ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

২০১৮ সালে বেড়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা

ঋণ পুনর্তফসিলে খেলাপী ঋণ কমেছে ৬ হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৯:২২, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ঋণ পুনর্তফসিলে খেলাপী ঋণ কমেছে ৬ হাজার কোটি টাকা

রহিম শেখ ॥ বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে বড় অঙ্কের ঋণ পুনর্তফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করায় দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণের হার এক অঙ্কের ঘরে নেমে এসেছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ। যদিও গতবছর দেশের ব্যাংকিং খাতে নতুন করে খেলাপী ঋণ যুক্ত হয়েছে ১৯ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষে খেলাপী ঋণ ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে গত বছরেই খেলাপী ঋণ সর্বোচ্চ পরিমাণ বেড়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৬ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০.২৯ শতাংশ ঋণই খেলাপী হয়ে গেছে। ২০১৭ সালের একই সময়ে খেলাপী ঋণ ১২ হাজার ২৩১ কোটি টাকা বেড়ে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা হয়েছিল। ২০১৬ সালে তার আগের বছরের তুলনায় খেলাপী ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। ওই বছর ডিসেম্বর শেষে খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৪ ও ২০১৫ সালে খেলাপী ঋণ বাড়ে যথাক্রমে ৯ হাজার ৫৮০ কোটি ও ৯ হাজার ২৫০ কোটি টাকা হয়। ২০১৪ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপী ঋণ ছিল ৫০ হাজার ১৬০ কোটি টাকা, আর ২০১৫ সালে হয় ৫৯ হাজার ৪১০ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৩ সালে ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। খেলাপী ঋণ বৃদ্ধির বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, নিয়ম না মেনে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেয়ার কারণেই টাকা আদায় হচ্ছে না। প্রকল্প প্রস্তাব ভালভাবে যাচাই-বাছাই না করেই রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ প্রদানের ঘটনা ঘটছে অহরহ। যারা ঋণখেলাপী, তাদেরও যথেষ্ট রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আছে। কাজেই ইচ্ছে করলেই ব্যাংক এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারে না। তার ওপর ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানো হয়। মূলত রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের ঘটনাই ঋণখেলাপী হওয়ার মূল কারণ। এর সঙ্গে রয়েছে ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনা। ব্যাংকগুলোয় দক্ষ লোকবলের অভাব রয়েছে। ইন্টারনাল মনিটরিং এবং সুপারভিশন হয়ত ঠিকমতো করা হয় না। অডিট কমিটির স্বাধীনভাবে কাজ করার কথা থাকলেও তারা তা করতে পারছে না। এছাড়া ব্যাংক কোম্পানি আইনের যে দুর্বলতা রয়েছে, তা দূর করে দ্রুতগতিতে শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে ঋণখেলাপী সংস্কৃতি থেকে বের হওয়া যাবে। জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন জমাদানের শেষদিন ছিল ২৮ নবেম্বর। ১ ডিসেম্বর বাছাইয়ের দিন পর্যন্ত চলে প্রার্থীদের ঋণ পুনর্তফসিলের হিড়িক। প্রায় ২৫০ আবেদন আসে ঋণ পুনর্তফসিলের জন্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও উচ্চ আদালত প্রার্থীদের পুনর্তফসিল করে দেয়। এতে শেষ তিন মাসে (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) খেলাপী ঋণ কমেছে ৬ হাজার ৯২ কোটি টাকা। গতবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অথচ ডিসেম্বরে তা কমে হয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। তবে এটি খেলাপী ঋণের প্রকৃত চিত্র নয়। এর বাইরেও প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা হিসাব থেকে বাদ দিতে অবলোপন করেছে ব্যাংকগুলো। এগুলোও খেলাপী ঋণ। এছাড়া গতবছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা খেলাপী ঋণ পুনর্তফসিল করেছে ব্যাংকগুলো। মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুনর্গঠন ও পুনর্তফসিল এক ধরনের হিসাব জালিয়াতি। এসব ঋণ আদায় হয় না। সর্বোচ্চ কিছুদিন লুকিয়ে রাখা যায়। এদিকে খাতওয়ারি হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয়ই মোট খেলাপী ঋণের অর্ধেক রয়েছে। এই খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৪৮ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৩০ শতাংশেরও বেশি। সরকারী মালিকানাধীন বিশেষায়িত খাতের দুই ব্যাংকের খেলাপী ঋণ ৪ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। এই খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণের হার ১৮.৭৪ শতাংশ। বেসরকারী ব্যাংকগুলোয় খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৩৮ হাজার ২২৫ কোটি টাকা বা বিতরণকৃত ঋণের ৫.৫৭ শতাংশ। এছাড়া বিদেশী ব্যাংকগুলো বিতরণকৃত ঋণের ৬.৫৩ শতাংশ বা ২ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা খেলাপী হয়ে গেছে। সূত্র আরও জানায়, খেলাপী ঋণের শীর্ষ তালিকায় আছে জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটির খেলাপীর ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা খেলাপী ঋণ রয়েছে সোনালী ব্যাংকে। এছাড়া বেসিক ব্যাংকের ৯ হাজার ৩৪৪ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ৫ হাজার ৯৬৩ কোটি ও বিডিবিএলের ৮৪৮ কোটি টাকা খেলাপী ঋণ হয়েছে। বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ খেলাপী ঋণ রয়েছে ইসলামী ব্যাংকের ৩ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৪.৩১ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ফারমার্স ব্যাংক (নতুন নাম পদ্মা)। এখানকার খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৭০ কোটি টাকা। এছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংকের ২ হাজার ১৮ কোটি, ইউসিবি ব্যাংকের ১ হাজার ৯০৪ কোটি, এবি ব্যাংকের ১ হাজার ৬৬৫ কোটি, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের দেড় হাজার কোটি টাকা খেলাপী ঋণ রয়েছে।
×