে। এটি রক্তের বিভিন্ন কাজে সহায়ক, হাড় শক্ত ও মজবুত করে এবং প্রজনন অক্ষমতা দূর করতে সহায়তা করে। ১১. সকালের নাস্তায় একটা সিদ্ধ ডিম খেলে পেটটা অনেকক্ষণ ভর্তি থাকে, ক্ষিদে কম পায় ফলে খাদ্য গ্রহণ নিয়ন্ত্রিত হয়। ১২. অনেকের ধারণা কুসুম খেলে মোটা হয়ে যাবে, কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তা নয়। ডিমে রয়েছে প্রচুর শক্তি যা রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে কিছুটা হলেও কার্যকর। উপসংহারে বলা যায় ডিম নিয়ে রসালো কথার শেষ নেই, পরীক্ষায় খারাপ হলেই বলে ‘ডিম পাবে’, নেতিবাচক কোন কথা হলেই বলা হয় ‘ঘোড়ার ডিম’, রাস্তায়, নাটকে বা অনুষ্ঠানে ক্ষুব্ধ হলেই জনতা ছুড়ে মারে ‘পচা ডিম’। তবুও সুস্বাস্থ্য এবং খাদ্যের জরুরী উপাদান এবং প্রোটিন গ্রহণের জন্য নিয়মিত ডিম খাওয়া নিয়ে কোন বিতর্ক বা বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে, মেধাবী, সুস্থ-সবল, উন্নত জাতি গঠনে ডিমের কোন বিকল্প নেই। প্রতিদিন কমপক্ষে একটি করে ডিম খাবেন, যদি সুস্থ থাকতে চান। লেখক : সাবেক ডিন ও চেয়ারম্যান, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×