ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এক শরণার্থী ফুটবলারের বিজয়-কাহিনী

প্রকাশিত: ১১:৫৭, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

এক শরণার্থী ফুটবলারের বিজয়-কাহিনী

হাকিম আল-আরাইবি। জন্ম ৭ নবেম্বর, ১৯৯৩ সালে। ২৫ বছর বয়সী হাকিম জন্মসূত্রে একজন বাহরাইনী। শৈশবেই তার মধ্যে ফুটবলীয় প্রতিভা দেখা যায়। খেলতেন ডিফেন্ডার পজিশনে। ২০০৯ সালে ১৬ বছর বয়সে বাহরাইনের নামকরা যুব ক্লাব আল-শাবাবে যোগ দেন। এই ক্লাবে খেলেন ২০১২ সাল পর্যন্ত। ওই বছরই ক্লাবটির সিনিয়র দলে যোগ দেন। খেলেন ২০১৪ সাল পর্যন্ত। এই ক্লাবে খেলার সময়ই তিনি বাহরাইন জাতীয় ফুটবল দলে খেলার ডাক পান, ২০১৩ সালে। তবে জাতীয় দলের হয়ে একটির বেশি ম্যাচ খেলা হয়নি তার। এর আগেই অবশ্য বাহরাইন অলিম্পিক দলে (জাতীয় অ-২৩ দল) ডাক পান। কিন্তু এই দলের হয়ে কোন ম্যাচ খেলা হয়নি তার। এরপর তার ওপর চোখ পড়ে অস্ট্রেলিয়ান গ্রিন গালি সকার ক্লাবের। ২০১৫ সালে যোগ দিয়ে এই ক্লাবে কেবল এক বছরই খেলেন। ১৩ ম্যাচ খেলে করেন ১ গোল। ২০১৬ সালে যোগ দেন আরেক অসি ক্লাব গাউলবার্ন ভ্যালি সানসে। ২৪ ম্যাচ খেলে করেন ৫ গোল। ২০১৭ সালে যোগ দেন আরেকটি অসি দল প্রেস্টন লায়ন্সে। এখান ১৩ ম্যাচ খেলে করেন ২ গোল। এরপর ২০১৮ সালে একই দেশের প্যাসকোয়ে ভ্যালেতে যোগ দিয়ে ১২ ম্যাচ খেলে করেন ১ গোল। বোঝাই যাচ্ছে, ডিফেন্ডার হলেও গোল করতে ভালই পারঙ্গম (৯ গোল) হাকিম। এবার আসা যাক হাকিমের বর্তমান জীবন-প্রবাহের ঘটনায়। একটি পুলিশ স্টেশনে আগুন দেয়ার অভিযোগে আল-আরাইবিকে ধরতে ইন্টারপোলে ‘রেড নোটিস’ জারি করেছিল বাহরাইন। এরপর গত ২৭ নবেম্বরে আল-আরাইবি তার স্ত্রীকে নিয়ে হানিমুন করতে থাইল্যান্ডে গেলে ব্যাংকক বিমানবন্দরে তাকে আটক করে। এই ঘটনার পর আল-আরাইবিকে ফেরত পাঠাতে থাইল্যান্ডের কাছে আবেদন জানায় বাহরাইন। যখন সেই আবেদনের শুনানি চলছিল, তখন আল-আরাইবিকে মুক্তি দিতে অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা থাইল্যান্ডকে চাপ দেয়। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন এ নিয়ে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন। এরপর শুনানি চলার সময় হাতকড়া পরা অবস্থায় আল-আরাইবিকে দেখে ‘খুব মর্মাহত’ হয়ে থাই প্রধানমন্ত্রীকে আবারও চিঠি লেখেন স্কট মরিসন। তবে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এক বিবৃতিতে থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি এবং আল-আরাইবির ব্যাংককগামী বিমানে ওঠার খবর পেয়েই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আল-আরাইবির বিরুদ্ধে মামলা চলার কারণে তাকে অন্তত আগামী আগস্ট পর্যন্ত আটক থাকতে হতে পারে বলে ধারণা করেন থাইল্যান্ডের এ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের একজন মুখপাত্র। আল-আরাইবি বাহরাইন থেকে পালিয়ে ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়া চলে যান। সেই সময় পুলিশ স্টেশনে আগুন দেয়ার মামলায় তার অনুপস্থিতিতে রায় দেয় বাহরাইনের আদালত। এতে তাকে ১০ বছরের কারাদ- দেয়া হয়। তবে আল-আরাইবির দাবিÑ যে সময়কার ঘটনার দায়ে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেই সময় তিনি ফুটবল খেলছিলেন। তার বিশ্বাসÑ তিনি শিয়া মতাদর্শী হওয়ার কারণে এবং তার ভাই বাহরাইনের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার কারণে তাকে গ্রেফতার করতে চাইছে বাহরাইন। তাকে মূলত রাজনৈতিক কারণেই ষড়যন্ত্র করে মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হয়। উল্লেখ্য, বাহরাইনের বেশিরভাগ মানুষ শিয়া হলেও দেশ শাসন করছেন সুন্নিরা। থাইল্যান্ডে আটক অবস্থায় আল-আরাইবির প্রতি সমর্থন জানান দিদিয়ের দ্রগবা, জেমি ভার্দি, জর্জো কিয়েলিনির মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত ফুটবলাররা। আল-আরাইবির ঘটনায় থাইল্যান্ডের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার টানাপোড়েন শুরু হওয়ায় থাইল্যান্ডে একটি ওয়ার্মআপ ম্যাচ বাতিল করে অস্ট্রেলিয়া। এ সময় হাকিম শরণার্থী হিসেবে নাগরিকত্ব পান অস্ট্রেলিয়ায়। হাকিমের প্রতি অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ^বাসীর সমর্থন দেখে অবশেষে পিছু হটে বাহরাইন সরকার। তারা হাকিমের ওপর থেকে সমস্ত মামলা ও অভিযোগ তুলে নেয়। ফলে থাইল্যান্ডের কারাগার থেকে মুক্তি পান ফুটবলার হাকিম আল-আরাইবি। ২৫ বছর বয়সী এ খেলোয়াড়কে দেশে ফেরত নেয়ার জন্য বাহরাইন সরকার যে দাবি করে আসছিল, তা প্রত্যাহার করার পর আল-আরাইবি মুক্তি পান। মুক্তির পরেই তিনি থাইল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়া চলে যান। বিষয়টি নিশ্চিত করেন তার আইনজীবী নাদতাসিরি বার্গম্যান এবং থাই ইমিগ্রেশন পুলিশের প্রধান সুরাসাতে হাকপার্ন। এর আগে সরকারী কৌঁসুলি থাই আদালতে হাকিম আল-আরাইবিকে বাহরাইনে ফেরত পাঠানোর দাবি প্রত্যাহার করার জন্য একটি আবেদন জমা দেন। বাহরাইন সরকার ওই দাবি থেকে সরে গেছে বলে থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইঙ্গিত পেয়ে সরকারী কৌঁসুলি আদালতে আবেদন জানান। তবে কী কারণে বাহরাইন সরকার হাকিম আল-আরাইবিকে দেশে ফেরত নেয়ার দাবি থেকে সরে গেছে, তা জানা যায়নি। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেরাইজ পেইন আল-আরাইবির মুক্তির খবরকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে মানবাধিকারের বিরাট বিজয় হলো। প্রাক্তন অস্ট্রেলিয়াান অধিনায়ক ক্রেগ ফস্টার আল-আরাইবির মুক্তির জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তিনি বলেন, তার পরিবার হাকিমের মুুক্তির খবর শুনে আনন্দে কেঁদেছে। থাইল্যান্ডে আটক হবার পর সেখানকার আদালতে হাকিম বলেছিলেন, তিনি চান না তাকে নিজের দেশে ফেরত পাঠানো হোক। বাহরাইন সরকার এ ফুটবলারকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য থাই সরকারকে অনুরোধ জানায়। সে বিষয়ে আদালতে শুনানি হয়। বাহরাইন সরকারের অনুরোধকে হাকিম আল-আরাইবি চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি আদালতে বলেন, দেশে ফিরলে তার ওপর নির্যাতন করা হতে পারে; এমনকি তাকে হত্যা করা হতে পারে! আদালতে পৌঁছে হাকিম আল-আরাইবি সাংবাদিক ও ফুটবল কর্মকর্তাদের তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্যও অনুরোধ করেন। এ সময় তিনি করুণ আর্তি জানিয়ে বলেন, ‘দয়া করে আমাকে বাহরাইনে ফেরত পাঠাবেন না।’ শেষ পর্যন্ত বাহরাইন সরকারের সকল ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের তারকা ফুটবলার ও মানবাধিকার সংগঠনের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় থাই-কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বপ্নের ও ‘সেকেন্ড হাম’ অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাতে সক্ষম হন হাকিম। তার এই ঘটনাটি দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করে ফুটবলবিশ্বে শে^ তথা গোটা বিশ্বেই।
×